ই-পেপার মঙ্গলবার ৪ ফেব্রুয়ারি ২০২৫
মঙ্গলবার ৪ ফেব্রুয়ারি ২০২৫
ই-পেপার

মঙ্গলবার ৪ ফেব্রুয়ারি ২০২৫

বাংলা একাডেমি এবং বিবিধ প্রসঙ্গ
প্রকাশ: শুক্রবার, ৩১ জানুয়ারি, ২০২৫, ১:০৪ এএম  (ভিজিট : ২৩৮)
বাঙালি জাতিসত্তা ও বুদ্ধিবৃত্তিক উৎকর্ষের প্রতীক বাংলা একাডেমি। তবে দৃশ্যমান এই যে, প্রতি বছর অমর একুশে বইমেলার আয়োজন করে বাঙালির আবেগের সঙ্গে মিশে আছে প্রতিষ্ঠানটি। এ ছাড়া সাহিত্য পুরস্কার প্রদান করে লেখকদের সম্মান জানিয়ে আসছে বরাবরই। 

এ দুটি বিষয়ে লেখক, পাঠক এবং প্রকাশকদের দৃষ্টি থাকে একাডেমির দিকে। কম-বেশি আলোচনা-সমালোচনা হয় এসব নিয়ে। সম্প্রতি আলোচনার আগুনে পারদ ঢেলে দিয়েছে সাহিত্য পুরস্কার। তবে ৫ আগস্টের পর পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে সব জল্পনা-কল্পনার অবসান ঘটিয়ে আয়োজিত হতে যাচ্ছে অমর একুশে বইমেলা। এর বাইরে তরুণ লেখক প্রকল্প এবং বাংলা একাডেমির সদস্য অন্তর্ভুক্তি নিয়ে লেখকদের মধ্যে চাপা কষ্ট বিরাজ করছে। পরিবর্তিত বাংলাদেশে প্রতিষ্ঠানটি কি যথাযথ সংস্কারের মধ্য দিয়ে এ টানাপড়েন সমাধান করতে পারবে? সেই আশায় তাকিয়ে আছেন অনেক লেখক ও বুদ্ধিজীবী।
বইমেলা আমাদের প্রাণের উৎসব। বাংলাদেশি লেখক-প্রকাশক-পাঠকের মিলনমেলা। আমাদের আবেগ ও ভালোবাসার উৎসব। বরাবরের মতোই ১ ফেব্রুয়ারি শুরু হতে যাওয়া এই মেলা সব বৈষম্য নিরসন করবে বলে আমার বিশ্বাস। যেহেতু এবার স্টলের সংখ্যা বেড়েছে। আশা করি পাঠকের সংখ্যাও বাড়বে। বিগত দিনের রেকর্ড ছাড়িয়ে এবার সর্বোচ্চ বই বিক্রি হবে। গণঅভ্যুত্থান পরবর্তী এই বইমেলা অনেকটা চ্যালেঞ্জিও বলা চলে। তাই পর্যাপ্ত নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে। শতভাগ ধুলামুক্ত করতে হবে বইমেলা প্রাঙ্গণ। মেলার অভ্যন্তরীণ খাবারের দাম নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। প্রবেশ এবং বের হওয়ার পথ বাড়াতে হবে। ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশন চত্বর, টিএসসি এবং দোয়েল চত্বরের দিকটা উন্মুক্ত রাখা জরুরি।

পরিবর্তিত বাংলাদেশে বইমেলা আমাদের অনেক প্রত্যাশার বাতিঘর। আয়োজকদের তাই সজাগ দৃষ্টি রাখতে হবে। কোনো ধরনের নাশকতা যেন বইমেলার পরিবেশকে বিঘ্নিত করতে না পারে। একটি সফল ও সার্থক বইমেলা উপহার দিয়ে বাংলা একাডেমি তার দায়িত্বশীল ভূমিকা উপস্থাপন করবে-এমন প্রত্যাশা থাকল। ‘যে জাতি যত শিক্ষিত; সে জাতি তত উন্নত’-এ সেøাগানকে ধারণ করে পাঠকের হাতে হাতে পৌঁছে যাক বই। প্রত্যেক দর্শনার্থী অন্তত একটি করে বই কিনলে লেখক-প্রকাশকদের শ্রম সার্থক হবে। ভালো মানের বই প্রকাশের গুরুত্বও বৃদ্ধি পাবে। মানহীন বইকে বর্জন করে পাঠক যেন মানোত্তীর্ণ বইটি খুঁজে নিতে পারে। মেলা শেষে বই বিক্রির হিসাব যেন অন্য বছরকে ছাড়িয়ে যায়।
অন্যদিকে দেশের সর্বোচ্চ পুরস্কারের মধ্যে ‘বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার’ তৃতীয় অবস্থানে রয়েছে। ফলে কবি-সাহিত্যিকদের মধ্যে এ পুরস্কার নিয়ে আগ্রহ কম নয়। প্রতি বছর একটা সময় এসে বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার কারা পাচ্ছেন, এ নিয়ে জল্পনা-কল্পনা শুরু হয়ে যায়। এমনকি পুরস্কার ঘোষণা হওয়ার পর আলোচনা-সমালোচনাও কম হয় না। আয়োজক কমিটির গোষ্ঠী উদ্ধার করা হয়। পুরস্কারপ্রাপ্তকে এমনভাবে আক্রমণ করা হয় যে, তিনি এটি পেয়ে খুবই অপরাধ করে ফেলেছেন। এবার যেন একটু বেশিই জল ঘোলা হয়ে গেছে। পুরস্কার ঘোষণা করে সমালোচনার মুখে তা স্থগিত করতে হয়েছে। এমনকি বিক্ষুব্ধ কবি-লেখকরা বাংলা একাডেমি ঘেরাও কর্মসূচি দিয়ে সংস্কারের দাবি তুলেছেন।

বাংলা একাডেমি এর আগে হয়তো এমন বড় ধরনের সমালোচনার মুখোমুখি হয়নি। তবে সবসময়ই রাজনৈতিক প্রভাব কিছুটা থেকেই যায়। কেননা সরকার পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে চেতনা-আদর্শ দ্বারা প্রভাবিত হওয়ার সুযোগ তৈরি হয়। কখনো কখনো এসব আলোচনা-সমালোচনা ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের ওপরও প্রভাব বিস্তার করে। ফলে অনেক সময় পুরস্কার ঘোষণা দিয়েও ফিরিয়ে নিতে হয়। এমন ঘটনাও আমাদের দেশে একাধিকবার ঘটেছে। সে ক্ষেত্রে আয়োজকদেরই দায়ী করে থাকেন সাহিত্যবোদ্ধারা। তারা মনে করেন, পুরস্কার ঘোষণা দেওয়ার আগে অন্তত যাচাই-বাছাই করে দেওয়া উচিত ছিল। তা হলে আর এ ধরনের বিড়ম্বনায় পড়তে হতো না। তার চেয়ে পুরস্কার ঘোষণা না করাই বুদ্ধিমানের কাজ হতো। কেননা আমরা জানি, ১৯৮৫ এবং ২০০০ সালেও কোনো পুরস্কার দেওয়া হয়নি। পরিস্থিতি বিবেচনা করেই এমন সিদ্ধান্ত নেওয়া জরুরি ছিল।

এবার একটু অন্যদিকে দৃষ্টি দিতে চাই। বিষয়টি নিয়ে আলোচনা একটু কমই হয়। আর তা হলো-বাংলা একাডেমির সদস্য হিসেবে অন্তর্ভুক্ত হওয়া। আমরা জানি, ‘বাংলা একাডেমি আইন ২০১৩-এর ৮ ধারা অনুযায়ী (১) ভাষা, সাহিত্য, সংস্কৃতি, বিজ্ঞান, শিল্পকলা, সাংবাদিকতা, সামাজিক বিজ্ঞান অথবা জ্ঞানের বিশেষ ক্ষেত্রে বিশেষ অবদান রহিয়াছে এবং যাহার বয়স কমপক্ষে ৩০ (ত্রিশ) বৎসর পূর্ণ 
হইয়াছে, এইরূপ বাংলাদেশের কোনো নাগরিক নির্ধারিত পদ্ধতিতে একাডেমির জীবন সদস্য ও সদস্যপদ লাভ করিতে বা অব্যাহতি গ্রহণ করিতে পারিবেন। (২) এক খ্রিষ্টীয় বৎসরে সর্বোচ্চ ২১ (একুশ) জন ব্যক্তিকে সদস্য করা যাইবে: তবে শর্ত থাকে যে, প্রতি তিন খ্রিষ্টীয় বৎসরে সদস্যের সংখ্যা, উক্ত তিন বৎসর কাল শুরু হইবার পূর্বে মোট সদস্য সংখ্যা যাহা ছিল, উহা হইতে ৫ (পাঁচ) শতাংশের অধিক বৃদ্ধি করা যাইবে না। (৩) কোনো সদস্যের সদস্যপদ কোনো কারণে বাতিল হইলে, সদস্যপদ হইতে অব্যাহতি গ্রহণ বা সদস্যপদ হইতে পদত্যাগ করিলে তিনি পুনর্বার সদস্য হইতে পারিবেন না।’

এখন কথা হচ্ছে-প্রতি বছর যে ২১ জনকে সদস্য করা হবে, তার বিপরীতে আবেদন জমা পড়ে আছে হাজারেরও বেশি। ফলে অনেক লেখক আবেদন করেও সদস্য হওয়ার আগেই বার্ধক্যজনিত কারণে পৃথিবী ছেড়ে চলে গেছেন। এ বিষয়ে তরুণদের মনেও ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ লক্ষ করা গেছে। ত্রিশ বছর পার করেও তারা সদস্য হতে পারছেন না। তারা এ-ও দাবি তুলছেন যে, অন্তত সদস্য সংখ্যা ৭১ করা হোক। তাতেও কিছুটা জট কমানো সম্ভব হবে। তবে আরেকটি বিষয় ভেবে দেখা যেতে পারে যে, সদস্যপ্রাপ্তির পর যারা মারা গেছেন, তাদের শূন্যপদ হিসাব করেও নতুন সদস্য অন্তর্ভুক্ত করা যেতে পারে। প্রয়োজনে আইন সংশোধন করে সদস্য সংখ্যা বাড়ানো এখন সময়ের দাবি। পরিস্থিতি বিবেচনা করে সিদ্ধান্ত নেওয়ার সময় এসে গেছে।

বাংলা একাডেমি লেখকদের আশা-আকাংখার প্রতীক। যদিও বাংলা একাডেমি হলো বাংলাদেশের ভাষানিয়ন্ত্রক সংস্থা। এটি ১৯৫৫ সালের ৩ ডিসেম্বর প্রতিষ্ঠিত হয়। বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের চর্চা, গবেষণা ও প্রচারের লক্ষ্যে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে একাডেমিটি প্রতিষ্ঠা করা হয়। রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন-পরবর্তী প্রেক্ষাপটে বাংলা একাডেমি প্রতিষ্ঠার দাবি ওঠে। তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রীর সরকারি বাসভবন বর্ধমান হাউসে একাডেমির সদর দফতর স্থাপিত হয়। একাডেমির বর্ধমান হাউসে একটি ‘ভাষা আন্দোলন জাদুঘর’ আছে। তবে এই জাদুঘরের কার্যক্রম কতটা গতিশীল, তা নিয়েও প্রশ্ন উঠতে পারে। এই জাদুঘর নিয়ে তেমন প্রচার-প্রচারণাও নেই। বইমেলার এক মাস অন্তত বিষয়টি নিয়ে ব্যাপকভাবে কাজ করার সুযোগ আছে।

মূলত বানান সংস্কার, অমর একুশে বইমেলা আর সাহিত্য পুরস্কারের মধ্যেই সীমাবদ্ধ হয়ে আছে বাংলা একাডেমি। কয়েকটি পত্রিকা প্রকাশ হলেও তাতে কারা লেখেন, কারা পড়েন; তা জানেন না অনেকেই। কারণ পত্রিকাগুলো বাজারে সহজলভ্য নয়। গ্রহণযোগ্যতাও পায়নি তেমন। এ ছাড়া ডিজিটাল বাংলাদেশেও সোশ্যাল মিডিয়ায় তাদের কার্যক্রম খুব কমই চোখে পড়ে। ওয়েবসাইটেও আপডেট মেলে কম। অন্যদিকে অনুবাদ সাহিত্য এবং গবেষণার ক্ষেত্রেও অনেক পিছিয়ে প্রতিষ্ঠানটি। প্রত্যেক সরকারের আমলে দলীয় গুণকীর্তনই মুখ্য হয়ে ওঠে। দলীয় প্রভাব এই প্রতিষ্ঠানটিকে বরাবরই অকার্যকর করে রাখতে চেষ্টা করে। যে কারণে একটি স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান হিসেবে স্বকীয়তা বজায় রাখতে বরাবরই ব্যর্থ হয়েছে। 

বহু বছর পর তরুণ লেখক প্রকল্প চালু হলেও তড়িঘড়ি করে এক সেশন শেষ করেই মুখ থুবড়ে পড়েছে প্রকল্পটি। তরুণদের বই প্রকাশেও কোনো উদ্যোগ নিতে পারেনি। প্রশিক্ষণার্থী বাছাইয়ের ক্ষেত্রেও অভিযোগ রয়েছে। ফলে সমালোচনা যেন পিছুই ছাড়ছে না প্রতিষ্ঠানটির।

এত এত ব্যর্থতা সত্ত্বেও লেখকদের আশার আলো দেখাতে পারে প্রতিষ্ঠানটি। দরকার শুধু কর্তৃপক্ষের একটু সদিচ্ছা। সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়, বাংলা একাডেমির সভাপতি এবং মহাপরিচালক চাইলে সুন্দর সাবলীল করে সাজাতে পারেন প্রতিষ্ঠানটিকে। এই মুহূর্তে আমূল সংস্কার করাও সম্ভব। রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত করাও কঠিন কিছু নয়। 

তাতে কবি-লেখকদের অবশ্যই সমর্থন থাকবে। শুধু পুরস্কার প্রদান আর অভিধান বিক্রি করেই দায়িত্ব শেষ করা সমীচীন নয়। তাই লেখক হিসেবে বাংলা একাডেমি এবং বইমেলার সর্বাঙ্গীন মঙ্গল কামনা করছি। দল-মত নির্বিশেষে সবার অংশগ্রহণে জমজমাট হয়ে উঠুক প্রিয় বইমেলা। মাসজুড়ে সম্প্রীতির আবহ বিরাজ করুক মেলা প্রাঙ্গণে। সবার অংশগ্রহণে নতুনভাবে যাত্রা শুরু করুক আমাদের প্রাণপ্রিয় প্রতিষ্ঠানটি। আপন আলোয় প্রাণ ফিরে পাক বাঙালি জাতিসত্তা ও বুদ্ধিবৃত্তিক উৎকর্ষের প্রতীক 
বাংলা একাডেমি।

প্রাবন্ধিক

সময়ের আলো/আরএস/




https://www.shomoyeralo.com/ad/1698385080Google-News-Update.jpg

সর্বশেষ সংবাদ

সর্বাধিক পঠিত


ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক : সৈয়দ শাহনেওয়াজ করিম, আমিন মোহাম্মদ মিডিয়া কমিউনিকেশন লিমিটেড এর পক্ষে প্রকাশক গাজী আহমেদ উল্লাহ। নাসির ট্রেড সেন্টার, ৮৯, বীর উত্তম সি আর দত্ত সড়ক (সোনারগাঁও রোড), বাংলামোটর, ঢাকা।
ফোন : +৮৮-০২-৯৬৩২৩৬৮-৭৪, ফ্যাক্স : +৮৮-০২-৯৬৩২৩৭৫ | ই-মেইল : shomoyeralo@gmail.com
close