
রাজধানীসহ সারা দেশে চলছে তীব্র গ্যাস সংকট। দিনের বেশিরভাগ সময়ে গ্যাস না থাকায় চরম ভোগান্তিতে সময় পার করছেন নগরবাসী। গ্যাস না থাকায় ইলেকট্রিক কুকার বসিয়ে জরুরি রান্না সারছেন অনেকেই। বাধ্য হয়ে অনেকে সিলিন্ডার গ্যাস কিনেছেন। কখনো ভোরে আবার
কখনো গভীর রাতে গ্যাস আসে। তাও তা স্থায়ী হয় ঘণ্টাখানেক। গ্যাস না থাকলেও সময়মতো তাদের গুনতে হয় বিল। সকালে বাচ্চাদের স্কুলে যাওয়ার সময়ে তারা ঠিকমতো খেতে পারছে না। বাইরের খাবার খেয়ে তাদের সন্তানরা অসুস্থ হয়ে পড়ছে।
দেশে একসময় দিনে ২৭০ কোটি ঘনফুট গ্যাস উৎপাদিত হতো। ২০১৮ সালের পর থেকে উৎপাদন কমতে থাকে। নতুন গ্যাস অনুসন্ধান ও উৎপাদন বাড়ানোয় তেমন জোর দেওয়া হয়নি। ফলে উৎপাদন কমে এখন ১৯৩ কোটি ঘনফুটে নেমে এসেছে। গত বছরও এটি ২০০ থেকে ২১০ কোটি ঘনফুট ছিল। মূলত জ্বালানি বিভাগের অবহেলা ও অদক্ষতা এর জন্য দায়ী বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। সর্বোচ্চ মজুদ থাকার পরও কারিগরি পরিকল্পনা ও দক্ষ প্রযুক্তির অভাবে তিতাস ও কৈলাসটিলা গ্যাস ক্ষেত্রে উৎপাদন বাড়ানো যায়নি। অথচ কম মজুদ থাকা বিবিয়ানা গ্যাস ক্ষেত্র থেকে কয়েকগুণ উৎপাদন বাড়ানো হয়েছে।
সাধারণত শীতের সময় বিদ্যুৎ উৎপাদন অর্ধেকে নেমে যায়। এতে বিদ্যুৎ খাতে গ্যাসের চাহিদা কমে যায়। ফলে শিল্প, আবাসিক ও বাণিজ্যিক খাতে গ্যাসের সরবরাহ বেড়ে যাওয়ার কথা। কিন্তু এবার গ্যাসের সরবরাহ কমে গেছে। দেশীয় গ্যাস ক্ষেত্র থেকে উৎপাদন টানা কমছে। ফলে শীতেও গ্যাস-সংকট ভোগাচ্ছে গ্রাহকদের। বিশেষজ্ঞদের শঙ্কা, সামনে এটি আরও ভোগাবে। এদিকে অনেক জায়গায় দিনের বেলায় গ্যাস থাকছে না। রান্নার চুলা জ্বালাতে রাতের জন্য অপেক্ষা করতে হয়। প্রয়োজনীয় গ্যাস পাচ্ছেন না শিল্পের গ্রাহকরাও।
ফলে রফতানিমুখী কারখানায় উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে। উৎপাদন ব্যাহত হওয়ায় বাজারে সরবরাহ কমে যাচ্ছে, সরবরাহ কমে যাওয়ায় নিত্যপণ্যের দাম বেড়ে যাচ্ছে। সাধারণত শীতের সময় বিদ্যুৎ উৎপাদন অর্ধেকে নেমে যায়। এতে বিদ্যুৎ খাতে গ্যাসের চাহিদা কমে যায়। ফলে শিল্প, আবাসিক ও বাণিজ্যিক খাতে গ্যাসের সরবরাহ বেড়ে যাওয়ার কথা। কিন্তু এবার গ্যাসের সরবরাহ কমে গেছে। রফতানিমুখী কারখানায় উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে।
বাজারে থাকলেও চড়া দামে এলএনজি কেনা কঠিন। গ্যাস সমস্যার সমাধান চাইলে অনুসন্ধানে জোর বাড়াতে হবে। সাধারণত ১০ থেকে ১৫ পিএসআই (প্রতি বর্গইঞ্চি) চাপে গ্যাস সরবরাহ হয় শিল্পে। শীতে এমনিতেই গ্যাসের চাপজনিত সমস্যা থাকে। এবার সরবরাহ কম থাকায় এটি আরও ভয়াবহ হয়েছে।
কোনো কোনো কারখানা গ্যাস পাচ্ছে ১ থেকে ২ পিএসআই চাপে। এতে কারখানা চালানো কঠিন হয়ে পড়েছে। এদিকে বাংলাদেশ তেল, গ্যাস, খনিজ সম্পদ করপোরেশন (পেট্রোবাংলা) ও হাইড্রোকার্বন ইউনিটের তথ্য মতে, দেশে বর্তমানে ২৯টি গ্যাস ক্ষেত্র রয়েছে। তবে উৎপাদনের শীর্ষে থাকা বিবিয়ানার মজুদ শেষের দিকে। এখানে উৎপাদন কমছে। দুই বছর আগে এই গ্যাস ক্ষেত্র থেকে দিনে ১৩০ কোটি ঘনফুটও উৎপাদন করা হয়েছে। এখন এটি নেমে এসেছে ৯৮ কোটি ঘনফুটে। আগামী দিনে আরও কমতে থাকবে। অন্য বড় গ্যাস ক্ষেত্র থেকেও সক্ষমতা অনুসারে উৎপাদন হচ্ছে না।
হাইড্রোকার্বন ইউনিটের তথ্য বলছে, গত নভেম্বর পর্যন্ত মোট মজুদ আছে সাড়ে ৮ টিসিএফ (ট্রিলিয়ন ঘনফুট)। বছরে গড়ে পৌনে ১ টিসিএফ গ্যাস উৎপাদন করা হয়। এতে অবশিষ্ট মজুদ দিয়ে আট বছর উৎপাদন ধরে রাখা যেতে পারে। গ্যাস পাচ্ছেন না শিল্প-আবাসিক গ্রাহকরা। এখন চলছে শিল্পে গ্যাসের দাম বাড়ানোর তৎপরতা। দিনে এখন গ্যাসের চাহিদা ৩৮০ কোটি ঘনফুট। দিনে সর্বোচ্চ ৩০০ কোটি ঘনফুট সরবরাহ করা হলে পরিস্থিতি সামলানো যায়। তবে এখন সরবরাহ করা হচ্ছে ২৫০ কোটি ঘনফুট। লাইনের গ্যাস বেশিরভাগ সময় থাকে না।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, মজুদে কত বছর চলবে, তা এভাবে বলা যাবে না। কেননা গ্যাসের মজুদ কমতে থাকায় একই হারে উৎপাদন অব্যাহত রাখা যাবে না। এটি প্রতি বছর কমতে পারে। এর মধ্যে নতুন
মজুদও আবিষ্কৃত হতে পারে। কোনো সরকারই গ্যাস অনুসন্ধান ও উৎপাদনে জোর দেয় না।
আমদানিনির্ভরতা থেকেই এ খাতে বিপর্যয় তৈরি হয়েছে। এলএনজিনির্ভরতা কোনো সমাধান নয়।
দেশীয় গ্যাস ক্ষেত্র থেকে উৎপাদন টানা কমছে। ফলে শীতেও গ্যাস-সংকট ভোগাচ্ছে গ্রাহকদের। বিশেষজ্ঞদের শঙ্কা, সামনে এটি আরও ভোগাবে। শীতের সময় তাপমাত্রা কমে গেলে অতিরিক্ত গ্যাস প্রয়োজন হয়। যে কারণে এ সময় এসে গ্যাসের সংকট বেশি দেখা দিয়েছে। বর্তমানে গ্যাস-সংকটের পাশাপাশি শীতের কারণে এই সমস্যা তীব্র হয়েছে। আবার কোনো সময় দুপুর বেলা একটু গ্যাসের দেখা মিলে। যেটুকু গ্যাসের দেখা মিলে তাতে রান্নাবান্না সেরে ফেলতেই আবারও চলে যায়। এরপর অবস্থা এমন হয়ে দাঁড়ায় যে রাতের বেলায় রান্না করে রাখারও উপায় নেই। কারণ রাতে রান্না করলেও দিনের বেলায় সেই খাবার গরম করার সুযোগ নেই। ফলে অনেকেই বাধ্য হয়ে সিলিন্ডার গ্যাস ও ইলেকট্রিক চুলা ব্যবহার করছেন। আর্থিক এই সংকটের মধ্যে গ্যাস সিলিন্ডার ও ইলেকট্রিক চুলা ব্যবহার করায় মাস শেষে অনেকের পকেট খালি হয়ে যায়।
এমন পরিস্থিতি থেকে পরিত্রাণের উপায় হলো সরকারকে এ বিষয়ে গুরুত্ব দিয়ে কাজ করতে হবে। গ্রাহকরা অভিযোগ দিলেও কোনো পদক্ষেপ নিতে পারছেন না কর্তৃপক্ষ। কবে নাগাদ এই সমস্যা সমাধান হতে পারে তাও বলতে পারছেন না। বাসাবাড়ি, সিএনজি স্টেশন, শিল্প-কলকারখানা সর্বত্র একই অবস্থা। রাজধানীর অধিকাংশ এলাকার বাসাবাড়িতে সকাল ৭টার পর থেকে চুলা জ্বলছে না। বাধ্য হয়ে অনেকে মধ্যরাতে জেগে রান্নার কাজ সারছেন। এ অবস্থায় তিতাসের পাশাপাশি এলপিজি সংযোগও নিতে বাধ্য হচ্ছেন অনেক গ্রাহক।
পেট্রোল পাম্পে গ্যাসের চাপ না থাকায় যানবাহনের দীর্ঘ লাইন তৈরি হয়েছে। একটি গাড়ির গ্যাস নিতে কমপক্ষে দুই থেকে আড়াই ঘণ্টা লাগছে। গ্যাস না থাকায় রাস্তার মাঝখানে বন্ধ হয়ে যাচ্ছে অনেক গাড়ি। ফলে রাজধানীতে দেখা দিয়েছে যানজট। গণপরিবহন সংকটে বেড়েছে জনভোগান্তি। গ্যাসের চাপ না থাকায় অনেক শিল্প-কারখানা দিনে বন্ধ রাখতে হচ্ছে। গাজীপুর, সাভার, কোনাবাড়ী, নারায়ণগঞ্জসহ সারা দেশের শিল্পাঞ্চলে চলছে এই সংকট। শিল্প মালিকরা বলছেন, গ্যাস সংকট চলতে থাকলে এই সেক্টরে শিগগিরই বড় বিপর্যয় নেমে আসবে। উৎপাদন কমে আসায় নিত্যব্যবহার্য পণ্যের সংকট বাড়ার সঙ্গে পাল্না দিয়ে দাম বাড়বে। এতে ঊর্ধ্বমুখী মূল্যস্ফীতিকে আরও উসকে দেবে। পাশাপাশি রফতানি বাণিজ্যও মারাত্মকভাবে ব্যাহত হবে। যা রিজার্ভের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে।
শীতকাল এলেই দেশে গ্যাসের সংকট তৈরি হয়। পাইপলাইনে কনডেন্সড জমে গ্যাসের স্বাভাবিক প্রবাহ বাধাগ্রস্ত হয়। কিন্তু এবার পরিস্থিতি ভিন্ন। দেশে গ্যাস উৎপাদন হ্রাস, এলএনজি আমদানি না হওয়ার পাশাপাশি চাহিদা বেড়ে যাওয়ায় বর্তমানে দেশে গ্যাসের সংকট প্রকট আকার ধারণ করেছে। সেই সঙ্গে একটি টার্মিনাল বন্ধ হয়ে যাওয়ায় সেই সংকট আরও বেড়েছে। তেমনি গ্যাস সংকটও প্রত্যাশিত নয়, সংগত কারণেই নিরবচ্ছিন্ন গ্যাস সরবরাহের পাশাপাশি সাধ্যের মধ্যে দাম নিশ্চিত রাখা সময়ের দাবি। এ নিয়ে কর্তৃপক্ষ যথাযথ পদক্ষেপ নেবে-এটাই প্রত্যাশা।
সাবেক রেজিস্ট্রার, বিএসএফএমএসটিইউ
সময়ের আলো/আরএস/