ই-পেপার মঙ্গলবার ৪ ফেব্রুয়ারি ২০২৫
মঙ্গলবার ৪ ফেব্রুয়ারি ২০২৫
ই-পেপার

মঙ্গলবার ৪ ফেব্রুয়ারি ২০২৫

ব্যাংকে এমডির গুরুত্ব অপরিসীম
প্রকাশ: রবিবার, ২ ফেব্রুয়ারি, ২০২৫, ৯:৩৬ এএম  (ভিজিট : ২১৮)
ব্যাংকে এমডির গুরুত্ব অপরিসীম বেসরকারি মালিকানাধীন ব্যবসা প্রতিষ্ঠান নিয়ে আমাদের সমাজে একটি বদ্ধমূল ধারণা আছে যে এসব প্রতিষ্ঠানে মালিকই সর্বেসর্বা এবং তারাই সবকিছুর হর্তাকর্তা। অর্থাৎ বেসরকারি ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের মালিকরা ইচ্ছামাফিক ব্যবসা প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলবেন এবং ইচ্চামতো সেটি পরিচালনাও করবেন। এ ব্যাপারে তৃতীয় কোনো পক্ষ কিছু বলতে পারবে না। বেসরকারি ব্যবসা প্রতিষ্ঠান সম্পর্কে এ কথাগুলো আংশিক সত্য হলেও পুরোপুরি সত্য নয়। বেসরকারি ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের মালিক নিজেদের ইচ্ছামতো ব্যবসা শুরু করতে পারলেও, এই ব্যবসা পরিচালনার ক্ষেত্রে যা খুশি তা করতে পারেন না। কোন ধরনের ব্যবসা শুরু করবেন, সেই ব্যবসার ঝুঁকি কীভাবে গ্রহণ করবেন এবং কীভাবে কোন কোন উৎস থেকে বিনিয়োগ করবেনÑএসব সিদ্ধান্ত মালিকে নিজে স্বাধীনভাবেই নেবেন। এমনকি কীভাবে ব্যবসা পরিচালনা করবেন এবং কাদের নিয়োগ দেবেন, সেই সিদ্ধান্তও তিনি নিজে স্বাধীনভাবেই নেবেন।

এই স্বাধীনতার সুযোগে এমন কিছু করা যাবে না, যা জনস্বার্থের জন্য ক্ষতিকর। যেমন- একজন ব্যবসায়ী উন্নতমানের সেলুন বা বিউটি সোপের ব্যবসা শুরু করতে পারবেন স্বাধীনভাবে। কিন্তু এ সেলুনের বা বিউটিশিয়ানের কাজে যাকে খুশি তাকে নিয়োগ দিতে পারবেন না। এখানে কাজ করার জন্য তাদেরই নিয়োগ করতে পারবেন, যাদের এ কাজের জন্য ন্যূনতম যোগ্যতা এবং অভিজ্ঞতা আছে। অনেক ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ বা সংস্থার কাছ থেকে সনদপ্রাপ্ত হতে হয়। এটি একটি উদাহরণ মাত্র, যা সব প্রকার ব্যবসা-বাণিজ্যের ক্ষেত্রেই অনুসরণ করা হয়।

ব্যাংক ব্যবসার ক্ষেত্রে বিষয়গুলো আরও কঠোরভাবে মেনে চলতে হয়। কারণ ব্যাংক শুধু জনগণের কাছ থেকে অর্থ নিয়ে ব্যবসাই করে না, সেই সঙ্গে জনগণের অর্থের জিম্মাদারও বটে। তা ছাড়া ব্যাংক এমন একটি বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান, যাকে দেশীয় এবং আন্তর্জাতিক অঙ্গনের একাধিক আইন ও বিধিবিধান মেনে কার্যক্রম পরিচালনা করতে হয়। যেমন- দেশের অভ্যন্তরের বাংলাদেশ ব্যাংক, বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন, রেজিস্টার অব জয়েন্ট স্টক কোম্পানি, স্টক এক্সচেঞ্জ এবং আন্তর্জাতিক অঙ্গনের ইন্টারন্যাশনাল চেম্বার অব কমার্স, ব্যাসেল কমিটিসহ অনেক নিয়ন্ত্রক সংস্থার বিধিবিধান মেনে চলার বাধ্যবাধকতা আছে। তা ছাড়া একটি ব্যাংক বিশ্বের বিভিন্ন দেশের অন্যান্য ব্যাংকের সঙ্গেও লেনদেনে অংশ নিয়ে থাকে। এ জন্যে একটি মানদণ্ড বজায় রাখতে হয়।

প্রতিষ্ঠান হিসেবে ব্যাংক যেমন গুরুত্বপূর্ণ, তেমনি সেই ব্যাংকের প্রধান নির্বাহী বা ম্যানেজিং ডিরেক্টর পদটি অন্য যেকোনো বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানের চেয়ে অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ। কেননা দেশের অর্থনীতি এবং মুদ্রাবাজারে অনেক গুরুদায়িত্ব সঠিকভাবে পালন করার সক্ষমতা অর্জন করতে হয় একটি ব্যাংকের এমডিকে। এ কারণেই একটি ব্যাংকের এমডি হওয়া সহজ কথা নয়। একজন এমডিকে দেশের অর্থনীতি, মুদ্রানীতি এবং এমনকি বিশ্বের অর্থনীতির ও মানি মার্কেটের গতি-প্রকৃতি সম্পর্কে ভালো ধারণা রাখতে হয়। উন্নত বিশ্ব তো বটেই, অনেক উন্নয়নশীল দেশের ব্যাংকের এমডিরা দেশের সরকার এবং অর্থ মন্ত্রণালয়কে সংকটকালে পরামর্শ দিয়ে থাকে। আমাদের দেশের ব্যাংকের প্রধান নির্বাহীরা নিজেদের সে পর্যায়ে নিতে পারেনি। বরং অভিযোগ আছে যে অনেক ব্যাংকার উপযুক্ত যোগ্যতা না থাকা সত্ত্বেও শুধু তোষামোদি করে, বিশেষ করে পরিচালনা পর্ষদের মন জয় করে অনেক উপরের পদে চলে গেছেন, ফলে তারা এখন আর সেভাবে ডেলিভারি করতে পারছে না। এদের মধ্যে অনেকে এমডিও হয়েছেন। এ রকম যে হয়েছে তাতে কোনো সন্দেহ নেই। তবে এর অর্থ এই নয় যে ব্যাংকের এমডি পদের গুরুত্ব কমে গেছে। বরং বর্তমান প্রযুক্তিনির্ভর আর্থিক লেনদেনের জটিলতা বেড়ে যাওয়ায়, ব্যাংকের এই শীর্ষ পদের গুরুত্ব বেড়ে গেছে অনেক বেশি।

এ রকম গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠানের গুরুত্বপূর্ণ পদের নিয়োগ বা পরিবর্তন হতে হবে অত্যন্ত সুপরিকল্পিতভাবে। এখানে যখন ইচ্ছা তখন এবং যাকে খুশি তাকে নিয়োগ দেওয়া বা বিদায় করার সুযোগ নেই। অথচ এ কাজটিই একের পর এক ঘটে চলেছে আমাদের দেশের ব্যাংকিং খাতে। সম্প্রতি একটি বেসরকারি ব্যাংকের এমডি তার চলতি মেয়াদের শেষ দিন যথারীতি অফিস করার পর জানতে পারেন যে তার নিয়োগ নবায়ন হয়নি, ফলে তাকে ব্যাংক থেকে বিদায় নিতে হয়েছে। বছরদুয়েক আগে আরেকটি বেসরকারি ব্যাংকের এমডিকেও সফলভাবে দায়িত্ব পালন শেষে এভাবেই বিদায় নিতে হয়েছিল। কয়েক মাস আগে দেশের ব্যাংকিং খাতের একমাত্র মহিলা এমডিও পুনঃনিয়োগ না পেয়ে শেষ দিন এভাবেই আকস্মিক বিদায় নিয়েছিলেন। ব্যাংকিং খাতে একটা প্রবণতাই হয়ে দাঁড়িয়েছে যে ব্যাংকের বর্তমান এমডিকে একধরনের ধোঁয়াশার মধ্যে রেখে তার এমডি নিয়োগ নবায়নের বিষয়টি শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত ঝুলিয়ে রেখে তাকে বিদায় করা হয়। একটি ব্যাংকের প্রধান নির্বাহীকে এভাবে বিদায় করা কোনোভাবেই পেশাদারিত্বের পর্যায় পরে না এবং এটি ব্যাংকের সুশাসন বা করপোরেট গভার্নেন্সের পরিপন্থী।

ব্যাংকের এমডি পরিবর্তনের ঘটনা একটি মূল্য সংবেদনশীল তথ্য। কেননা একটি ব্যাংকের এমডি পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে সেই ব্যাংকের ব্যবসা এবং বিনিয়োগ কার্যক্রমেরও ব্যাপক পরিবর্তন হতে পারে। একটি ব্যাংকের নন-পারফর্মিং এমডির প্রস্থানের সংবাদে সেই ব্যাংকের আমানতকারীরা তাদের আমানত রাখতে নিরাপদ বোধ করবেন। ব্যবসায়ীরা তাদের ব্যবসা চালিয়ে যেতে আগ্রহী হবেন এবং শেয়ার মার্কেটের বিনিয়গকারীরা বেশি বেশি শেয়ারে বিনিয়োগ করবেন। একইভাবে একটি ব্যাংকের ভালো পারফর্মিং এমডি চলে যাওয়ার খবরে উল্টো ফলাফল হবে। অর্থাৎ ভালো এমডি চলে যাওয়ার খবরে অনেক আমানতকারী তাদের সঞ্চয় উঠিয়ে নিতে চেষ্টা করবে, ব্যবসায়ীরা তাদের ব্যবসা অন্যত্র সরিয়ে নেওয়ার চিন্তা করবে এবং সেই ব্যাংকের শেয়ারহোল্ডাররাও তাদের শেয়ায় বিক্রি করে দিতে চেষ্টা করবে। এ কারণেই একটি ব্যাংকের এমডি পরিবর্তনের সংবাদটি অনেক আগে থেকেই জানানোর বাধ্যবাধকতা থাকে। যে ক্ষেত্রে এমডি নিজে পদত্যাগ করেন, সেটি একটি ভিন্ন প্রেক্ষাপট। তারপরও যথেষ্ট সতর্কতার সঙ্গে বিষয়টি ম্যানেজ করতে হয়। উন্নত বিশ্বে বিষয়টি কঠোরভাবে মেনে চলা হয়। আমাদের দেশে সেই অনুশীলন এখনও শুরু হয়নি। কিন্তু এটা হওয়া প্রয়োজন অনতিবিলম্বে।

একটি ব্যাংকের এমডি নিয়োগ এবং পরিবর্তনের জন্য একটি সুনির্দিষ্ট নীতিমালা থাকা প্রয়োজন। এমডি নিয়োগ এবং অপসারণের ব্যাপারে বাংলাদেশ ব্যাংকের একটা সার্কুলার আছে। কিন্তু সেই সার্কুলারে শুধু এমডি পদে নিয়োগের জন্য ন্যূনতম যোগ্যতা, নিয়োগের মেয়াদ এবং বাংলাদেশ ব্যাংকের অনুমোদনের বিষয় উল্লেখ আছে। এমডির উত্তরসূরি নির্বাচন, যাকে ব্যাংকিং পরিভাষায় এমডির সাকসেশন প্ল্যান বলা হয়ে থাকে, সে রকম কোনো কিছুই বাংলাদেশ ব্যাংকের সেই সার্কুলারে নেই। এ কারণেই ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদ ব্যাংকের এমডিকে চলতি মেয়াদের শেষ দিন পর্যন্ত আশার মধ্যে রেখে বিদায় করার সুযোগ পান। এভাবে একজন এমডিকে বিদায় করা সেই ব্যাংকের জন্যে যেমন ভালো নয়, তেমনি সমগ্র ব্যাংকিং খাতের জন্য ভালো ফল বয়ে আনে না।

প্রত্যেক ব্যাংকের এমডি নিয়োগের ব্যাপারে বিস্তারিত পরিকল্পনা থাকা প্রয়োজন, যেখানে স্পষ্ট করে যে কয়েকটি বিষয় উল্লেখ থাকতে পারে, তা হচ্ছে-

১. একটি ব্যাংকের পরবর্তী এমডি কীভাবে নিয়োগ করা হবে তার বিস্তারিত বিবরণ।

২. ব্যাংকের অভ্যন্তর থেকে উপযুক্ত কাউকে এমডি নির্বাচনকে অগ্রাধিকার দেওয়া।

৩. ব্যাংকের ভেতর থেকে উপযুক্ত কাউকে না পাওয়া গেলে ব্যাংকের বাইরে থেকে এমডি নিয়োগের বিষয়টি অন্তত দুই বছর আগে বাংলাদেশ ব্যাংক এবং বিএসইসিকে জানিয়ে রাখা।

৪. বর্তমান এমডির নিয়োগ নবায়ন না করার বিষয়। যদি বর্তমান এমডির নিয়োগ নবায়ন করার সুযোগ না থাকে, তা হলে বিষয়টি অন্তত ৬ মাস আগে বাংলাদেশ ব্যাংক এবং বিএসইসিকে জানিয়ে রাখতে হবে। এই ৬ মাস আগেই বর্তমান এমডির স্থলাভিষিক্ত কে হবেন সেটিও চূড়ান্ত করে ফেলতে হবে। অর্থাৎ বর্তমান এমডির নিয়োগ নবায়ন করা না হলে, নতুন এমডি নিয়োগের কাজটিও সম্পন্ন করতে হবে ৬ মাস আগেই। এই ৬ মাস হচ্ছে এমডির ট্রানজিশন সময়, যখন নতুন এমডি বিদায়ি এমডির সঙ্গে সম্পৃক্ত থেকে সঠিকভাবে তার দায়িত্বভার বুঝে নেবেন। এভাবে দায়িত্বভার বুঝে নেওয়ার সুযোগ থাকলে, তখন আর ব্যাংকের এমডিরা তাদের ব্যর্থতার দায়ভার আগের এমডির ওপর চাপাতে পারবেন না, যেটি আমাদের দেশে খুবই সাধারণ প্রবণতা। অনেকে ভাবতে পারেন যে ব্যাংকের এমডি নিয়োগে এসব বিধিবিধান মেনে চলতে হলে দেশের ব্যাংক কোম্পানি আইন পরিবর্তন করার প্রয়োজন হতে পারে। আমার তেমনটা মনে হয় না। কেননা ব্যাংকের এমডি নিয়োগের ব্যাপারে বাংলাদেশ ব্যাংকের যে সার্কুলার আছে, সেটিকে পরিবর্তন করে সেখানে এসব বিষয় অন্তর্ভুক্ত করলেই সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে। এসব বিধিবিধান মেনে চলতে দেশের সব ব্যাংক এবং আর্থিক প্রতিষ্ঠানকে বাধ্য করতে পারলেই, ব্যাংকে এমডি নিয়োগের ক্ষেত্রে একটি মানসম্পন্ন পদ্ধতির অনুসরণ নিশ্চিত করা সম্ভব হবে। তারপরও যদি কোনো আইন, বিশেষ করে ব্যাংক কোম্পানি আইন সংশোধনের প্রয়োজন হয়, তা হলে সেটি করতে হবে।

মোটকথা ব্যাংকের এমডি নিয়োগের ক্ষেত্রে ইন্ডাস্ট্রিব্যাপী সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা থাকা প্রয়োজন, যা প্রতিটি ব্যাংক মেনে চলবে। কেননা ব্যাংক পরিচালনার ক্ষেত্রে এমডি বা প্রধান নির্বাহীর গুরুত্ব সবচেয়ে বেশি। এ ব্যাপারে বাংলাদেশ ব্যাংক এবং অর্থ মন্ত্রণালয় যথাযথ পদক্ষেপ নেবে বলেই আমাদের প্রত্যাশা।


সময়ের আলো/এএ/




https://www.shomoyeralo.com/ad/1698385080Google-News-Update.jpg

সর্বশেষ সংবাদ

সর্বাধিক পঠিত


ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক : সৈয়দ শাহনেওয়াজ করিম, আমিন মোহাম্মদ মিডিয়া কমিউনিকেশন লিমিটেড এর পক্ষে প্রকাশক গাজী আহমেদ উল্লাহ। নাসির ট্রেড সেন্টার, ৮৯, বীর উত্তম সি আর দত্ত সড়ক (সোনারগাঁও রোড), বাংলামোটর, ঢাকা।
ফোন : +৮৮-০২-৯৬৩২৩৬৮-৭৪, ফ্যাক্স : +৮৮-০২-৯৬৩২৩৭৫ | ই-মেইল : shomoyeralo@gmail.com
close