ই-পেপার মঙ্গলবার ৪ ফেব্রুয়ারি ২০২৫
মঙ্গলবার ৪ ফেব্রুয়ারি ২০২৫
ই-পেপার

মঙ্গলবার ৪ ফেব্রুয়ারি ২০২৫

নারীর খাদ্যপুষ্টি ও রক্তাল্পতা থেকে মুক্তি
প্রকাশ: বৃহস্পতিবার, ৩০ জানুয়ারি, ২০২৫, ১২:৪৯ এএম  (ভিজিট : ১৮২)
আমাদের সমাজে খাদ্য ব্যবস্থাপনায় নারী সবচেয়ে বেশি অবহেলিত। এটি একটি প্রচলিত অব্যবস্থাপনা এবং আদিকাল থেকেই চলছে। ফলে কন্যাশিশু থেকে শুরু করে কিশোরী এবং প্রাপ্তবয়স্ক নারীও স্বাস্থ্যহানির বিপাকে পড়ে আছে। এটিকে যুক্তিযুক্ত করার জন্য নানা ধরনের কারণের আশ্রয় নেওয়া হয়। একই পরিবারে জন্ম নেওয়া পুরুষ শিশু ও নারী শিশুর খাদ্য ব্যবস্থাপনাও ভিন্ন ধরনের। এর সঙ্গে জড়িত পরিবারের প্রায় সবাই। দশ মাস দশ দিন গর্ভে ধারণ করা মাও পুষ্টিকর খাদ্যের সিংহভাগ তুলে রাখেন স্বামী ও পুত্রসন্তানের জন্য।

এটি যেন প্রচলিত সংস্কার। সেসব ক্ষেত্রে কন্যাশিশুর পুষ্টিকর খাদ্যের প্রয়োজনীয়তার কথা মনেও থাকে না। মা নিজে যেমন পর্যাপ্ত পুষ্টিকর খাদ্য থেকে নিজেকে বঞ্চিত করছেন তেমনি একইভাবে কন্যাসন্তানটিও পুষ্টিহীনতায় বেড়ে উঠছে। একজন কন্যাশিশু প্রথমে তার গর্ভধারিণী মায়ের হাতেই প্রয়োজনীয় অনেক কিছু থেকে বঞ্চিত হয়। এই মা একসময় নিজের সহোদর ভাইটির সঙ্গে বঞ্চনার শিকার হয়েছেন। সেই গৃহিণী ও মা কিন্তু নিজের জন্য পর্যাপ্ত পুষ্টিকর খাবার রাখেন না।

দীর্ঘদিনের খাদ্য অব্যবস্থাপনার কারণে আজকাল অনেক নারী রক্তশূন্যতায় ভোগে। রক্তের হিমোগ্লোবিনের মাত্রা কোনো কারণে স্বাভাবিকের চেয়ে নিচে নেমে গেলে তাকে বলা হয় অ্যানিমিয়া বা রক্তস্বল্পতা। আমাদের সমাজে অধিকাংশ নারীই পুষ্টিকর খাদ্যের অভাবজনিত কারণে রক্তস্বল্পতায় ভোগেন।

নারীর পুষ্টিকর খাদ্যের অভাব একক পরিবারে যেমন ঘটে তেমনি যৌথ বা একান্নবর্তী পরিবারে মা ও কন্যাশিশুর অবস্থা আরও দুর্বিষহ। কিশোরী থেকে অন্তঃসত্ত্বা নারী স্বাস্থ্যসম্মত খাদ্য থেকে বঞ্চিত হওয়ার ইতিবৃত্ত চলছে সেই প্রাচীনকাল থেকে। সেই ধারা এখনও বহমান। যার কারণে উচ্চতায় খাটো এবং রক্তাল্পতায় আক্রান্ত শিশু ও কিশোরী আমাদের সমাজে প্রচুর এবং অনাকাক্সিক্ষত।

সঠিক সময়ে সঠিক পুষ্টিকর খাদ্যের ব্যবস্থা থাকতে হবে। বয়ঃসন্ধিকালে কিশোরীদের দৈহিক বৃদ্ধি অত্যন্ত দ্রুত হয়। শারীরিক এই বৃদ্ধিকে সহায়তা করার জন্য পুষ্টির প্রয়োজন এবং এর অভাবে যা ঘটে তা বেশ ঝুঁকিপূর্ণ একটি বিষয়। এর মধ্যে রক্তশূনতা অন্য রোগের সঙ্গে একটি উপসর্গ হতে পারে। কখনো বা নিজেই একটি রোগ হতে পারে। তবে এটিও ঠিক যে রক্তস্বল্পতা রোগ নয়, রোগের উপসর্গ। রক্তের হিমোগ্লোবিন তৈরির অন্যতম প্রধান কাঁচামাল হলো আয়রন।

নানা কারণে রক্তস্বল্পতা হতে পারে। শরীরে আয়রনের উপস্থিতি কমে গেলে রক্তস্বল্পতা হয়। রক্তাল্পতার ঘাটতি পূরণে নারীদের পুষ্টিজনিত খাবার অত্যন্ত জরুরি। প্রতি মাসে ঋতুস্রাবে যে রক্তক্ষরণ তা যদিও প্রাকৃতিক এবং প্রজনন নির্ভর শক্তি তার পরেও তেমন ঘাটতি সম্পূরণও কিশোরী ও সব বয়সের নারীর জন্য নিতান্ত দায়বদ্ধতা। এ জন্যও দরকার পুষ্টিকর খাদ্য।

এ ছাড়া ভিটামিন বি ও ফলিক অ্যাসিডের অভাব, দীর্ঘমেয়াদি কিডনি সমস্যা, যক্ষ্মা, রক্তের ক্যানসার, থ্যালাসেমিয়া, থাইরয়েড হরমোনের সমস্যা, রক্ত উৎপাদনকারীর মজ্জার সমস্যা, রক্তের লোহিত কণিকা নিজে নিজে ভেঙে যাওয়া, অধিক রক্তক্ষরণ ইত্যাদি কারণে রক্তস্বল্পতা হয়ে থাকে। তবে আয়রনের ঘাটতিজনিত রক্তস্বল্পতার হারই সবচেয়ে বেশি। নারীদের গর্ভাবস্থায় আয়রনের ঘাটতিজনিত রক্তস্বল্পতার পরিমাণ অনেক বেশি। এই রক্তস্বল্পতার কারণে বেড়ে যায় মাতৃমৃত্যুর হার। শিশুদের মধ্যেও এর হার যথেষ্ট বেশি। তাই সন্তান কন্যা বা পুত্র যাই হোক না কেন তার যথার্থ সুরক্ষা জন্মদাত্রী মায়েরই সবার আগে। আর তাই এখন একক পরিবারের আদলে যে স্বাচ্ছন্দ্য পরিবেশ সেখানে মাকেও তার পর্যাপ্ত স্বাস্থ্যসম্মত পুষ্টি গ্রহণ করতে হয় নির্দ্বিধায়। বিষয়টি যৌথ বা একান্নবর্তী পরিবারের ক্ষেত্রেও সমানভাবে প্রযোজ্য।

সাধারণত গর্ভাবস্থায় দেখা যায় গর্ভবতী মায়েদের পর্যাপ্ত পরিমাণে পুষ্টিকর খাবার দেওয়া হয় না। এর পেছনের যুক্তি হলো, গর্ভস্থ সন্তানের আকার বড় হয়ে গেলে প্রসবে জটিলতা আসে। এটি একটি ভুল ধারণা। এর শিকার যেমন আজকের মা তেমনি একসময় এর শিকার হয়েছিলেন রায়দাতা বয়োবৃদ্ধ নারীটিও। অথচ শরীরে শক্তি যোগানো, ক্ষয়পূরণ ও রোগ প্রতিরোধের জন্য সব উপাদানসমৃদ্ধ খাদ্যসামগ্রী যথাযথ পরিমাণে গ্রহণ করতে হয়। পুষ্টিগুণসমৃদ্ধ খাদ্য গ্রহণ না করলে শরীর ও মনের বৃদ্ধি ও বিকাশ বাধাগ্রস্ত হয় এবং রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে যায়। গর্ভস্থ সন্তান হয় অপুষ্ট।

তা ছাড়া যেসব নারী অতিরিক্ত ঋতুস্রাবজনিত সমস্যায় ভোগেন, তাদেরও আয়রনজনিত রক্তস্বল্পতা দেখা দিতে পারে। পেপটিক আলসার, কৃমি, পাইলস, দীর্ঘমেয়াদি ব্যথার ওষুধ সেবন ইত্যাদি কারণেও দীর্ঘমেয়াদি রক্তক্ষরণ হলে আয়রনের ঘাটতিজনিত রক্তস্বল্পতা হতে পারে। যারা বেশি বেশি বা অপ্রয়োজনীয় গ্যাস্ট্রিকের ওষুধ খায় তাদের রক্তস্বল্পতা দেখা দিতে পারে।

বোনম্যারো সমস্যার কারণে রক্তস্বল্পতা হতে পারে। হাড়ের মাঝে থাকা অস্থিমজ্জা হিমোগ্লোবিন তৈরি করার জন্য আয়রনের সাহায্য নেয়। যখন বোনম্যারো রেডিয়েশন, ওষুধ, ইনফেকন, লেড অথবা কেমোথেরাপি দ্বারা ইনজুরি হয় তখন আর প্রয়োজনীয় রেড ব্লাড সেল তৈরি করতে পারে না। এটিতে বলে বোনম্যারো সমস্যাজনিত রক্তস্বল্পতা।

রক্তস্বল্পতা থাকলে শরীর ও চেহারা ফ্যাকাশে হয়ে যায়। মাঝেমধ্যে বুক ধড়ফড় করে। দুর্বলতা দেখা দেয় ও সামান্য পরিশ্রমে হাঁপিয়ে যায়। কানে ঝিঁঝি শব্দ শোনা যায়। রক্তস্বল্পতার কারণে খাবারে অরুচি ও ক্ষুধামান্দ্যও হয়ে থাকে। কখনো কখনো নখ ভঙ্গুর বা নখের আকৃতি চামচের মতো হয়ে যায়। এ ছাড়াও কাজকর্ম ও পড়ালেখায় মনোযোগ বিচ্যুত হয়। সাধারণত যেকোনো ধরনের রক্তস্বল্পতায় চিকিৎসা দেওয়া হয় রক্তস্বল্পতার পেছনের কারণটিকে বিবেচনা করে। আয়রনের ঘাটতিজনিত রক্তস্বল্পতায় কী কারণে আয়রনের ঘাটতি হলো, তা আগে নিশ্চিত করতে হবে। অপুষ্টিজনিত কারণে হলে আয়রন দেওয়াটাই মূল চিকিৎসা। সঙ্গে আয়রনসমৃদ্ধ খাবারের পরামর্শ দেওয়া হয়। কচুশাক, ডাঁটাশাক, পালংশাক, শিম ও শিমের বিচি, কাঁচা কলা, সামুদ্রিক মাছ, কলিজা, গিলা, গরু-খাসির মাংসে প্রচুর আয়রন থাকে। তা ছাড়া ফলিক অ্যাসিড কিংবা ভিটামিন বি ৯ এবং ভিটামিন বি ১২ এবং প্রচুর ফলমূল খাওয়ার পরামর্শ দেওয়া হয়।

আয়রন সাপ্লিমেন্ট দুভাবে দেওয়া হয়। মুখে খাওয়ার জন্য এবং শিরায় ইনজেকশন হিসেবে। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে নিরাপদ মাতৃত্বের জন্য একটা বড় হুমকি হলো এই আয়রনের ঘাটতিজনিত রক্তস্বল্পতা। অথচ এর সমাধান খুব সহজ। শুধু দরকার একটু সচেতনতা।

সাধারণত খাদ্যতালিকায় পর্যাপ্ত আয়রনের অভাবেই আমাদের দেশের নারীরা রক্তশূন্যতার শিকার হয়ে থাকেন। অপর্যাপ্ত আয়রনের কারণে রেড ব্লাড সেলের জন্য আমাদের শরীর প্রয়োজনীয় পরিমাণ হিমোগ্লোবিন তৈরি করতে পারে না। ফলে আয়রনের অভাবজনিত অ্যানিমিয়া আমাদের আক্রমণ করে। তা ছাড়া ঘন ঘন রক্তদান, অতিরিক্ত ক্যাফেইন গ্রহণও শরীরে আয়রনের পরিমাণ কমিয়ে দেয়। তবে ঘরোয়াভাবেও রক্তস্বল্পতা কমানোর উপায় আছে। এক কাপ আপেলের জুসের সঙ্গে এক কাপ বিট রুটের জুস মিশিয়ে প্রতিদিন পান করা যায়। আপেল আর টমেটোর জুস রক্তস্বল্পতা রোধে সহায়তা করে। এ ছাড়াও কলা এবং মধুর সংমিশ্রণও যথেষ্ট উপকারী। আসলে অ্যানিমিয়া সারাবার মূল মন্ত্রতন্ত্র খাবারের মধ্যেই নিহিত আছে। এ জন্য প্রথমেই প্রতিদিনের খাদ্যতালিকার দিকে দৃষ্টি দিতে হবে। শুরুতেই রক্তস্বল্পতার কারণ না খুঁজে প্রথম থেকেই এর প্রতি প্রতিরোধ গড়ে তোলা দরকার।

একই সঙ্গে নারী ও নারীশিশুদের জন্য ভালো পুষ্টি অনুশীলনগুলো বোঝা ও প্রয়োগ করা অত্যাবশ্যক। একটি সুষম খাদ্যের ওপর মনোযোগ কেন্দ্রীভূত করে, প্রয়োজনীয় ভিটামিন এবং খনিজগুলো অন্তর্ভুক্ত করে স্বাস্থ্যকর খাদ্য বেছে নেওয়ার মাধ্যমে নারীরা তাদের স্বাস্থ্য বজায় রাখতে, ওজন নিয়ন্ত্রণ করতে এবং দীর্ঘস্থায়ী রোগের ঝুঁকি কমাতে পারে। মনে রাখা দরকার, স্বাস্থ্যকর খাদ্য একটি স্বাস্থ্যকর জীবনধারা। গর্ভবতী মায়েদেরও সঠিক নিয়মে খাওয়া-দাওয়া করতে হবে। খাবারে যেন যথেষ্ট পরিমাণে আয়রন সমৃদ্ধ উপাদান থাকে সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। তা হলেই আমরা পাব সুস্থ মা এবং স্বাস্থ্যবান সন্তান।

পরিবারের গৃহিণী যদি পুষ্টিহীনতা রুগ্ন স্বাস্থ্যে বিড়ম্বিত হন তা হলে আগামীর প্রজন্ম থেকে শুরু করে পুরো পরিবার বিপন্নতায় দুঃসহকাল অতিক্রম করতে বাধ্য হবে। মনে রাখা দরকার স্বাস্থ্যই সব সুখের মূল। এই অমৃত বাণী যুগ যুগান্তরের। এ জন্য সৃষ্টির সব মানবের সুস্থতার কথা ভাবতে হবে। কিন্তু যারা মানব সৃষ্টির মূল কর্মকাণ্ডের সঙ্গে গভীরভাবে জড়িত তাদের কথা আরও বেশি করে ভাবতে হবে এবং নারী ও নারীশিশুর জন্য পর্যাপ্ত পুষ্টিকর খাদ্যের ব্যবস্থা রাখতে হবে।




https://www.shomoyeralo.com/ad/1698385080Google-News-Update.jpg

সর্বশেষ সংবাদ

সর্বাধিক পঠিত


ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক : সৈয়দ শাহনেওয়াজ করিম, আমিন মোহাম্মদ মিডিয়া কমিউনিকেশন লিমিটেড এর পক্ষে প্রকাশক গাজী আহমেদ উল্লাহ। নাসির ট্রেড সেন্টার, ৮৯, বীর উত্তম সি আর দত্ত সড়ক (সোনারগাঁও রোড), বাংলামোটর, ঢাকা।
ফোন : +৮৮-০২-৯৬৩২৩৬৮-৭৪, ফ্যাক্স : +৮৮-০২-৯৬৩২৩৭৫ | ই-মেইল : shomoyeralo@gmail.com
close