পতিত স্বৈরাচার শেখ হাসিনার এক সময়ের প্রটোকল অফিসার ও শেখ রেহানার ‘ফান্ড ম্যানেজার’ হিসেবে খ্যাত ফেনী-১ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য আলাউদ্দিন আহমেদ চৌধুরী নাসিম আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে হাজার হাজার কোটি টাকার অবৈধ সম্পদ অর্জন করেছেন। বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতসহ মাদক ব্যবসা, নিয়োগ ও বদলি বাণিজ্য, টেন্ডারবাজি, ঘুষ-চাঁদাবাজির মাধ্যমে এ অবৈধ সম্পদ অর্জন করেন তিনি। কানাডাসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে অর্থ পাচার করেছেন এই সাবেক উচ্চপদস্থ সরকারি কর্মকর্তা ও সংসদ সদস্য। নাসিমের হাত ধরেই পরিচালিত হতো দেশের বেসরকারি বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাত।
তার নানা অপকর্ম ও দুর্নীতির খবর প্রচারিত হওয়ায় নড়েচড়ে বসেছে দুর্নীতি দমন কমিশন-দুদক। অনিয়ম ও দুর্নীতির মাধ্যমে বিপুল অবৈধ সম্পদ অর্জন করায় ২ অক্টোবর তার বিরুদ্ধে অনুসন্ধানের সিদ্ধান্ত নেয় দুদক। ফেনী-১ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য আলাউদ্দিন আহমেদ চৌধুরী নাসিমকে ও তাদের পরিবারের বিরুদ্ধে বিদেশ যাত্রায় নিষেধাজ্ঞা দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)।
এ বিষয়ে দুর্নীতি দমন কমিশন নোয়াখালী সমন্বিত জেলা কার্যালয়ের উপপরিচালক মো. ফারুক আহমেদ বলেন, আমরা ফেনী-১ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য আলাউদ্দিন আহমেদ চৌধুরী নাসিমের সম্পদের অনুসন্ধান করছি। তার অনেক সম্পদের তথ্য পাচ্ছি। আমরা তার বিষয়ে সার্বিকভাবে খোঁজখবর নিচ্ছি। আগামী ১ মাসের মধ্যে আমরা চূড়ান্ত প্রতিবেদন দাখিল করব। সূত্রমতে, নাসিম ও তার পরিবারের সদস্যদের দেশ-বিদেশে নামে-বেনামে রয়েছে হাজার কোটি টাকার অর্থ-সম্পদ। এ ছাড়া কানাডায় রয়েছে বাড়ি-গাড়ি। নাসিমের হাত ধরে দেশে গত দেড় দশকে বিদ্যুৎ খাতে লুটপাটের মহোৎসব চলেছে। শেখ হাসিনার ঘনিষ্ঠজন হওয়ায় বিনা পুঁজিতে ব্যবসায়িক পার্টনার হয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদনকেন্দ্রের প্রকল্প থেকে বিদেশে পাচার করেছেন হাজার হাজার কোটি টাকা। ডাচ্-বাংলা পাওয়ার অ্যান্ড অ্যাসোসিয়েটস লিমিটেডের ৩০ শতাংশ শেয়ারের মালিক ফেনী-১ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য আলাউদ্দিন আহমেদ চৌধুরী নাসিম। শুধু বিদ্যুৎ প্রকল্পের নামেই বিভিন্ন ব্যাংক থেকে শত শত কোটি টাকা লোন নিয়ে বিদেশে পাচার করেন তিনি। জালিয়াতি ও মিথ্যা তথ্য দিয়ে ঋণ নেওয়ারও অভিযোগ রয়েছে তার বিরুদ্ধে। তাকে ২০ পার্সেন্ট কমিশন না দিলে কোনো টেন্ডারই পেতেন না ব্যবসায়ীরা। প্রকল্পের কাজ শুরুর আগেই তিনি বুঝে নিতেন তার কমিশনের টাকা।
প্রভাবশালী এই সাবেক এমপিকে ব্যবসায়িক পার্টনার বানিয়ে কোনোরকম টেন্ডার বা প্রতিযোগিতা ছাড়াই সরকারের কাছ থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদনের বড় বড় প্রকল্প বাগিয়ে নেন এক আলোচিত ব্যবসায়ী। তাকে বলা হয় দেশের অন্যতম মাদক ব্যবসায়ী। ঢাকার অভিজাত গুলশান এলাকায় রয়েছে তার মদের গুদাম, যা সবচেয়ে বড় মদের গুদাম। ঢাকার বিভিন্ন ক্লাব থেকে সদস্যদের জন্য কম দামে কেনা মদ তিনি বেশি দামে বিক্রি করেন বলে অভিযোগ রয়েছে।
ফেনীর মহিপালে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের কর্মসূচিতে গুলি করে ১৩ জনকে হত্যার ঘটনায় দায়ের করা মামলার অন্যতম আসামি। ভিডিওটি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভাইরাল হওয়ার পর ফেনীজুড়ে প্রশ্ন উঠেছে নাসিম এখন কোথায়? ফেনীতে নাসিমের নামে তিনটি হত্যা মামলা হয়েছে। আলাউদ্দিন নাসিমের নির্দেশেই ফেনীতে ছাত্র-জনতাকে গুলিতে হত্যা করা হয়। অভিযোগ রয়েছে, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন চলাকালে আলাউদ্দিন আহমেদ চৌধুরী নাসিমের নির্দেশে জুলাই ও আগস্ট মাসে ফেনী, কুমিল্লা ও নোয়াখালীতে চলে ছাত্র হত্যা।
মেয়ে রাকা চৌধুরী এখনও কানাডায় অবস্থান করছেন। এমপি হওয়ার আগেও তিনি পরিবার নিয়ে প্রায়ই কানাডায় থাকতেন। তিনি কয়েক হাজার কোটি টাকা বিদেশে পাচার করেছেন বলে অভিযোগ করা হয়েছে। এ ছাড়া আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে সচিবালয়ের বিভিন্ন দফতরে কাজ পাইয়ে দেওয়ার কথা বলে ২০ পার্সেন্ট কমিশন নিতেন আলাউদ্দিন আহমেদ।
এ ছাড়া তার বিরুদ্ধে অভিযোগ, ফেনী বিশ্ববিদ্যালয়ের আশপাশের মানুষের কৃষিজমি জিম্মি করে কাউকে দিয়েছেন স্বল্পমূল্যে, আবার কেউ জমি লিখে দিতে না চাইলে সেই জমি তিনি দখল করে নিয়েছেন। ২০ বিঘা জমির ওপরে গড়ে তোলা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পুকুর রয়েছে চারটি। ফেনীর পরশুরামে ৩০ একর জায়গায় ২০১৭ সালে প্রতিষ্ঠা করা হয় আলাউদ্দিন আহমেদ চৌধুরী নাসিম কলেজ।
স্থানীয়দের অভিযোগ, জোরপূর্বক ও ভয় দেখিয়ে নামমাত্র মূল্য পরিশোধ করে কলেজের জন্য কৃষিজমির জায়গা দখল করে নেওয়া হয়। এবার ফেনী-১ আসন থেকে সংসদ সদস্য হয়ে মনোনয়ন বাণিজ্য করে ছাগলনাইয়া, ফুলগাজী ও পরশুরামে তার অনুসারীদের দিয়ে নানা কায়দা-কৌশল করে নির্বাচনের মাধ্যমে উপজেলা চেয়ারম্যান বানান। এ ছাড়া নির্বাচনি এলাকার বাইরেও অন্যান্য উপজেলায়ও তার অনুসারীদের চেয়ারম্যান বানান।
২০০৯ সালে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে সরকার গঠনের পর কোনো পদে না থেকেও জনপ্রশাসনে পদোন্নতি ও পদায়নের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠেন নাসিম। শেখ হাসিনার সাবেক প্রটোকল অফিসার আলাউদ্দিন নাসিম দেশটিকে বানিয়েছিলেন অনিয়ম ও দুর্নীতির ‘স্বর্গরাজ্য’। মিস্টার টোয়েন্টি পার্সেন্ট হিসেবে খ্যাতি অর্জন করেছিলেন দেশব্যাপী। তাকে ২০ পার্সেন্ট কমিশন না দিলে কোনো টেন্ডারই পেত না ব্যবসায়ীরা। প্রকল্পের কাজ শুরুর আগেই তিনি বুঝে নিতেন তার কমিশনের টাকা। বিভিন্ন সময় দুর্নীতির কারণে অনেকেই ধরা পড়লেও সবসময় অন্তরালে থেকে যেতেন দুর্নীতির বরপুত্র-খ্যাত আলাউদ্দিন নাসিম। শেখ হাসিনা ও রেহানার ম্যানেজার হিসেবে ছিলেন বহাল তবিয়তে।
সময়ের আলো/আরএস/