ই-পেপার মঙ্গলবার ৪ ফেব্রুয়ারি ২০২৫
মঙ্গলবার ৪ ফেব্রুয়ারি ২০২৫
ই-পেপার

মঙ্গলবার ৪ ফেব্রুয়ারি ২০২৫

ফেব্রুয়ারি : একটি বিদ্রোহী চেতনার নাম
প্রকাশ: মঙ্গলবার, ৪ ফেব্রুয়ারি, ২০২৫, ৯:৩৪ এএম  (ভিজিট : ১০৬)
ফেব্রুয়ারি ও ভাষা আন্দোলন ঘিরে তাই গাঢ় থেকে গাঢ়তর বেদনার বোধ অনুরণিত হয়েছে কবি শামসুর রাহমানের কবিতায়। বাংলা ভাষাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবিতে সালাম, বরকত, রফিক, জব্বার ও শফিউরসহ নাম না জানা অসংখ্য শহিদ বায়ান্নর ফেব্রুয়ারিতে ঢাকার রাজপথে বুকের রক্ত ঢেলে দিয়ে রচনা করেছিলেন এ অমর কবিতা।

আর যেন না দেখি কার্তিকের চাঁদ কিংবা পৃথিবীর কোনো হীরার সকাল, কোনোদিন আর যেন আমার চোখের কিনারে আকাশের প্রতিভা, সন্ধ্যা নদীর অভিজ্ঞান আর রাত্রি রহস্যের গাঢ় ভাষা কেঁপে না ওঠে, কেঁপে না ওঠে পৃথিবীর দীপ্তিমান দিগন্তের তারা...।

আবার এসেছে ফেব্রুয়ারি, অমর একুশের স্মৃতিবিজড়িত মাস। বছর ঘুরে ফেব্রুয়ারি এলেই বাতাসে ভেসে আসে একুশের আনন্দ-বেদনার এক অদ্ভুত বোধ। মনের আকাশে উড়ে বেড়ায় একঝাঁক ফেরারি পাখি। ফেব্রুয়ারি ও ভাষা আন্দোলন ঘিরে তাই এমনই গাঢ় থেকে গাঢ়তর বেদনার বোধ অনুরণিত হয়েছে কবি শামসুর রাহমানের কবিতায়। বাংলা ভাষাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবিতে সালাম, বরকত, রফিক, জব্বার ও শফিউরসহ নাম না জানা অসংখ্য শহিদ বায়ান্নর ফেব্রুয়ারিতে ঢাকার রাজপথে বুকের রক্ত ঢেলে দিয়ে রচনা করেছিলেন এ অমর কবিতা।

একুশের চেতনা বাংলাদেশের রাজনীতি, সাংস্কৃতিক চেতনা, সমাজবোধ এবং অর্থনৈতিক ভাবনাকে প্রভাবিত করে এসেছে। বাংলাদেশের প্রায় প্রতিটি রাজনৈতিক ঘটনার মোড় পরিবর্তনের সঙ্গে একুশে ফেব্রুয়ারির প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ সম্পর্ক ছিল এবং আছে। একুশ এ দেশের মানুষকে দুঃশাসনের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে সাহসী করেছে। এ দেশের মানুষ প্রতিটি গণতান্ত্রিক আন্দোলনে শহিদ মিনারে শপথ নিয়েই পথ চলেছে। সামরিক স্বৈরাচারী এরশাদবিরোধী আন্দোলনে যেমন অগ্নিগর্ভ হয়ে উঠেছিল শহিদ মিনার চত্বর, তেমনি ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনার দুঃশাসনের কবর রচনার লক্ষ্যে এক দফা দাবিও ঘোষিত হয়েছিল এই শহিদ মিনার চত্বর থেকেই। এক দিন পরই ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে স্বৈরশাসক শেখ হাসিনা ভারতে পালিয়ে যেতে বাধ্য হন।

একুশের সংগ্রামের ধারাবাহিকতায় আমরা অর্জন করেছি স্বাধীন বাংলাদেশ। এরপর নানা চড়াই-উতরাই পেরিয়ে একুশে ফেব্রুয়ারি এখন সারা বিশ্বে নানা পরিসরে পালিত হচ্ছে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে। স্বাধীনতার পর ১৯৭২ সাল থেকে এ মাসেই প্রতি বছর বাংলা একাডেমি চত্বরে মাসব্যাপী অনুষ্ঠিত হয় অমর একুশে বইমেলা, আমাদের প্রাণের মেলা। উৎসব আয়োজনে লেখক-প্রকাশকদের সরব পদচারণে মুখর হয়ে ওঠে একাডেমি চত্বর। ভেসে আসে ভাঁজখোলা নতুন বইয়ের প্রাণজুড়ানো সুবাস।

ভাষা আন্দোলনের এত বছরে আমাদের রাজনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক জীবনে ফেব্রুয়ারি খুবই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক চেতনার বিকাশেও একুশ ব্যাপক প্রভাব সৃষ্টি করেছে। বাংলাদেশের সাহিত্যে, নাটকে, গানে, চিত্রকলায় এবং সংস্কৃতির সব মাধ্যমে একুশের প্রভাব অনেক বেশি ও প্রসারিত। একুশ আমাদের শিখিয়েছে আধুনিক মানসিকতা। কেন্দ্রীয় শহিদ মিনারে আমরা ভাষাশহিদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানাই। কালের বিবর্তনে কেন্দ্রীয় শহিদ মিনার হয়ে উঠেছে আমাদের মিলিত চেতনার স্থান। বায়ান্নর রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিতে প্রতিষ্ঠিত এই শহিদ মিনার আমাদের স্বাধীনতা-পূর্ব এবং স্বাধীনতা-উত্তর সব গণতান্ত্রিক আন্দোলনে জুগিয়েছে প্রেরণা।

ছেষট্টির ছাত্র আন্দোলন, ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান, একাত্তরের মার্চের অসহযোগ আন্দোলনে যেমন সংগ্রামী মানুষের আধার ছিল এই শহিদ মিনার; তেমনি স্বাধীনতা-সংগ্রামে শত্রুর পাশবিক থাবায় আহত এই শহিদ মিনার ৯ মাস এ দেশের মানুষের প্রাণে জুগিয়েছে মুক্তির সংগ্রামী চেতনা, শুনিয়েছে মৃত্যুঞ্জয়ী জীবনের অভয় বাণী। বায়ান্নর রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের সাত দশক অতিবাহিত হওয়া সত্ত্বেও নকশা অনুযায়ী পূর্ণতা পায়নি এই শহিদ মিনার। আজও তা রয়ে গেছে অপূর্ণ। শহিদ মিনারের বর্তমানের অপূর্ণ রূপটিও পরিগ্রহ করেছে নানা বিবর্তনের মাধ্যমে।

আজ যেখানে শহিদ মিনারটি দাঁড়িয়ে আছে, এখানেই বায়ান্নর ২১ ফেব্রুয়ারি বাংলাকে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করার দাবিতে আন্দোলনকারীদের ওপর প্রথম গুলি চালানো হয়েছিল। এ পরিপ্রেক্ষিতে পরদিন অর্থাৎ ২২ ফেব্রুয়ারি এখানে তৈরি করা হয়েছিল একটি স্মৃতিস্তম্ভ। ওইদিন (২২ ফেব্রুয়ারি) সূর্যাস্তের সময় ভাষা আন্দোলনের তৎকালীন নেতাকর্মীদের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী এ স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণের উদ্যোগ নেওয়া হয়। রাতে ইট-সুরকি, সিমেন্ট ও অন্যান্য মালমসলা জোগাড় করে ভাষা আন্দোলনের প্রাণচঞ্চল তরুণরাই সারা রাত ধরে অমানুষিক পরিশ্রম করে স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণের কাজটি সম্পন্ন করেন।

ছাত্রহত্যার প্রতিবাদে যিনি পূর্ববঙ্গ আইন পরিষদের সদস্য পদ থেকে ইস্তফা দিয়েছিলেন, ‘দৈনিক আজাদ’ সম্পাদক আবুল কালাম শামসুদ্দিন ২৩ ফেব্রুয়ারি শহিদ স্মৃতিস্তম্ভটি উদ্বোধন করেন। এর মাধ্যমে তিনি একদিকে যেমন যুব-ছাত্র-জনতার কৃতজ্ঞতাভাজন হন, তেমনি অন্যদিকে রাতে পুলিশ শহিদ স্মৃতিস্তম্ভটি ভেঙে চুরমার করে দেয়। এরপর ১৯৫৪ সালে অনুষ্ঠিত সাধারণ নির্বাচনে এককভাবে বিজয়ী যুক্তফ্রন্ট সরকার তাদের নির্বাচনি ওয়াদা মোতাবেক ২১ ফেব্রুয়ারির আন্দোলনে শহিদদের স্মৃতিরক্ষার্থে স্মৃতিস্তম্ভটি নির্মাণের উদ্যোগ নেয়। এ পরিপ্রেক্ষিতে ১৯৫৬ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি পূর্ব পাকিস্তানের তদানীন্তন মুখ্যমন্ত্রী আবু হোসেন সরকার শহিদ মিনারের ভিত্তিস্থাপন করেন। ১৯৫৬ সালে মুখ্যমন্ত্রীর দায়িত্বভার গ্রহণ করার পর আতাউর রহমান খান শহিদ মিনারের ব্লু প্রিন্ট ও ডিজাইন তৈরির জন্য প্রখ্যাত স্থপতি হামিদুর রহমানকে নিযুক্ত করেন।

শহিদ মিনারের অঙ্গশোভা পরিকল্পনার দায়িত্ব গ্রহণ করেন শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিন ও শিল্পী কামরুল হাসান। স্থপতি হামিদুর রহমানের মূল নকশা ছিল এরূপ স্তম্ভগুলোর সামনের চত্বরের মধ্যস্থলে একটি সরোবর, সরোবরে রক্তকমল শাপলা, স্তম্ভগুলোর অবনত মাথার ছায়া, স্তম্ভের মধ্যবর্তী ফাঁকে ফাঁকে শিক, মূল শহিদ বেদির দুই পাশে দুটি সবুজ কামরা, এর একটি পাঠাগার, অন্যটি জাদুঘর। মূল চত্বরের বাইরে একটি বেদি। উঁচু বেদি হবে সাংস্কৃতিক ও অন্যান্য অনুষ্ঠানের স্থান। এ বিষয়ে স্থপতির ব্যাখ্যা হলো- মূল বেদি হলো জন্মভূমি। অবনত মাথা স্তম্ভসমূহ এবং পাশেরগুলো হলো জনতা। স্বচ্ছ পানি শহিদদের আত্মার প্রতিকৃতি। রক্তকমল শাপলা হলো আত্মদানের প্রতীক। সরোবরে অবনত শিরের ছায়া হচ্ছে শহিদের আত্মদানের প্রতি দেশবাসীর কৃতজ্ঞতা।

আতাউর রহমান খানের সরকার পরিকল্পনা প্রণয়নে দক্ষতার পরিচয় দিলেও দুই বছরের অধিক ক্ষমতাসীন থাকা সত্ত্বেও স্থপতির ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় অঙ্কিত নকশা মোতাবেক শহিদ মিনার নির্মাণের চরম ব্যর্থতার পরিচয় দেন। উল্লেখ্য, পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খানের সামরিক শাসনামলে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের উর্দুভাষী গভর্নর লে. জে. আযম খান বর্তমান শহিদ মিনারটি নির্মাণের ব্যবস্থা করেন এবং ১৯৬৩ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি শহিদ বরকতের মা ওই মিনারটি উদ্বোধন করেন। লে. জে. আযম খান নির্মিত এ শহিদ মিনারটি ছিল স্থপতি হামিদুর রহমান কর্তৃক অঙ্কিত নকশার আংশিক বাস্তবায়ন মাত্র। ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চের রাতে পাকিস্তানি বাহিনীর কামানের গোলার আঘাতে এ শহিদ মিনার ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়। এ ঘটনায় মারা যান শহিদ মিনারের প্রহরী দেলোয়ার হোসেন, সালাহ উদ্দীন ও রইছ আলী।

১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর বিজয়ী জাতির আনন্দ অশ্রুতে মুছে যায় শহিদ মিনারে আঘাতের যাতনা। রাষ্ট্রপতি আবু সাঈদ চৌধুরীর সভাপতিত্বে ১৯৭২ সালে কেন্দ্রীয় শহিদ মিনার পুনঃপ্রতিষ্ঠার জন্য একটি পরিষদ গঠিত হয়। একটি প্রতিযোগিতার মাধ্যমে শহিদ মিনারের জন্য নকশা বাছাই করে এ পরিষদ। প্রতিদ্বন্দ্বী ১২টি নকশার মধ্যে শিল্পী হামিদুর রহমান এবং জাফরের নকশা শ্রেষ্ঠ বিবেচিত হয়। সেই নকশা অনুযায়ী কাজও শুরু হয়েছিল। কিন্তু পরে এই নকশা অসম্পূর্ণ বিবেচিত হয় এবং একটি পূর্ণাঙ্গ শহিদ মিনার তৈরির চিন্তাভাবনা শুরু হয়। এরপর রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের শিক্ষাবিষয়ক উপদেষ্টা অধ্যাপক আবুল ফজল ১৯৭৬ সালের জুন মাসে শহিদ মিনার পুনর্নির্মাণের কিছু পদক্ষেপ গ্রহণ করেন। ফলে প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের স্থাপত্য ও পরিকল্পনা অনুষদকে মিনারের নকশা প্রণয়নের দায়িত্ব দেওয়া হয় এবং সমাজের বিভিন্ন স্তরের ব্যক্তিদের নিয়ে একটি পরিষদ গঠিত হয়। স্থপতি ড. এমএ মুকতাদির, হাবিবুর রহমান, শামসুল ওয়ারেস ও খায়রুল আনাম কর্তৃক প্রস্তাবিত তিনটি নকশার মধ্যে সরকার একটি গ্রহণ করে। এটিই মূল নকশা হিসেবে পরিচিত। কিন্তু কাজটি করা হয়নি।

গৃহীত নকশায় বর্ধিত উচ্চতর মিনার, বেদিসংলগ্ন পশ্চিমের জমিতে একটি গ্যালারি জাতীয় নিচু ভবনের মধ্যে দেয়াল চিত্র, ভাস্কর্য ও লেখার মাধ্যমে ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস সংরক্ষিত হবে, চত্বের উত্তর সীমায় খণ্ড খণ্ড দেয়াল (এখানে একুশের গান, কবিতা, চিত্রকলা ও ভাস্কর্য থাকবে) ইত্যাদির কথা বলা হয়। জেনারেল এরশাদের আমলে ১৯৮৩ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে গণপূর্ত বিভাগ মূল নকশার বিষয়গুলো এড়িয়ে একটি নকশা তৈরি করে এবং ওই নকশা অনুযায়ী ওই বছর সেপ্টেম্বর মাসের প্রথম সপ্তাহে কেন্দ্রীয় শহিদ মিনার পুনর্নির্মাণের কাজ শুরু হয়। এ কাজে নিযুক্ত হয় জুবিলী ইঞ্জিনিয়ারিং। ১৯৮৪ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে ৫০০ লোক দিন-রাত পরিশ্রম করে ২১ ফেব্রুয়ারির আগে নির্মাণকাজ সম্পন্ন করে। নবনির্মিত কেন্দ্রীয় শহিদ মিনারের মোট জমির পরিমাণ প্রায় চার একর। মিনারটি ৭০ হাজার বর্গফুট বা ১ দশমিক ৫ একরের চেয়ে কিছু বেশি। ফুল দেওয়ার বেদিটির আয়তন ২ হাজার বর্গফুট। টকটকে লাল পাথরের অভাবে আপাতত ‘রেড অকসাইড’ দিয়ে লাল করা হয়েছে।


সময়ের আলো/এএ/




https://www.shomoyeralo.com/ad/1698385080Google-News-Update.jpg

সর্বশেষ সংবাদ

সর্বাধিক পঠিত


ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক : সৈয়দ শাহনেওয়াজ করিম, আমিন মোহাম্মদ মিডিয়া কমিউনিকেশন লিমিটেড এর পক্ষে প্রকাশক গাজী আহমেদ উল্লাহ। নাসির ট্রেড সেন্টার, ৮৯, বীর উত্তম সি আর দত্ত সড়ক (সোনারগাঁও রোড), বাংলামোটর, ঢাকা।
ফোন : +৮৮-০২-৯৬৩২৩৬৮-৭৪, ফ্যাক্স : +৮৮-০২-৯৬৩২৩৭৫ | ই-মেইল : shomoyeralo@gmail.com
close