ছাত্র-গণঅভ্যুত্থানে শেখ হাসিনার পতনের পর একটি ভঙ্গুর অর্থনৈতিক পরিস্থিতি ও রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতার মধ্যে দায়িত্ব নেওয়া ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকারের কাছে সাধারণ মানুষের প্রত্যাশা ছিল বহুমাত্রিক। বিশেষ করে চাঁদাবাজি ও সিন্ডিকেট ভেঙে দিয়ে দ্রব্যমূল্য কমানো, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নতি, দ্রুত সংস্কারের মাধ্যমে নির্বাচনি রোডম্যাপ ঘোষণার মাধ্যমে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা তৈরি। কিন্তু অন্তর্বর্তী সরকার ছয় মাসেও এসব বিষয়ে প্রত্যাশিত পরিবর্তন আনতে পারেননি বলে মনে করেন বিশ্লেষকরা। অবশ্য কারও কারও মতে, এ যেহেতু অন্য সরকারের মতো নয়, মাত্র কয়েক মাসের হিসাব দিয়ে সফলতা-ব্যর্থতা নির্ণয় যৌক্তিক নয়।
বিশ্লেষকরা বলছেন, সরকারি চাকরিজীবীসহ বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষের দাবি-দাওয়ার আন্দোলন মোকাবিলায় হিমশিম খাওয়ার পাশাপাশি সংস্কার আলোচনা নিয়েই সরকার বেশি ব্যস্ত ছিল। সরকারের উচিত ছিল দ্রব্যমূল্য ক্রয়ক্ষমতার মধ্যে রাখা, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণসহ জনপ্রশাসনকে গতিশীল করতে কঠোর পদক্ষেপ নেওয়া। একই সঙ্গে নির্বাচনি রোডম্যাপ ঘোষণার মাধ্যমে দেশকে নির্বাচনমুখী করে রাজনৈতিক দলগুলোকে আস্থায় আনা। এগুলো করা সম্ভব হলে মানুষের মধ্যে হতাশা তৈরি হতো না।
গণঅভ্যুত্থানের পর বিভিন্ন নাটকীয়তার মধ্যে গত ৮ আগস্ট দায়িত্ব নেওয়া অন্তর্বর্তী সরকারের মেয়াদ ছয় মাস পূর্ণ হচ্ছে আজ। দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকেই সরকার বলে আসছে রাষ্ট্র সংস্কারের মাধ্যমে ন্যায়বিচার ও মানবিক মর্যাদা প্রতিষ্ঠার যে স্বপ্ন নিয়ে ছাত্র-জনতা অভ্যুত্থান ঘটিয়েছে, তা বাস্তবে রূপ দিতে পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। নির্বাচনব্যবস্থা, সংবিধান, জনপ্রশাসন, পুলিশ ও বিচারব্যবস্থা সংস্কার কমিশনসহ গুরুত্বপূর্ণ সংস্কার কমিশনগুলো ইতিমধ্যে তাদের প্রতিবেদন জমা দিয়েছে। কমিশনগুলোর সুপারিশ বাস্তবায়নে রাজনৈতিক ঐকমত্য গড়ে তোলার কাজ চলছে। ছয় মাসে দেশে রিজার্ভ ও রেমিট্যান্স বেড়েছে। তবে বাজার নিয়ন্ত্রণে আসেনি এবং আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নতি হয়নি। আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর গত ছয় মাস ধরে সবচেয়ে বেশি আলোচিত হচ্ছে জাতীয় সংসদ নির্বাচন কবে হবে এবং এ বিষয়ে রোডম্যাপ ঘোষণা করা নিয়ে। বিএনপিসহ বেশিরভাগ রাজনৈতিক দল এ দাবিতে সোচ্চার হলেও সরকারের পক্ষ থেকে আগামী ডিসেম্বর অথবা ২০২৬ সালের জুন মাসে নির্বাচনের কথা বললেও কোনো রোডম্যাপ ঘোষণা করা হয়নি। তাই নির্বাচনি রোডম্যাপ দেওয়ার পক্ষে-বিপক্ষে এক ধরনের চাপে রয়েছে সরকার।
শেখ হাসিনা দেশ ছেড়ে পালিয়ে যাওয়ার পরপরই যে অরাজক পরিস্থিতি ছিল, এখন ততটা না থাকলেও আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি এখনও নাজুক বলে করছে মানুষ মনে। গণআন্দোলনে দমন-পীড়নের কারণে পুলিশের ওপর জনগণের আস্থা কমে গেছে। বর্তমানে পরিস্থিতির কিছুটা উন্নতি হলেও প্রতিশোধের ভয়ে পুলিশ পুরোপুরি তাদের কাজে ফেরেনি এবং কোনো পদক্ষেপ নিতেও সতর্কতা অবলম্বন করছে। পুলিশের এ নির্লিপ্ততার কারণে অপরাধ বেড়েছে। রাজধানীসহ সারা দেশেই ছিনতাই, ডাকাতিসহ বিভিন্ন অপরাধ ঘটছে। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি হওয়ায় সাধারণ মানুষের মধ্যে ক্ষোভ রয়েছে। এ ছাড়া বিভিন্ন দাবি-দাওয়া নিয়ে আন্দোলনের নামে প্রায়ই সড়ক অবরোধের ঘটনায় মানুষ বিরক্ত হয়ে পড়েছে। সরকার এ বিষয়ে কড়া পদক্ষেপ নিতে পারেনি। অনেকেই বলছেন, সরকারের উপদেষ্টা পরিষদে অনেকেই যোগ্য তবে আরও যোগ্য ব্যক্তিদের নেওয়া হলে তারা যেকোনো পরিস্থিতি সামাল দিতে পারতেন।
ড. ইউনূসের সরকারের কাছে যে প্রত্যাশা ছিল, তা পূরণে সরকার অনেকটা পিছিয়ে রয়েছে বলেও মনে করেন বিশ্লেষকরা। আওয়ামী লীগ সরকারের সময় গুম এবং জুলাই বিপ্লবের আন্দোলনে ছাত্র-জনতা হত্যাকারীদের গ্রেফতার ও বিচারের আওতায় আনার বিষয়ে সরকারের পদক্ষেপ যথেষ্ট নয় বলেও মনে করছেন অনেকে। গণঅভ্যুত্থানে শহিদ পরিবারগুলোকে পর্যাপ্ত সহায়তা দেওয়া এবং আহতদের চিকিৎসাসেবায় গাফিলতি রয়েছে বলেও অভিযোগ উঠেছে। আহতরা সুচিকিৎসার দাবিতে একাধিকবার রাজপথে আন্দোলনেও নেমেছেন। তবে সরকার গত ছয় মাসে অর্থনীতি পুনরুদ্ধারে বিভিন্ন উদ্যোগ নেওয়ায় ব্যাংক খাতে শৃঙ্খলা ফেরার পাশাপাশি রিজার্ভে পতন থেমেছে। দেশে রফতানি ও প্রবাসী আয় বৃদ্ধির ফলে অর্থনীতির কিছু প্রতিকূলতার মধ্যেও রিজার্ভে কিছুটা স্বস্তি এসেছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, চলতি ২০২৪-২৫ অর্থবছরের জুলাই থেকে জানুয়ারি পর্যন্ত সাত মাসে দেশে ১ হাজার ৫৯৬ কোটি ১৮ লাখ মার্কিন ডলার রেমিট্যান্স এসেছে। গত বছরের একই সময়ে এ পরিমাণ ছিল ১ হাজার ২৯১ কোটি ২৮ লাখ মার্কিন ডলার। অর্থাৎ এক বছরের ব্যবধানে রেমিট্যান্সের প্রবাহ বেড়েছে ৩০৫ কোটি ডলার। তবে রাজস্ব আয়ে ঘাটতি, বিদেশি বিনিয়োগে স্থবিরতা ও কর্মসংস্থান সৃষ্টি না হওয়ার বিষয়টি দুশ্চিন্তা বাড়াচ্ছে। সবমিলিয়ে কঠিন পরিস্থিতির মধ্যে পার হয়েছে অন্তর্বর্তী সরকারের ছয় মাস।
ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের ব্যুরো অব ইকোনমিক রিসার্সের চেয়ারম্যান অধ্যাপক এম এম আকাশ বলেন, অন্তর্বর্তী সরকার ক্ষমতা পাওয়ার পর যে প্রতিশ্রুতিগুলো দিয়েছিল এবং মানুষের মধ্যে যে প্রত্যাশা তৈরি করেছিল সেগুলো পূরণ করতে পারেনি। কারণ দ্রব্যমূল্য তখন ডাবল ডিজিটে ছিল। মানুষ মনে করত বিভিন্ন সিন্ডিকেট ও মধ্যস্বত্বভোগীদের কারণে দাম বেশি হচ্ছে। গণঅভ্যুত্থানের পর মানুষের প্রত্যাশা ছিল সিন্ডিকেট ও চাঁদাবাজি থাকবে না বিধায় দামটা কমবে। এমন একটা আশ্বাসও দেওয়া হচ্ছিল এবং মানুষের আশাও তাই ছিল। কিন্তু দাম তো কমল না বরং দ্রব্যমূল্য ওঠানামা করছে এবং কোনো কোনো ক্ষেত্রে বেড়েও গেছে। তিনি মনে করেন, রেশন ও খোলাবাজারে বিক্রির মাধ্যমে নিম্ন আয়ের লোকদের সামাজিক সুরক্ষা দেওয়ার কাজটা জরুরি। যখন দাম বেড়ে যাবে তখন সরকার টিসিবি থেকে ওই পণ্যটা সরবরাহ করবে এবং দাম কমে গেলে সরকার কিনে নেবে। যদিও বিগত সরকার এ কাজ কিছুটা শুরু করেছিল। এ জিনিসগুলো বর্তমান সরকার সমন্বিতভাবে করতে পারেনি বলে মন্তব্য করেন তিনি। কেননা সরকার প্রশাসনকেই ঠিকমতো সেটআপ করতে পারেনি। এ ছাড়া মুক্তবাজার অর্থনীতির প্রতি এ সরকারের একটা কমিটমেন্ট আছে বিগত সরকারের তুলনায় একটু বেশি। সে কারণে তারা তো এসব করবেও না বা করতে গেলে আইএমএফের সঙ্গে তাদের সম্পর্ক খারাপ হয়ে যাবে। এসব কারণে মানুষ প্রত্যাশা করেছিল হয় দ্রব্যমূল্য কমিয়ে দেবে নয়তো রেশন বা খোলাবাজারে পণ্য দেবে। তা তো হলো না। তাই সবমিলিয়ে মানুষ একটু ধাক্কা খেয়েছে এবং এ সরকারের জনপ্রিয়তাও একটু আস্তে আস্তে কমতে শুরু করেছে। এ ছাড়া রাজনীতিকরা এ সরকারকে পুরোপুরি সাপোর্ট দিল না এবং বেশিরভাগ দল বলল, এ সরকার দ্রুত নির্বাচন দিয়ে চলে যাক। অর্থনীতিবিদদেরও অনেকের একই মত দ্রুত নির্বাচন দেওয়া। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতিও নিয়ন্ত্রণে নেই। এটি নিয়ন্ত্রণে না নেওয়া পর্যন্ত অর্থনীতিও গতিশীল হবে না। রাজনৈতিক সরকার হলে আস্থা বাড়বে তাতে দেশি-বিদেশি বিনিয়োগও বাড়বে বলে মন্তব্য করেন এম এম আকাশ।
রাজনৈতিক বিশ্লেষক অধ্যাপক আলী রীয়াজ বলেন, ছাত্র-গণঅভ্যুত্থানের আগে বিগত ১৬ বছরে গোটা রাষ্ট্রব্যবস্থাকে ধ্বংস করে দেওয়া হয়েছে। ব্যক্তিকেন্দ্রিকতার কারণে জনপ্রশাসন, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী, বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানগুলো কার্যত ধ্বংস হয়েছে। তার মতে, গত ছয় মাসে সরকারের সাফল্য হচ্ছে দেশে এক ধরনের স্থিতিশীলতা তৈরি হয়েছে। কারণ ১৬ বছরের পুরোনো অস্থিতিশীল পরিস্থিতি মোকাবিলার পাশাপাশি প্রতিদিনই দাবি-দাওয়া নিয়ে আন্দোলন হচ্ছে। সরকারকে এগুলো মোকাবিলা করে স্থিতিশীলতা তৈরি করতে হয়েছে। তাই সফলতার পাশাপাশি কিছু ব্যর্থতাও রয়েছে। যেমন আইনশৃঙ্খলা ও অর্থনৈতিক পরিস্থিতি আরও ভালো হওয়া উচিত ছিল। এগুলো মানুষের প্রত্যাশা ছিল। তবে এ বিষয়ে সরকারের চেষ্টা ছিল এবং সাফল্যও আছে। তিনি বলেন, এটি কিন্তু অন্য সরকারের মতো নয়। তাই তিন মাস বা ছয় মাসের হিসাব দিয়ে সফলতা-ব্যর্থতা নির্ণয় করা ঠিক হবে না। কারণ এ সরকারের সফলতার ওপর নির্ভর করছে দেশে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হবে কি হবে না। তাই এ সরকারের সাফল্যের জন্য রাজনৈতিক শক্তিরও ভূমিকা থাকতে হবে। একইভাবে এই সরকার ব্যর্থ হলে তার দায়ভারও রাজনৈতিক শক্তিগুলোর ওপর বর্তাবে।
গণতান্ত্রিক অধিকার কমিটির সদস্য ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের সাবেক অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ বলেন, সরকার সংস্কারের কথা বললেও বাস্তবে সংস্কার বা পরিবর্তনের তেমন কোনো নমুনা দেখা যাচ্ছে না। ছয় মাসে জনগণের আকাক্সক্ষা পূরণে অন্তর্বর্তী সরকারের ঘাটতি রয়েছে। কারণ গণঅভ্যুত্থানের পর সবাই বলেছিল পরিবর্তন হবে, নতুন বাংলাদেশ গঠন করা হবে, বৈষম্যহীন বাংলাদেশ হবে। কিন্তু কাজকর্মে তার কোনো প্রতিফলন দেখা যাচ্ছে না। তিনি বলেন, সংস্কার হতে গেলে তার একটা প্রতিফলন জনগণের জীবনের মধ্যে থাকবে। কিন্তু ছয় মাসেও জনগণের জীবনে তার কোনো প্রতিফলন নেই। বিশেষ করে জিনিসপত্রের দামের মধ্যে সংস্কারের প্রতিফলন নেই। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির মধ্যেও প্রতিফলন নেই। শেখ হাসিনার স্বৈরশাসনের আমলে যে লুটেরা ধনিকশ্রেণির বিকাশ হয়েছিল, তার পেছনে এ সাম্রাজ্যবাদী শক্তিগুলো প্রবলভাবে সক্রিয় ভূমিকা পালন করেছে। অন্তর্বর্তী সরকার আসার পর পরিবর্তন হওয়ার কথা থাকলেও বাস্তবে কোনো ধরনের পার্থক্য নেই বলে মন্তব্য করেন তিনি।