প্রকাশ: রবিবার, ২ ফেব্রুয়ারি, ২০২৫, ৯:৪৫ এএম (ভিজিট : ২৬৬)
স্বল্প বেতনে দীর্ঘদিন ধরে শিক্ষকতা করে আসছেন। বিভিন্ন সময়ে তাদের আশ্বাস দেওয়া হয়েছে। কিন্তু দাবি পূরণ করা হয়নি। তার মানে পেটের দায়ে তারা তাদের ন্যায্য দাবি নিয়ে রাস্তায় নেমেছিল। প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত সর্বস্তরের শিক্ষককে নিজেদের পেশাগত মর্যাদা ও আর্থিক সুবিধা বাড়ানোর জন্য আন্দোলন-সংগ্রাম করতে হয়। প্রাথমিক শিক্ষাকে একমুখী করার আলোচনা থাকলেও প্রকৃতপক্ষে বহুমুখিতার চর্চা অব্যাহত আছে। ফলে এক শিক্ষাব্যবস্থার সঙ্গে অন্য শিক্ষাব্যবস্থার বৈষম্য কখনো দূর করা যায়নি।
প্রাথমিক শিক্ষার এই বহুমুখী ধারা নতুন প্রজন্মকে মনোজাগতিকভাবে বিভক্ত করেছে। বিভক্তি ও বৈষম্য সৃষ্টি হয়েছে শিক্ষকদের মধ্যেও। ফলে শিক্ষকদের অসন্তোষ দূর হয়নি। বৈষম্য নিরসনের দাবিতে তারা রাজপথে নেমে এসেছে। মাধ্যমিক পর্যায়ের শিক্ষকদের মধ্যেও বৈষম্যের কমতি নেই। সরকার অনুমোদিত কমিটির মাধ্যমে একই পদ্ধতিতে নিয়োগ পাওয়া এমপিওভুক্ত শিক্ষকদের একটি ক্ষুদ্র অংশকে জাতীয়করণ করে বৃহৎ অংশটিকে অযৌক্তিকভাবে বঞ্চিত করা হয়েছে। বঞ্চিত বৃহৎ অংশটি এখন যৌক্তিকভাবেই জাতীয়করণের দাবিতে আন্দোলনে নেমেছে। দীর্ঘদিন ধরে আন্দোলন চললেও দাবি কিন্তু পূরণ হয়নি। এমপিওভুক্ত শিক্ষকদের সার্বজনীন বদলির দাবি চলমান রয়েছে। সরকার বদলির যৌক্তিকতা স্বীকার করে নিলেও বদলি বাস্তবায়নের বিষয়টির সমাধান করতে কালক্ষেপণ করছে। সরকারি কলেজ শিক্ষকদেরও রয়েছে নানা সমস্যা। শিক্ষা ক্যাডারের শিক্ষকদের পদোন্নতির ক্ষেত্রে বিদ্যমান বৈষম্য নিরসনের দাবিতে বিভিন্ন সময় আন্দোলন হয়েছে। শিক্ষা ক্যাডার বিলুপ্তি নিয়েও গুঞ্জন শোনা যাচ্ছে।
এমপিওভুক্ত কলেজ শিক্ষকদের রয়েছে নানা সমস্যা। তাদের ক্ষেত্রে বৈষম্য শুধু আর্থিক নয়, মর্যাদার দিক দিয়েই আছে দারুণ বৈষম্য। এমপিওভুক্ত শিক্ষকরা সরকার অনুমোদিত কমিটির মাধ্যমে নিয়োগপ্রাপ্ত। তারা জাতীয় বেতন স্কেলের অন্তর্ভুক্ত এবং শতভাগ বেতন ও অন্যান্য ভাতা সরকারি কোষাগার থেকেই পেয়ে থাকেন। অথচ অযৌক্তিকভাবে তাদের ‘বেসরকারি’ শিক্ষক বলা হয়। সরকারি, আধা-সরকারি কিংবা স্বায়ত্তশাসিত নয়; একেবারে বেসরকারি। এই বেসরকারি ট্যাগ লাগিয়ে তাদের সামাজিক মর্যাদা খর্ব করে রাখা হয়েছে। শিক্ষা বিভাগীয় সব অফিস যেহেতু সরকারি তাই এই শিক্ষকরা শিক্ষা অফিসগুলোতে কোনো কাজে গেলে যথাযোগ্য সম্মান পান না। শিক্ষকদের চাকরিবিধিতেও রয়েছে নানা অসঙ্গতি। পুরো চাকরি জীবনে একটি মাত্র পদোন্নতি অযৌক্তিক, বৈষম্যমূলক ও অসম্মানজনক। পদোন্নতির ক্ষেত্রে দক্ষতা, যোগ্যতা ও উচ্চতর শিক্ষা-গবেষণাকে মূল্যায়ন করা হয় না। আনুপাতিক হারে পদোন্নতি শিক্ষাক্ষেত্রে একটি স্থবির অবস্থার সৃষ্টি করেছে।
বাংলাদেশের আর্থ-সামাজিক বাস্তবতায় মফস্বল এলাকায় প্রতিষ্ঠিত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর বেশিরভাগ অসচ্ছল। এই প্রতিষ্ঠানগুলোতে শিক্ষার্থী সংকট আছে। বেশিরভাগ প্রতিষ্ঠান শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে কোনো বেতন আদায় করতে পারে না। ম্যানেজিং কমিটি, গভর্নিং বডি এমনকি প্রতিষ্ঠান প্রধান যিনি থাকেন তিনিও শিক্ষকদের বেতন বা কোনো ধরনের আর্থিক সুবিধা প্রদানের ক্ষেত্রে যত্নবান নন। নন-এমপিও এসব শিক্ষক এমপিওভুক্তির আশায় বছরের পর বছর বিনা বেতনে শিক্ষকতা করে থাকেন। সরকার মাঝেমধ্যে কয়েকটি প্রতিষ্ঠান এমপিওভুক্ত করেন যা চাহিদার তুলনায় খুবই সামান্য। এমপিওভুক্তির আশায় বিনা বেতনে বছরের পর বছর শিক্ষকতা করা নন-এমপিও শিক্ষকরা বিভিন্ন সময় আন্দোলন করেছেন। নানা কৌশলে, কখনো বলপ্রয়োগ করে তাদের যৌক্তিক আন্দোলন দমন করা হয়েছে। শিক্ষাকে অগ্রাধিকার ও শিক্ষকতা পেশাকে মর্যাদাশীল করে তোলার কথা সবসময়েই বলা হয়। কিন্তু বাস্তবে বাংলাদেশে শিক্ষা খাত কখনো অগ্রাধিকার পায়নি এবং শিক্ষকতা পেশায় মান-মর্যাদা দিন দিন কমেই যাচ্ছে।
গত জুলাই-আগস্টে সংঘটিত গণআন্দোলনের আগে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা ‘প্রত্যয়’ নামক পেনশন স্কিম বাতিলের দাবিতে টানা এক মাস কর্মবিরতি পালন করেছিল। সারা দেশের সব সরকারি বিশ্ববিদ্যালয় সে সময়ে অচল হয়ে পড়েছিল। কিন্তু তৎকালীন সরকার সে আন্দোলনের কোনো গুরুত্বই দেয়নি। শিক্ষকদের কর্মবিরতি চলাকালেই বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন দানা বেঁধে উঠলে সরকার প্রত্যয় স্কিম বাতিল করেছিল।
প্রাথমিক পর্যায় থেকে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত সব স্তরের শিক্ষকদের আন্দোলনের ইতিহাস ও ফলাফল খুব একটা সুখকর নয়। ৫ আগস্ট পরবর্তী সময়ে অন্তর্বর্তী সরকার গঠিত হলে শিক্ষা উপদেষ্টা ম্যানেজিং কমিটি ও গভর্নিং বডির দুর্নীতি ও দৌরাত্ম্য আমলে নিয়ে সব কমিটি বাতিল করেছিল। এতে শিক্ষকরা আশ্বস্ত হয়েছিলেন। কিন্তু পরবর্তী সময়ে সেই কমিটি প্রথা আবার ফিরে এসেছে। কমিটির বিরুদ্ধে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতি আর ক্ষমতার অপব্যবহারের অভিযোগ দীর্ঘদিনের। কিছু বিরল ব্যতিক্রম বাদে রাজনৈতিক বিবেচনায় স্থানীয় অনেক রাজনৈতিক কর্মী কিংবা প্রভাবশালী লোকদের কমিটিতে অন্তর্ভুক্ত হতে দেখা যায়। তাদেরকে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান পরিচালনার দিকে মনোযোগী না হয়ে নিয়োগ-বাণিজ্য ও আর্থিক লাভালাভের দিকেই বেশি মনোযোগী হতে দেখা যায়।
এমপিওভুক্ত প্রতিষ্ঠানের শিক্ষকরা যেহেতু সরকারি কোষাগার থেকে শতভাগ বেতন পেয়ে থাকেন তাই সরকার সরাসরি তাদের নিয়ন্ত্রণ করতে পারে। কোনো ধরনের সুযোগ-সুবিধা না বাড়িয়েও এ নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব। আর একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো এমপিওভুক্ত শিক্ষকদের বদলিব্যবস্থা। বদলির দাবিতে দীর্ঘদিন ধরে শিক্ষক আন্দোলন চলমান আছে। বিষয়টি মনস্তাত্ত্বিক দৃষ্টিকোণ থেকেও দেখা চলে। একই প্রতিষ্ঠানে দীর্ঘদিন চাকরি করার ফলে কেউ প্রভাবশালী হয়ে ওঠেন আবার কেউ নানা বৈষম্যের শিকার হয়ে হতাশাগ্রস্ত হয়ে পড়েন। ফলপ্রসূ শিক্ষার জন্য দুটোই নেতিবাচক।
বদলি বাস্তবায়ন করা হলে এ সমস্যা অনেকটাই দূর হবে। উদ্ভূত পরিস্থিতিতে সরকার প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারবে। শিক্ষার্থীদের বেতন সরকারি কোষাগারে জমা করা হলে সেই অর্থ দিয়েই শিক্ষকদের চাকরি জাতীয়করণ করা সম্ভব- এমন একটি হিসাব শিক্ষক সংগঠনগুলো সরকারের কাছে পেশ করেছে বলে জানা যায়। বিষয়টি আরও বিশ্লেষণ করে শিক্ষার মতো একটি মৌলিক মানবিক অধিকারকে বৈষম্যহীন একটি ব্যবস্থার আওতায় নিয়ে আসার প্রয়োজনীয়তা অস্বীকার করা যায় না।
সর্বস্তরের শিক্ষক নিয়োগ প্রক্রিয়া নিয়ে রয়েছে নানা অভিযোগ। এনটিআরসিএ এন্ট্রি লেবেলে বেসরকারি শিক্ষক নিয়োগের একটি পদ্ধতি চালু করেছে। এ পদ্ধতি প্রতিষ্ঠান প্রধান নিয়োগের ক্ষেত্রেও প্রয়োগ করা উচিত। শিক্ষকদের মধ্য থেকে পদায়নের মাধ্যমেও প্রতিষ্ঠান প্রধান নিয়োগ করা যেতে পারে। এতে দুর্নীতি কমবে এবং যোগ্যদের নির্বাচিত হওয়ার সুযোগ তৈরি হবে। মোটকথা যেকোনো মূল্যে শিক্ষাক্ষেত্রে বিদ্যমান অসঙ্গতি ও বৈষম্য দূর করতে হবে। একসঙ্গে সম্ভব না হলেও বৈষম্য নিরসন করার প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখতে হবে। তা না হলে শিক্ষাব্যবস্থার সার্বিক উন্নয়ন বাধাগ্রস্ত হবে। জুলাই-আগস্টের গণআন্দোলনের পর দেশের মানুষকে যে সাম্য, ন্যায়-নীতি ও মানবিক বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখানো হয়েছে শিক্ষাব্যবস্থার উন্নয়ন ছাড়া সে স্বপ্ন বাস্তবায়ন করা সম্ভব নয়।
সময়ের আলো/এএ/