মিথ্যা বলা মহাপাপ। মিথ্যুক ব্যক্তি ইহকাল ও পরকালে লাঞ্ছিত ও অপদস্থ হবে। এর বিপরীতে সত্যবাদিতা হলো মানুষের নৈতিক গুণাবলির অন্যতম। এটি দুনিয়া ও আখেরাতের সফলতা ও মুক্তির অন্যতম প্রধান কারণ। এ জন্য আল্লাহ তায়ালা আমাদের সত্যবাদিতার প্রতি উৎসাহিত করেছেন। তিনি বলেন, ‘হে ঈমানদারগণ! তোমরা আল্লাহকে ভয় করো এবং সত্যবাদীদের সঙ্গ অবলম্বন করো’ (সুরা তওবা, আয়াত: ১১৯)। হজরত আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘সত্য নেকির দিকে পরিচালিত করে আর নেকি জান্নাতে পৌঁছায়। মানুষ সত্যের ওপর প্রতিষ্ঠিত থেকে অবশেষে ‘সিদ্দিক’-এর দরজা লাভ করে। আর মিথ্যা মানুষকে পাপের দিকে নিয়ে যায়। পাপ তাকে জাহান্নামে পৌঁছায়। মিথ্যা বলতে বলতে মানুষ অবশেষে আল্লাহর কাছে মিথ্যাবাদী সাব্যস্ত হয়ে যায়’ (সহিহ বুখারি, হাদিস : ৬০৯৪)। এ হাদিসে রাসুলুল্লাহ (সা.) আমাদের সত্যবাদী হওয়ার শিক্ষা দেওয়ার পাশাপাশি এর পুরস্কারস্বরূপ জান্নাত লাভের ব্যাপারেও অবহিত করেছেন। এরপর তিনি মিথ্যার ব্যাপারে ভীতি প্রদর্শন করে বলেন, মিথ্যার পরিণতি হলো জাহান্নাম। সুতরাং এই হাদিস আমাদের সত্যবাদিতার প্রতি উৎসাহিত এবং মিথ্যা থেকে সতর্ক করে।
কৌতুকস্বরূপ মিথ্যা : হাসি-ঠাট্টা অথবা কৌতুক করেও মিথ্যা বলা যাবে না। মুয়াবিয়া ইবনে হায়দা কুশাইরি (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসুল (সা.) বলেছেন, ‘সে ব্যক্তির ধ্বংস অনিবার্য, যে কথা বলে এবং লোক হাসানোর জন্য মিথ্যা বলে। তার জন্য ধ্বংস। তার জন্য ধ্বংস’ (জামে তিরমিজি, হাদিস : ২৩১৫)। অন্য হাদিসে আবু উমামা বাহিলি (রা.) থেকে বর্ণিত হয়েছে, তিনি বলেন, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি হাসি-ঠাট্টার ছলেও মিথ্যা বলে না, আমি তার জন্য জান্নাতের মধ্যস্থলে একটি ঘরের জিম্মাদার।’ (মুজামুল আওসাত, হাদিস : ৮৭৮)
বাচ্চাদের সঙ্গে মিথ্যা : অনেকেই বাচ্চাদের মিথ্যা প্রলোভন দেখায়। এর দ্বারা বাচ্চারা মিথ্যাচারে অভ্যস্ত হয়ে যায়। তাই এটা নিষিদ্ধ। এ ছাড়া এটা গুনাহের কাজও। হজরত আবদুল্লাহ ইবনে আমের (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, ‘একবার আমার মা আমাকে ডাকেন, যখন রাসুল (সা.) আমার ঘরে অবস্থান করছিলেন। আমার মা আমাকে বলেন, তুমি এখানে এসো, আমি তোমাকে দেব। রাসুল (সা.) তাকে জিজ্ঞেস করেন, তুমি কী দিতে চাও? তিনি বললেন, আমি তাকে খেজুর দেব। এ কথা শুনে রাসুল (সা.) বলেন, তুমি যদি তাকে কিছু না দিতে, তবে তোমার জন্য একটা গুনাহ লেখা হতো।’ (সুনানে আবু দাউদ, হাদিস : ৪৯০৬)
মিথ্যা প্রশংসা : কারও সামনে তার মিথ্যা প্রশংসা করা নিষিদ্ধ। কারও জন্য অনুপযুক্ত উপাধি ব্যবহার করাও দূষণীয়। সামনাসামনি প্রশংসা করতে গিয়ে কখনো-সখনো সমাজের নিকৃষ্ট, নেশাগ্রস্ত, সুদি-কারবারি, ঘুষখোর, অত্যাচারী, পাপাচারী ব্যক্তিকে ‘ফুলের মতো পবিত্র’ চরিত্রে ভূষিত করা হয়। এভাবে যখন কোনো পাপাচারী নিকৃষ্ট ব্যক্তির প্রশংসা করা হয়, তখন আল্লাহর আরশ পর্যন্ত কেঁপে ওঠে। হজরত আনাস ইবনে মালেক (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসুল (সা.) বলেছেন, ‘যখন কোনো পাপাচারী ব্যক্তির প্রশংসা করা হয়, তখন আল্লাহ তায়ালা রাগান্বিত হন এবং তার আরশ কেঁপে ওঠে।’ (শুআবুল ইমান, হাদিস : ৪৮৮৬)
মিথ্যা স্বপ্ন বর্ণনা : বানিয়ে বানিয়ে স্বপ্নের মিথ্যা বর্ণনা দেওয়াও অপরাধ। হজরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসুল (সা.) বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি এমন স্বপ্ন দেখার ভান করল, যা সে দেখেনি, তাকে (পরকালে) দুটি যবের দানায় গিঁট লাগানোর জন্য বাধ্য করা হবে। অথচ সে তা কখনোই পারবে না (ফলে লাঞ্ছিত ও অপদস্থ হবে)।’ (সহিহ বুখারি, হাদিস : ৬৫৬৫) অন্য হাদিসে তিনি বলেন, ‘নিঃসন্দেহে সবচেয়ে বড় মিথ্যা হলো, যা সে দেখেনি, তা দেখার দাবি করা।’ (সহিহ বুখারি, হাদিস : ৩২৫৯)
মিথ্যুকের শাস্তি : মিথ্যা হলো যাবতীয় অনর্থ ও সব পাপের মূল। এ জন্য ইহকাল ও পরকালে মিথ্যুকের শাস্তি ভয়াবহ। আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘নিশ্চয় সৎকর্মশীলগণ থাকবে জান্নাতে। আর পাপাচারীরা থাকবে জাহান্নামে’ (সুরা ইনফিতার, আয়াত : ১৩-১৪)।
মিথ্যুকের পরকালীন শাস্তি তো অবশ্যম্ভাবী। ইহকালেও তারা বিভিন্ন ধরনের শাস্তির সম্মুখীন হয়। এর কয়েকটি এমন-
এক. অশান্তি : মিথ্যুক কখনো আন্তরিক প্রশান্তি অনুভব করতে পারে না। বরং সবসময় সে একটা অস্থিরতা ও অশান্তির মধ্যে দিনাতিপাত করে। মিথ্যা ডেকে আনে অশান্তি। হজরত হাসান ইবনে আলি (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘সত্যবাদিতার মধ্যে রয়েছে প্রশান্তি এবং মিথ্যাবাদিতার মধ্যে রয়েছে অশান্তি’ (জামে তিরমিজি, হাদিস: ২৫১৮)।
দুই. জীবিকার সংকীর্ণতা : মিথ্যাবাদিতার কারণে জীবিকা সংকীর্ণ হয়ে পড়ে। হজরত আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত হাদিসে রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘মাতা-পিতার প্রতি সদাচরণ দীর্ঘায়ু হওয়ার কারণ। মিথ্যাচারিতা জীবিকা সংকুচিত করে দেয় এবং দোয়া দ্বারা ভাগ্যের পরিবর্তন ঘটে’ (আত তারগিব ওয়াত তারহিব, হাদিস : ৪৪৮৮)।
তিন. রহমত বঞ্চিত : মিথ্যুক আল্লাহর রহমত থেকে বঞ্চিত হয়। এমনকি তার থেকে রহমতের ফেরেশতা পর্যন্ত দূরে সরে যায়। হজরত আবদুল্লাহ ইবনে ওমর (রা.) থেকে বর্ণিত হাদিসে রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘বান্দা যখন মিথ্যা বলে, তখন এর দুর্গন্ধের কারণে ফেরেশতা এক মাইল দূরে চলে যায়’ (জামে তিরমিজি, হাদিস : ১৯৭২)। এমনভাবে মিথ্যুক ইহকালীন ও পরকালীন আরও বিভিন্ন ধরনের শাস্তির সম্মুখীন হবে। আল্লাহ তায়ালা আমাদের সব ধরনের মিথ্যাচার থেকে হেফাজত করুন।
সময়ের আলো/এএ/