নিঝুম রাত। শীতল বাতাস বইছে। শিশিরে ভিজে আছে টঙ্গীর ঘরবাড়ি, গাছপালা ও জমিন। ভিজে আছে চটের ধূসর শামিয়ানা। রাত তখন ৪টা পার হয়েছে। সকালের স্টেশনের পথে ধাবমান শেষ রাতের ট্রেন। ইজতেমার মাইকে ধ্বনিত হলো আল্লাহর প্রশংসা-‘আলহামদুলিল্লাহ’।
এ প্রশংসা রাতের নির্জনতায় ভর করে পৌঁছাল খোদার আরশে। আল্লাহপ্রেমীরা জেগে উঠেছে আপন মালিকের কুদরতি পায়ে চুমো খেতে। তাহাজ্জুদের এ নামাজে বান্দা চলে যায় আল্লাহর কাছাকাছি। পবিত্র আজানের ধ্বনি সুর তুলল টঙ্গীর বিস্তীর্ণ ময়দানে। যেখানে ইজতেমা উপলক্ষে জমায়েত হয়েছেন লাখো ধর্মপ্রাণ মানুষ।
ঐতিহাসিক বিদায় হজের ভাষণে রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর ঘোষণা-উপস্থিতরা যেন এই বার্তাগুলো অনুপস্থিত লোকদের কাছে পৌঁছে দেয়; এ আহ্বানে সাড়া দিয়ে সাহাবায়ে কেরাম পৃথিবীর দিক-দিগন্তে ইসলামের বাণী নিয়ে ছড়িয়ে পড়েন। তারা পেছনে ফিরে তাকাননি। তাদের একনিষ্ঠ প্রচেষ্টা, মেহনত ও কষ্টের বিনিময়ে পৃথিবীর শহর-নগর, পাড়া-মহল্লায় পৌঁছেছে ইসলামের কথা। ইসলামের পবিত্র আলোয় আলোকিত হয়েছে ভুলপথে চলা মানুষের জীবন। মানুষের কাছে ইসলামের কথা পৌঁছে দেওয়া ছিল সাহাবিদের দাওয়াতি কার্যক্রম-দাওয়াত ও তাবলিগ। পৃথিবীর সব নবী-রাসুলের উম্মতদের মাঝে রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর উম্মতরাই এই দাওয়াতি কাজের গৌরব অর্জন করেন। এর সূচনা হয়েছিল সাহাবিদের মাধ্যমে। মানুষকে আল্লাহর পথে আহ্বান করাই হলো দাওয়াত ও তাবলিগ।
মানুষের কাছে ইসলামের সুমহান বাণী পৌঁছে দিতে নবী ও সাহাবিদের আদর্শ বুকে লালন করে ভারতের মাওলানা ইলিয়াস (রহ.) ১৯২৬ সালে দাওয়াত ও তাবলিগের কাজ শুরু করেন। প্রথমে নিজ এলাকার কয়েকজন দিনমজুরকে নিয়ে শুরু করেছিলেন।
সেসময় এলাকাভিত্তিক সম্মেলন বা ইজতেমার আয়োজন করেন। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এ কাজ বিস্তার লাভ করে ভারত উপমহাদেশে। উপমহাদেশের বাইরেও এর প্রভাব পড়ে। ১৯৪৭ সালে ভারত ভাগ হলে ভারত, পশ্চিম পাকিস্তান ও পূর্ব পাকিস্তান-এ তিন অঞ্চলে তাবলিগের তিনটি কেন্দ্র গড়ে ওঠে। ইলিয়াস (রহ.)-এর একনিষ্ঠ আত্মত্যাগ ও কঠোর সাধনার বদৌলতে আজ পৃথিবীর নানা প্রান্তে দাওয়াত ও তাবলিগ ছড়িয়ে পড়েছে। পথহারা মানুষ সঠিক পথ খুঁজে পাচ্ছে। অন্ধকার জগৎ থেকে আলোর দিকে ফিরে আসছে। বিপন্ন জীবনে ঠাঁই পাচ্ছে আদর্শ। চিরায়ত সত্য ইসলাম ধর্মে দীক্ষিত হচ্ছে অমুসলিমরা।
তখন ১৯৪৬ সাল। ঢাকার রমনা পার্ক সংলগ্ন কাকরাইল মসজিদ থেকে সূচনা হয় তাবলিগের। সে বছর মাওলানা আবদুল আজিজ (রহ.) তাবলিগের বার্ষিক সম্মেলন বা ইজতেমা করেন। দুই বছর পর ১৯৪৮ সালে চট্টগ্রামের তৎকালীন হাজিক্যাম্পে ইজতেমা করা হয়। এর ১০ বছর পর ১৯৫৮ সালে ইজতেমা করা হয় নারায়ণগঞ্জের সিদ্ধিরগঞ্জে। লোকে সেসময় এ জমায়েতকে ইজতেমা বলত। এদিকে তাবলিগের প্রচার-প্রসার বাড়তে থাকে। তাবলিগে লোকজনের অংশগ্রহণও বাড়তে থাকে। ফলে ১৯৬৬ সালে ইজতেমা হয় টঙ্গীর মনসুর জুট মিলের কাছে। এর পরের বছর থেকে প্রতি বছরই ‘কহর দরিয়া’ খ্যাত তুরাগ নদীর উত্তর পূর্ব তীর সংলগ্ন ডোবা-নালা, উঁচু-নিচু জমি মিলিয়ে রাজউকের হুকুমদখলকৃত ১৬০ একর জায়গার বিশাল মাঠে করা হয় ইজতেমা।
তাবলিগের ধারণা ও কার্যক্রম ভারতে শুরু হলেও ভারত ভাগের পর ইজতেমা হতো পূর্ব পাকিস্তানে। কিন্তু বাংলাদেশ স্বাধীনতার পর এটি বাংলাদেশেই স্থায়ী হলো। কারণ বাংলাদেশের ভিসা পাওয়া সহজ ছিল সেসময়। কেউ ভিসার আবেদন করলে ফেরত যেত না। বাংলাদেশের সব সরকার এই ইজতেমাকে সমর্থন করেছে, পৃষ্ঠপোষকতা করেছে। বিদেশিদের আসতে খরচও কম পড়ে। কম খরচে সহজ জীবনযাপন করা যায়। এভাবেই স্থায়ী হলো বাংলাদেশে বিশ্ব ইজতেমা।
বিশ্ব ইজতেমা মুসলমানদের দ্বিতীয় বৃহত্তম মিলনমেলা। হজের পর এটিই বড় জমায়েত। এখানে ধনী-গরিবের মধ্যে কোনো তফাত নেই। ভেদাভেদ নেই ছোট-বড়র। এখানে সবাইকে এক পথে চলতে হয়। এক কাতারে হাঁটতে হয়, দাঁড়াতে হয় কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে। খোলা আকাশের নিচে, শীতের শিশিরভেজা রাতে মাটির ওপর ঘুমাতে হয়।
এখানে আসা মানুষের অন্তরে থাকে মুসলিম উম্মাহর ফিকির, মুখে জিকির।
লেখক :সাংবাদিক ও প্রাবন্ধিক