সাতক্ষীরা সদর হাসপাতালে এক দশক ধরে একচেটিয়াভাবে খাদ্যপণ্য ও জ্বালানি সরবরাহের পাশাপাশি কাপড় ধোলাইয়ের কাজ করে যাচ্ছে একটি প্রভাবশালী ঠিকাদারি সিন্ডিকেট। কোনো ধরনের টেন্ডার ছাড়াই আদালতে মামলা করে এবং রাজনৈতিক প্রভাব কাজে লাগিয়ে রীতিমতো সাতক্ষীরা স্বাস্থ্য বিভাগকে জিম্মি করে রাখা হয়েছে। সংশ্লিষ্টদের অভিযোগ, প্রভাবশালী ওই ঠিকাদারি সিন্ডিকেট বিগত ১০ বছরে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে। এক টেন্ডারেই সুদীর্ঘ ১০ বছর ধরে খাদ্যপণ্য ও জ্বালানি সরবরাহের পাশাপাশি কাপড় ধোলাইয়ের কাজ জবরদখল করে রেখেছে সাতক্ষীরা জেলা জাতীয় পার্টির সহ-সভাপতি ও তালা উপজেলা জাতীয় পার্টির সভাপতি নজরুল ইসলামের নেতৃত্বাধীন সিন্ডিকেটটি। সরকারি হাসপাতালে সরবরাহকৃত খাদ্যের মান ও পরিমাণ নিয়ে সাধারণ রোগীদের মধ্যে অসন্তোষ দেখা দিয়েছে। কিন্তু দেখার যেন কেউ নেই! খাবারের মান উন্নয়নে স্বাস্থ্য বিভাগেরও কোনো তৎপরতা লক্ষ্য করা যাচ্ছে না।
এ বিষয়ে সাতক্ষীরার সিভিল সার্জন ডা. আবদুস সালাম বলেন, আমি সম্প্রতি সাতক্ষীরায় যোগদান করেছি। ঠিকাদাররা যে সময় মামলা করেছিল সে সময় ১২৫ টাকা করে খাদ্য সরবরাহের রেট ছিল। বর্তমান ১৭৫ টাকা জনপ্রতি রেট হলেও তারা ১২৫ টাকা রেটেই খাদ্য সরবরাহ করছে। এই রেটে যেমন হয় তেমনই দিচ্ছে। ওই ঠিকাদারি গ্রুপই সাতক্ষীরার সব হাসপাতালে খাদ্য সরবরাহ করছে। সম্প্রতি জিপি নিয়োগ হওয়ায় সর্বশেষ গত ৯ জানুয়ারি একটি ফাইল রেডি করে আদালতের জিপি বরাবর পাঠিয়েছি। আশা করছি, আদালত সরকারের পক্ষে রায় দেবেন এবং অতি দ্রুত এই সমস্যার সমাধান হবে। আদালত রায় দিলে নতুন করে টেন্ডার আহ্বান করা হবে বলেও জানান তিনি।
অনুসন্ধানে জানা যায়, মো. নজরুল ইসলাম ২০১৩-১৪ অর্থবছরে সাতক্ষীরা সদর হাসপাতালে খাদ্যপণ্য ও জ্বালানি সরবরাহের পাশাপাশি কাপড় ধোলাইয়ের ঠিকাদারি পান। একইভাবে তার দুই ছেলে মেসার্স কামরুল অ্যান্ড আকরামুল ট্রেডার্স দেবহাটা হাসপাতাল এবং মেসার্স সরদার ট্রেডার্স সিভিল সার্জন অফিস, সেবা ইনস্টিটিউট, টিবি ক্লিনিক ও সদর উপজেলা স্বাস্থ্য অফিসের সরবরাহকারী হিসেবে ঠিকাদারি পান। এ ছাড়া কলারোয়া, কালীগঞ্জ ও শ্যামনগর হাসপাতালে সরবরাহের কাজ পায় মেসার্স শেখ সিরাজুল ইসলাম, মেসার্স ঘোষ ট্রেডার্স ও মেসার্স জলিল অ্যান্ড কনস্ট্রাকশন। তাদের কাজের মেয়াদ শেষ হওয়ার কথা ছিল ২০১৪ সালের ৩০ জুন। কিন্তু মেয়াদ শেষ হওয়ার মাত্র কয়েক দিন আগে ২০১৪ সালের ১৫ মে এবং একই বছরের ১৯ মে ঠিকাদাররা সিন্ডিকেট করে অন্যায্যভাবে সাতক্ষীরার সিভিল সার্জনের কাছে তাদের কাজের মেয়াদ বৃদ্ধির জন্য আবেদন করেন। দাবিটি অন্যায্য হওয়ায় সিভিল সার্জন ২০১৪ সালের ২৭ মে একটি জাতীয় দৈনিক পত্রিকায় টেন্ডার বিজ্ঞপ্তি আহ্বান করেন।
এরপর ওই আবেদন নিষ্পত্তি না করে টেন্ডার বিজ্ঞপ্তি দেওয়ার অভিযোগে ঠিকাদাররা সাতক্ষীরার সিভিল সার্জনকে বিবাদী করে সাতক্ষীরা যুগ্ম জেলা জজ আদালতে ২২/২০১৪ নং দেওয়ানি মামলা করেন। এরপর ওই ঠিকাদার সিন্ডিকেট তাদের প্রভাব খাটিয়ে মামলাটি দিনের পর দিন ঝুলিয়ে রাখার ব্যবস্থা করে। ওই মামলা নিষ্পত্তি না হওয়ায় বিগত ১০ বছর ধরে টেন্ডার প্রক্রিয়া আটকে রয়েছে। আর এই সুযোগ কাজে লাগিয়ে মামলাকারী সিন্ডিকেট জিম্মি করে রেখেছে সাতক্ষীরা স্বাস্থ্য বিভাগকে। টেন্ডার সিন্ডিকেটের সদস্যরা আদালতে যে ঘোষণামূলক মোকদ্দমাটি আরজি দাখিলের মাধ্যমে দায়ের করেন সেটি আদালত দেওয়ানি কার্যবিধির ৭ আদেশের ১১ বিধি অনুযায়ী খারিজ করে দেন। পরে খারিজ আদেশের বিরুদ্ধে বাদীপক্ষ জেলা জজ আদালতে আপিল করেন। কিন্তু আপিল শুনানি না হওয়ায় মামলায় শুধু তারিখের পর তারিখ পড়ছে। নজরুল ইসলামের সঙ্গে এই কাজে যুক্ত রয়েছেন শেখ আবদুস সাত্তার, শেখ সিরাজুল ইসলাম, স্বপন কুমার ঘোষ এবং মো. আবদুল জলিলের মতো ঠিকাদাররা।
এদিকে আদালতে মামলা থাকার সুযোগ নিয়ে হাসপাতালগুলোতে বিগত ১০ বছর ধরে নিম্নমানের খাবার সরবরাহ ও প্রয়োজন অনুপাতে খাবার সরবরাহ না করে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানগুলোর বিরুদ্ধে কোটি কোটি টাকা লুটের অভিযোগ উঠেছে। এর প্রতিবাদে দফায় দফায় মানববন্ধন ও প্রতিবাদ সমাবেশ করেছেন স্থানীয়রা। কিন্তু তাতেও কোনো কাজ হয়নি। সাতক্ষীরা সদর হাসপাতালের ১নং ওয়ার্ডে ১০নং বেডে চিকিৎসাধীন রাশেদুজ্জামান রুবেল বলেন, আমি চারদিন ধরে হাসপাতালে ভর্তি আছি। এখানে দুপুর ও রাতে যে খাবার সরবরাহ করা হয় তা খুবই নিম্নমানের। আসলে যে খাবার দেওয়া হচ্ছে সেটা রোগীদের জন্য উপযোগী না। আমি নিজে খেয়ে বুঝলাম। এ ছাড়া বিছানায় যে চাদর বিছানো হয়েছে সেটা পরিষ্কার না। চারদিন ধরে একটি বিছানার চাদরেই আছি। কেউ চাদর পাল্টে পরিষ্কার চাদর দেয়নি।
এ বিষয়ে টিআইবির অ্যাক্টিভ সিটিজেন গ্রুপের সমন্বয়ক (স্বাস্থ্য) মামুন অর রশিদ বলেন, সাতক্ষীরা সদর হাসপাতালের খাবারের মান নিয়ে রোগীদের মধ্যে অসন্তোষ আছে। আমরা সরেজমিন গিয়ে দেখেছি এবং রোগীদের সঙ্গে কথা বলে জেনেছি খাবারের মান খুবই নিম্নমানের। তাছাড়া যে সব কাপড় বা বেডশিট দেওয়া হয় সেগুলো প্রায়ই অপরিষ্কার থাকে। এগুলো নিয়ে রোগীদের মধ্যে সবসময় অসন্তোষ বিরাজ করে। আমরা এটা নিয়ে বিভিন্ন সময়ে সিভিল সার্জনের সঙ্গে সভা করেছি। কিন্তু কোনো ধরনের সমাধান আসেনি।
এ বিষয়ে সাতক্ষীরা জেলা নাগরিক কমিটির আহ্বায়ক অ্যাডভোকেট আজাদ হোসেন বেলাল বলেন, সাতক্ষীরা সদর হাসপাতালে আজকে প্রায় ১১ বছর ধরে কোনো টেন্ডার হয় না। উচ্চমূল্যের এই কাজটা যারা নিয়েছিল তারা বিভিন্ন কলাকৌশলে এই কাজ ১০ বছরেরও বেশি সময় ধরে চালিয়ে যাচ্ছেন। আদালতে তারা একটা ভুয়া মামলা করে রেখেছেন যেটি আদালত খারিজ করে দিয়েছিলেন। পরে তারা জেলা জজ আদালতে আপিল করেছেন। শুনানি না করে বিভিন্ন পন্থা অবলম্বন করে তারিখের পর তারিখ পিছিয়ে নিচ্ছেন।
সাতক্ষীরা সদর হাসপাতালসহ জেলার সব হাসপাতালের একই চিত্র। খাবারের মান খুবই খারাপ। রোগীদের যে পরিমাণ খাবার দেওয়া দরকার, যে বাজেটের খাবার দেওয়া দরকার তা দেওয়া হয় না। এতে রোগীরা তাদের ন্যায্য অধিকার থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। এ বিষয় নিয়ে নাগরিক কমিটি সবসময় সরব। কিন্তু প্রভাবশালী সিন্ডিকেটের কারণে কোনো সমাধান হচ্ছে না। এই ঠিকাদারি সিন্ডিকেটের নেতৃত্বে রয়েছেন জাতীয় পার্টির প্রভাবশালী নেতা নজরুল ইসলাম। তিনি রাজনৈতিক প্রভাব খাটিয়ে ও সাবেক স্বাস্থ্যমন্ত্রী ডা. আ ফ ম রুহুল হক, সাবেক এমপি মীর মোস্তাক আহমেদ রবিসহ সংশ্লিষ্টদের ম্যানেজ করে বিগত ১০ বছর ধরে জিম্মি করে রেখেছেন সাতক্ষীরা স্বাস্থ্য বিভাগকে।