ক্ষমতাচ্যুত শেখ হাসিনার আমলে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন নিয়ে উঠা অভিযোগ অনুসন্ধানের সিদ্ধান্ত নিয়েছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। বুধবার দুদকের মহাপরিচালক (প্রতিরোধ) মো. আক্তার হোসেন এ সিদ্ধান্তের কথা জানান। তিনি বলেন, ২০১৮ সালের একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ক্ষমতার অপব্যবহার, অপরাধমূলক অসদাচরণ, জাল-জালিয়াতি, দিনের ভোট রাতে করা এবং আর্থিক লেনদেনের মাধ্যমে এমপি নির্বাচনের অভিযোগ অনুসন্ধানের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। একই সঙ্গে টিম গঠন করা হয়েছে।
দুদক জানায়, ২০১৮ সালের একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিভিন্ন অনিয়ম যেমন দিনের ভোট রাতে করা, ব্যালট জালিয়াতি, কিছু কিছু কেন্দ্রে ৯০ শতাংশের বেশি কাউন্ট দেখানো, ব্যাপক আর্থিক লেনদেন, ক্ষমতার অপব্যবহার করে প্রার্থীকে জেতানো ইত্যাদি নানা অভিযোগ বিভিন্ন মিডিয়ায় প্রকাশ হয়েছে এবং দুদকেও কিছু অভিযোগ জমা হয়েছে।
অভিযোগে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী আওয়ামী লীগের সভানেত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে দলটির সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরের সার্বিক ব্যবস্থাপনায় প্রতিটি মহানগর, জেলা, বিভাগীয়, উপজেলা, পৌর, ইউনিয়ন এবং ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সব নেতাকর্মী নিয়ে সরকারের বিভিন্ন পর্যায়ের কর্মকর্তা যেমনÑপুলিশের আইজি জাভেদ পাটোয়ারী, ডিএমপি কমিশনার আসাদুজ্জামান মিয়া, র্যাবের প্রধান ড. বেনজীর আহমেদ, পুলিশের সাবেক আইজি শহিদুল হক, প্রতিরক্ষা বিষয়ক উপদেষ্টা তারেক আহমেদ সিদ্দিকি, তৎকালীন জনপ্রশাসন বিষয়ক উপদেষ্টা এইচটি ইমাম, জেলা প্রশাসক, জেলা রিটার্নিং কর্মকর্তা, বিভাগীয় কমিশনার, রেঞ্জ ডিআইজি, পুলিশ সুপার, থানার ওসি, জেলা ও উপজেলা নির্বাচন কর্মকর্তা, প্রিসাইডিং অফিসারসহ নির্বাচনের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট অন্যান্য কর্মকর্তার যোগসাজশের কথা উল্লেখ রয়েছে।
অভিযোগ অনুসন্ধানের জন্য একজন দুদকের উপপরিচালকের নেতৃত্ব ৫ সদস্যের একটি টিম গঠন করা হয়েছে। অভিযোগ বিষয়ে বিভিন্ন ভিডিও, দেশি-বিদেশি গণমাধ্যমের প্রচারিত সংবাদ, নির্বাচনের ফলাফল শিট পরীক্ষা-নিরীক্ষা এবং প্রয়োজনীয় অন্যান্য কার্যক্রম সম্পন্ন করে অনুসন্ধান টিম প্রতিবেদন দাখিল করবে।
এদিকে ২০১৮ সালের ৩০ ডিসেম্বর জাতীয় নির্বাচনে জিতে টানা তৃতীয় মেয়াদে সরকার গঠন করে শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ। নির্বাচনে ৩০০ আসনের মধ্যে আওয়ামী লীগ একাই পায় ২৫৭টি আসন। এ সময় জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট গড়ে নির্বাচনে অংশ নেওয়া বিএনপি ও সমমনা দলগুলো পায় মাত্র সাতটি আসন। অধিকাংশ ভোট আগের রাতে হয়ে যাওয়ার অভিযোগের মধ্যে নির্বাচনের নাম হয় রাতের নির্বাচন।
একাদশ সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছিল কে এম নুরুল হুদার কমিশনের অধীনে। সেই কমিশনের সদস্য মাহবুব তালুকদার বিদায় বেলায় এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন আমাদের ব্যর্থতার গ্লানি ছাড়া আর কিছু দিতে পারেনি। জাতীয় নির্বাচনে লেভেল প্লেয়িং ফিল্ডয়ের অস্তিত্ব ছিল না। যদিও সিইসি লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড আছে বলে দাবি করেন। জেলা প্রশাসকরা রিটার্নিং অফিসার হিসেবে দায়িত্ব পালন করায় বিদ্যমান রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে সিটিং এমপিদের বিষয়ে তাদের নিরপেক্ষতা অবলম্বন করা সম্ভব ছিল বলে মনে করি না। একাদশ জাতীয় নির্বাচনে ২১৩টি কেন্দ্রে শতভাগ ভোট পড়েছে, এতেই বোঝা যায় নির্বাচন কেমন হয়েছে? এভাবে না-অবাধ, না-সুষ্ঠু, না-নিরপেক্ষ, না-আইনানুগ, না-গ্রহণযোগ্য একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়।
২০০৮ সালের নির্বাচনে বিপুল ভোটে ক্ষমতায় আসার পর আওয়ামী লীগ সংবিধান সংশোধন করে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বাতিল করে। সে অনুযায়ী দলীয় সরকারের অধীনেই পরের তিনটি নির্বাচন হয়। প্রশ্নবিদ্ধ ওই তিন নির্বাচনেই আওয়ামী লীগ জয়ী হয় এবং ১৫ বছরের বেশি সময় ধরে দেশ শাসন করে যায়। শেষ পর্যন্ত ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে শেখ হাসিনার দেশ থেকে পলায়নের মধ্য দিয়ে আওয়ামী লীগ সরকারের পতন ঘটে।
অপরদিকে গত বছরের ডিসেম্বরে সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনী আংশিক বাতিল করে রায় দেয় হাইকোর্টের একটি বেঞ্চ। তাতে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা ফেরানোর পথ তৈরি হয়। অবাধ ও নিরপেক্ষতা নিশ্চিত করতে না পারায় আওয়ামী লীগ সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত তিনটি জাতীয় নির্বাচনে জনগণের আস্থা ধ্বংস করা হয়েছে বলে পর্যবেক্ষণ দেওয়া হয় ওই রায়ে।