বিশ্ব ইজতেমা দ্বীনের এক ঐতিহাসিক ও আধ্যাত্মিক আয়োজন। পথভোলা মানুষকে পথের দিশা দিতেই লাখো মানুষ এ পথে পা বাড়ান। নিজ খরচে আল্লাহ-ভোলাদের আল্লাহর পথে আনার চেষ্টা করেন। কালেমা, নামাজ, ইলিম ও জিকির, ইকরামুল মুসলিমিন, তাসহিয়ে নিয়ত, দাওয়াত-তাবলিগের ওপর ভিত্তি করে মেহনত করেন তারা। ১৯৬৬ সালে বাংলাদেশে শুরু হয় এ মহতি আয়োজন। সে সময় থেকেই দেশের অর্থনীতিতে এর প্রভাব লক্ষণীয়। শুধু গেল বছরেই ৬১ দেশের ৭ হাজার ৮৮৬ মেহমান অংশ নিয়েছেন বিশ্বের বৃহত্তর এ জমায়েতে।
প্রতি বছরই বিশ্ব ইজতেমার মাধ্যমে দেশের অর্থনীতিতে উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন আসে। লাখ লাখ বিদেশি মেহমানের আগমনে বিভিন্ন খাতে অর্থনৈতিক প্রবাহ সৃষ্টি করে। নিত্যপণ্যের বাজারে উন্নতি এনে দেয়। স্থানীয় ব্যবসায়ীরা সুবিধা পান, পর্যটনের খাতে বাণিজ্যিক কার্যক্রম বৃদ্ধি পায়। বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে মুসলিমরা শুধু এ ইজতেমাকে ঘিরেই বাংলাদেশে আসেন। এ ইজতেমা না থাকলে ৬১ দেশ থেকে এ মুসলিমরা আসার কোনো কারণই ছিল না। এটি একটি বিশাল সুযোগ বাংলাদেশের জন্য। বিদেশি অতিথিদের আগমন বিশ্বের নানা দেশে বাংলাদেশের নাম উচ্চকিত করে। ২০২৪ সালে বিদেশি মেহমানদের মধ্যে ছিলেন ভারত, পাকিস্তান, কুয়েত, সৌদি আরব, শ্রীলঙ্কা, সুদান, আফগানিস্তান, জাপান, ওমান, কানাডা, মালয়েশিয়া, থাইল্যান্ড, ভিয়েতনাম, অস্ট্রেলিয়া, ফ্রান্স, সিঙ্গাপুর, ইতালি, জর্দান ও যুক্তরাজ্যের মেহমান অন্যতম।
বাংলাদেশে প্রতি বছর আয়োজিত বিশ্ব ইজতেমা শুধু একটি ধর্মীয় সমাবেশ নয়, এটি একটি বৃহৎ অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের কেন্দ্রবিন্দু হয়ে ওঠে। বিশ্ব ইজতেমার মাধ্যমে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের একটি বড় সুযোগ তৈরি হয়। বিদেশি মেহমানরা খাবার, পরিবহন, স্থানীয় পণ্য ও অন্যান্য খরচে উল্লেখযোগ্য পরিমাণ অর্থ ব্যয় করেন। প্রাথমিক হিসাব অনুযায়ী, একজন বিদেশি মেহমান গড়ে প্রতিদিন ১০০ থেকে ১৫০ ডলার ব্যয় করেন। যদি তারা ৩-৫ দিন ইজতেমায় থাকেন, তা হলে মোট ব্যয়ের পরিমাণ দাঁড়ায় প্রায় ৬০ লাখ ডলার, যা বাংলাদেশি মুদ্রায় ৭০ কোটি টাকারও বেশি। বিশ্ব ইজতেমার বহুমাত্রিক প্রভাব এটাই প্রমাণ করে, এটি শুধু ধর্মীয় নয়, বরং সামাজিক ও অর্থনৈতিক দিক থেকেও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি জমায়েত।
বিশ্ব ইজতেমা ঘিরে দেশের অর্থনীতি আরও সমৃদ্ধ করতে আগত বিদেশি মেহমানদের বাংলাদেশের বিভিন্ন ইসলামি দর্শনীয় স্থানগুলো দেখতে আগ্রহী করে তোলা যেতে পারে। ইসলামিক পর্যটন সুবিধা ত্বরান্বিত করা যেতে পারে। সরকার যদি এই স্থানগুলো সুন্দরভাবে সাজিয়ে তোলে, ইজতেমায় আগত বিদেশি মেহমানদের আকর্ষণ করতে পারে, তা হলে স্থানীয় অর্থনীতিতে ব্যাপক পরিবর্তন সাধিত হবে।
বাংলাদেশের বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদদের বক্তব্য অনুযায়ী, ঐতিহ্যবাহী ধর্মীয় অনুষ্ঠানগুলো দেশের অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। ইজতেমা আমাদের জন্য দেশকে আরও উন্নত ও এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার রাস্তা খুলে দেয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের প্রফেসর জাহাঙ্গীর আলম এমনটাই মনে করেন। তিনি বলেন, বিশ্ব ইজতেমা বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ অর্থনীতিতে এক গুরুত্বপূর্ণ অগ্রগতি এনে দেয়। এটি দেশের সাংস্কৃতিক ও ধর্মীয় ঐতিহ্যের পরিচিতি বাড়ানোর পাশাপাশি অর্থনৈতিক উন্নয়নে সহায়ক। সরকার ও স্থানীয় ব্যবসায়ীরা এই মহৎ জমায়েতে সঠিকভাবে উদ্যোগ গ্রহণ করলে বাংলাদেশ একটি শক্তিশালী পর্যটন গন্তব্যে পরিণত হবে এ ইজতেমার মাধ্যমে। সেই সঙ্গে অর্থনীতিতেও উন্নতি করতে পারবে।
বিশ্ব ইজতেমায় আগত নানা দেশের বিদেশি মেহমানদের মাধ্যমে দেশের শুধু অর্থনীতিই নয়, বরং পর্যটনশিল্পকেও অনেক দূর এগিয়ে নিয়ে যেতে পারে। ঠিক এমনটাই আশা পোষণ করেছেন বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ইন্টারন্যাশনাল অ্যান্ড স্ট্র্যাটেজিক স্টাডিজের (বিস) গবেষণা পরিচালক ও খ্যাতিমান অর্থনীতিবিদ ড. মাহফুজ কবীর। তিনি বলেন, ‘আমাদের পার্শ্ববর্তী দেশ ভারত ও সৌদি আরবসহ অনেক মুসলিম দেশ ইসলামি পর্যটনগুলোকে কেন্দ্র করে শত কোটি ডলার বৈদেশিক মুদ্রা আয় করে। যেমন সৌদি আরব হজের মৌসুমে সুন্দর ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে বিশ্বের মুসলিমদের আকর্ষণ করে থাকে। তারা সারা বছরই ধর্মীয় পর্যটকদের মাধ্যমে দেশের অর্থনীতি সমৃদ্ধ করে।’
তিনি বলেন, ‘আমাদের দেশের জন্য বিরাট এক সুযোগ এ ইজতেমা। এটার সুনাম রয়েছে বিশ্বজুড়ে। হজের পরে সর্ববৃহৎ মুসলিম জমায়েত এটি। এটা আমাদের দেশের জন্য সৌভাগ্যও বলা চলে। আমরা এ জমায়েতকে যদি ফর্মালাইজ করতে পারি, বিদেশি মেহমানের সংখ্যা অনেকগুণে বেড়ে যাবে। পর্যটন মন্ত্রণালয় যদি আমাদের দেশের ধর্মীয় পর্যটন এলাকাগুলোর প্রচারে তাদের আকর্ষণ করতে পারে, তা হলে তারা আমাদের দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের ইসলামি পর্যটনকেন্দ্রগুলো অবশ্যই ঘুরে দেখতে আগ্রহী হবে। আর সে সঙ্গে আমাদের দেশের অর্থনৈতিক উন্নতি তো হবেই, সুনামও ছড়িয়ে যাবে বিশ্বময়।
লেখক :ইসলাম বিভাগের প্রধান, সময় টিভি
সময়ের আলো/আরএস/