ঠাকুরগাঁওয়ে শালবন পেরিয়ে এক প্রত্যুষে পৌঁছেছিলাম টাঙ্গন নদীর কাছে। এই নদীও দিয়েছিল সরু খাল দেখার অনুভূতি! নদীগুলো খাল হয়ে গেছে, খালগুলো সমুদ্র হয়নি। খাল রয়ে গেছে রাখালের সঙ্গে। নদীর নামে কত পত্রিকার নাম, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান। এমনকি প্রচুর নারীর নাম আছে নদী। চারপাশে এদের উপস্থিতি কম নয়! নদীকে যারা ধারণ করেন, লালন করেন তাদের যাপিত জীবনের নানা বাঁকে থাকে নদীর উপস্থিতি।
চুয়াডাঙ্গায় দেখা মিলেছিল দৈনিক মাথাভাঙ্গা পত্রিকার; অন্যদিকে করতোয়া বগুড়ার হয়েও জাতীয় দৈনিকের আমেজ দিয়ে যাচ্ছে। টাঙ্গন, যমুনাসহ আরও নদীর নামে দেখা মিলবে বিস্তর লিটল ম্যাগাজিনের নামকরণ। চাঁদপুর-নোয়াখালী-বরিশাল-যশোর-মাদারীপুর প্রমুখ জেলার স্টোর (দোকান) মালিকদের চেয়ে অনেক গরীয়ান-ধনবান এসব নদীর মালিকরা। নদী থেকে ভাবসম্পদ নিয়ে যারা সমৃদ্ধ। অন্যদিকে নদী দখলকারীরাও নিশ্চয়ই নদীকে ভালোবাসে; সেই ভালোবাসা নিশ্চয়ই পরকীয়ার মতো, গোপন রক্ষিতার মতো, ধর্ষকের ক্ষণিকের উত্তেজনার মতো!
নদীকে ভালোবেসেই অনেক মানুষের নামও হয়ে গেছে নদী! সেটি অবশ্যই নদীপ্রেমিক অভিভাবকদের রুচি। জাতীয় গণগ্রন্থাগারের শওকত ওসমান মিলনায়তনে একটি অনুষ্ঠান উপস্থাপনা করছিলেন ছড়াকার টিমুনী খান রীনো। অনুষ্ঠানের এক পর্যায়ে তিনি ঘোষণা করলেন, গান গাইবেন নদী। এই নদী পানির নয়, মানব নদী! বিমোহিত হলাম তার রসবোধে। তবে মানব নদীকেন্দ্রিক আরেকটি ঘটনাও জোরালো ধাক্কা দিয়েছিল। হঠাৎ এক দিন সংবাদমাধ্যমে পরিবেশিত হলো, আবাসিক হোটেল থেকে পতিতাবৃত্তির অভিযোগে নায়িকা নদী গ্রেফতার। মুনমুন-ময়ূরী জমানার নায়িকা নদী। অশ্লীলতার অভিযোগ তার বিরুদ্ধেও। কিন্তু তাই বলে... তার পবিত্র মুখাবয়ব এমন সংবাদে বিশ্বাসী হতে মন সায় দেয় না। পরদিন দেখা গেল, আমার ধারণাই সঠিক। নায়িকা নদী এফডিসিতে এসে কান্নাকাটি করে জানালেন, প্রকাশিত সংবাদের নদী তিনি নন। গ্রেফতারকৃত নারী হয়তো ভুঁইফোঁড় ‘নায়িকা’। কিন্তু সর্বনাশ যা ঘটার তা তো ঘটেই গেছে। আগের দিনের চটকদার ঘটনা-রটনা তো নদী কান্না দিয়ে মুছে দিতে পারবেন না। একটি ছোট ভুল তার ব্যক্তিজীবনে বসিয়ে দিয়েছে বড় আঁচড়।
মন পাতলে শৈশবের স্মৃতির গন্ধ এখনও পাই। হৃদয়ে দাগ রেখে গেছে সেই দৃশ্যাবলি। আমাদের খাল এখনকার অনেক নদীর চেয়েও বড়। সেই খালে নৌকা বেয়ে আসত যাযাবর শ্রেণির মানুষ। ভরা বর্ষায় কাপড় বাঁচিয়ে নৌকা থেকে কায়দা করে নামত। এরা বাসন-কোসনসহ শৌখিন জিনিসপত্র বিক্রি করত। গৃহবধূরা ঘরের সামনে চমৎকার সব প্রয়োজনীয় জিনিস কিনে নিত। কথার ফাঁকেই আদান-প্রদান হয়ে যেত চুন-জর্দাসহ পান। যাযাবর শ্রেণির আরেকটি অংশ শিঙা দিয়ে শরীরের বিষ রক্ত বের করত। কারও দাঁতকে পোকামুক্ত করত। কেউ কেউ জাদুও দেখাত। শৈশবের দেখা ঘটনা এখনও ভাসে চোখের সামনে। বয়স্কা এক নারী একটা দশ পয়সা হাতে নিয়ে সেখান থেকে বের করে আনলেন অসংখ্য দশ পয়সার মুদ্রা! হাত গোল করে কনিষ্ঠার সঙ্গে বৃদ্ধাঙ্গুলি মিলিয়ে পাখি বানালেন। ও মা, সেই পাখি ডাকও দিয়ে উঠল! সত্যিই বিস্ময় কাটে না। পাখি বানানো, পয়সা উৎপাদন নিছক বুজরুকি নয়। তাতে মাখানো আছে আমাদের শৈশবের বর্ণালি রং। তবে সব যাযাবর ব্যবসায়ীই যে স্বচ্ছ কাজ করতেন তা নয়। প্রতারণার অভিযোগও ছিল কারও কারও বিরুদ্ধে। নানা কূটকৌশলে গৃহবধূর গহনা কিংবা মূল্যবান জিনিসপত্র হাতিয়ে নিত এরা। এই যে টাকা বানিয়ে নেওয়া, পাখি বানিয়ে দেখানো সবই কি হিপনোটাইজ করে ফেলার কেরামতি! সব মানুষকে একত্রে হিপনোটাইজ করে ফেলা যায়? সত্যিই, কত কিছুই জানার বাইরে রয়ে গেছে।
বেদে সম্প্রদায় প্লাস্টিক ও বাঁশ ব্যবহার করে নৌকার ছাউনির মতো করে ঘর নির্মাণ করত। থাকত খালপাড়েই। যাতায়াতের সুবিধার জন্যই বোধহয় তারা রাস্তার পাশে, খালঘেঁষে স্থাপন করত বসতি। বেদেনীর বেতসলতার মতো ছিপছিপে দেহ এখনও রূপসচেতন যেকোনো তরুণীর চেয়ে আকর্ষণীয় মনে হয়। সাপের খাদ্য দুধ-কলার জন্য তারা যখন বাক্স খুলে সাপ বের করে সাহায্য প্রার্থনা করে পথচারীর, পথচারী সাপ দেখার পাশাপাশি মুগ্ধ চোখ বুলিয়ে নেয় একবার বেদেনির দিকেও! অন্যদিকে বেদে পুরুষরা বড় কোনো হুজ্জতে জড়ায় না। তারা অশিক্ষিত-অসচেতন শ্রেণির কাছে তাবিজ-কবজ বেচে বড়জোর।
এত যে দূষিত বুড়িগঙ্গা নদী, সেখানে ঠিকই প্রান্তিক শ্রেণির মানুষ এখনও গোসল করে, কাপড় কাচে। নদীকে যারা দূষিত করেছে, দখল করেছে, তারা নদীর চেয়েও দূষিত মানুষ। কিন্তু দূষিত হয়েও তারা সমাজে সম্মানিত, কেউ কেউ আবার জনপ্রতিনিধি! নদী কেবলই দীর্ঘশ্বাস দিয়ে যাচ্ছে আজকাল। এখনকার নদীগুলোর চেয়ে ঢের বড় আমাদের শৈশবের খাল। সেই খালকে হয়তো এখনও বার্ধক্য ছোঁয়নি। খালগুলোকেই আমি নদীর মর্যাদা দিই। খাল নারীর মতো কথা না কইলেও ঠিকই জনজীবনের কথা কয়। কৃষক-শ্রমিকের মনোকথাও তার মুখস্থ।
খালপাড় আমাকে নিয়ে যেত সঠিক গন্তব্য। নানাবাড়ির বিকল্প পথেও রয়েছে মোহন একটি খাল। খালগুলো নদী হয়ে যায়, নদীগুলো স্বপ্নে ভাসিয়ে দেয়। টেমস নদী কিংবা নায়াগ্রা জলপ্রপাত হয়তো জীবনে দেখা হবে না কোনো দিন, তবুও দেশের সব নদীর মালিক আমি; অনন্য সম্পদের অধিকারী, এটি ভাবতে ভালো লাগে। নদী সাম্রাজ্যের অধিপতি মনে মনে।
পালতোলা নৌকা, সওদাগরি নাও, রূপকথার সপ্তডিঙা ভেসে বেড়ায় আমার নদীসমগ্রে। চোখ বন্ধ করলে এসব আমাকে পৌঁছে দেয় স্বপ্নরাজ্যে। জলের রাজ্যে। যে জল স্বপ্নের কথা কয়, স্বপ্নের মানুষের কথা কয়!
দেশের নদী মরে যাচ্ছে, জল কমে যাচ্ছে তবুও কমেনি জলপ্রেম। নৌবিহার এখনও জনপ্রিয়। প্রকৃতিপ্রেমী মানুষ এখনও নদীপাড়ে বসে জীবনের অর্থ খুঁজে বের করার চেষ্টা করে। খুঁজে নেয় বেঁচে থাকার টনিক। এই নদী যেমন জীবনদায়ী, আবার সর্বনাশীও।
শত শত বছর ধরেই হতভাগিনীরা ভবযন্ত্রণা জুড়াত নদীতে ডুবে মরে। কলঙ্কিনীর জন্য নদীই যে ভালো ‘বাঁচা’র পথ! শুধু নারী কেন, সংখ্যায় কম পুরুষরাও নদীকে মনে করত মুক্তির আধার। কয়েক বছর আগেও নৌযানডুবিতে প্রচুর মানুষ মারা যেত। হাহাকার পড়ে যেত নদীতীরে। সুখের বিষয় হচ্ছেÑঅপমৃত্যুর এই স্রোত ধীরে ধীরে কমে আসছে।
নদী বাড়িঘর ভেঙে নিলে সর্বস্ব হারানো মানুষ খুঁজে ফেরে নিরাপদ আশ্রয়। সন্ধানে নামে নতুন জীবনের। আবার সেই নদীতে চর জাগলে ফিরতে পারে কি তারা! জমির মালিকানা একবার হাতছাড়া হয়ে গেলে পুনরায় ফিরে পাওয়া কঠিন। এদিকে চর দখলকারী তো কম জন্মায়নি। নদীর পানির সঙ্গে তাই মিশে যেত রক্ত।
নদীভাঙন যেমন দুঃখের, নদীর প্রত্যাবর্তনও কারও কারও জন্য দুঃখই বয়ে আনত। এখনও নিশ্চয়ই আনে। নদী অঞ্চলে বসবাসকারী মানুষ যে ‘জনমদুঃখী’ সেটির কিছুটা আমরা আঁচ করতে পারি রাইসুল ইসলাম আসাদ অভিনীত ‘দুখাই’ চলচ্চিত্রে। দুখাই নামটা বোধহয় প্রতীকী। নিরন্তর দুঃখ-বেদনার সঙ্গে যারা লড়াই করে বাঁচে, তারাই তো দুখাই! যাদের স্বপ্ন তছনছ হয়ে যায়, আবার ঘর বাঁধে। আবার তছনছ হলে মনোবল না হারিয়ে চালিয়ে যায় টিকে থাকার লড়াই। জীবন কুসুমকোমল নয়, সেটি নদীভাঙন কবলিত মানুষের চেয়ে ভালো আর কে জানে! কত সতর্ক সংকেত মোকাবিলা করে তারা টিকে থাকে, টিকিয়ে রাখে নিজের ও স্বজনের জীবন। মৎস্য সম্পদ দিয়ে গ্রাসাচ্ছদনের ব্যবস্থা বজায় রাখে দেশের অগুনতি মানুষের...।