আমি এমা হল। মাত্র ৩২ বছর বয়সে আমার ক্যানসার ধরা পড়ে। পুরো একটা বছর ক্যানসার আর কেমোর সঙ্গে জড়িয়ে ছিল আমার জীবন। ২০২৪ সালের ৫ জানুয়ারি অর্থাৎ মাত্র এক বছর আগে জীবন জড়িয়ে ছিল ক্যানসারের সঙ্গে। আমার জানা ছিল না যে, ক্যানসার কোষ চলে গেলেও, এসব রোগীর জীবনে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে থাকে ক্যানসার। আমার হয়েছিল স্তন ক্যানসার। ধরা পড়ার আগেই সেটি পৌঁছে গেছে তৃতীয় স্টেজে। শুরু হয় আমার জীবনের সবচেয়ে কঠিন বছর।
বদলে যাওয়া
আমার জীবন পুরোপুরি বদলে গেল। বিপর্যস্ত জীবন, রোগ নির্ণয়, ৫ মাসের কেমো, স্তন অপসারণ, রেডিওথেরাপি এবং ক্যানসার থেকে দূরে থাকার আজীবন চলমান চিকিৎসা নিয়েই বয়ে গেল সেই বছরটি। মনে হতো, আমার অনেক বয়স হয়ে গেছে। মেনোপজে পৌঁছে গেছি। এখন ওষুধ খেলে ডায়রিয়া আমার নিত্যদিনের সঙ্গী। এক বাক্যে বললে, ডায়রিয়া মেনে নেওয়া আর বাম স্তন অপসারণ ছাড়া এই এক বছরে আমার হারানোর কিছু ছিল না। অথচ আমি এক নিস্তব্ধতার রাজ্যে হারিয়ে যাচ্ছিলাম। সেখান থেকে ফেরার রাস্তা জানা ছিল না আমার। কাউকে বলারও কিছু ছিল না। চেপে ধরেছিল এক গভীর বিষণ্নতা।
আমি তো আমার ক্যানসারের সঙ্গে পথচলার গল্পটিই সবাইকে বলতে চাইছি। তা হলে কোথা থেকে শুরু করব? রোগ নির্ণয় থেকেই করি। সেটাই সহজ হবে। তিনবার আমাকে টেস্ট করতে হয়েছিল। বাম স্তনবৃন্তের পাশেই একটি সন্দেহজনক পিণ্ডের উপস্থিতি দেখতে পান চিকিৎসক। সেটা টের পেয়েই দায়িত্বশীল নারীর মতো আমি হাসপাতালে যাই। প্রাথমিক চেকআপের পর চিকিৎসক আমাকে সোজা বায়োপসি রুমে নিয়ে গেলেন। সেখানে একটি নয়, ৬টি পিণ্ড থেকে আলামত নেওয়া হলো। তবে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করার সময় রেডিওগ্রাফারদের গম্ভীর চোখ ও সাংকেতিক শব্দ আমার নজর এড়ায়নি। রিপোর্ট পেতে দুসপ্তাহ লাগবে। এই সময়ে অসংখ্য চেনাজানা মানুষ আমাকে ধৈর্য ও আশা রাখতে বলেছিলেন। ততক্ষণে আমি জানতাম এক কঠিন পরিস্থতির ভেতরে পড়তে যাচ্ছি আমি।
কোথায় গড়াচ্ছে জল
আমি লিভারপুলের মেয়ে। স্বামীর সঙ্গে বর্তমানে লন্ডনে থাকি। সেদিনের পরীক্ষা-নিরীক্ষা শেষে হাসপাতাল থেকে বাসায় ফিরি। মিষ্টি নরম রোদ মেখে কেক খাই। পৃথিবীর সবকিছুই যথাযথ ও সুন্দর মনে হয়। কিন্তু আমার এই অনুভূতি বেশিদিন স্থায়ী হয়নি। রিপোর্টের ব্যাপারে আঁচ করতে পেরেছিলাম। তবে পুরোটা জানতাম না। সেদিন হাসপাতালে গিয়ে আমি জানতে পারি স্টেজ থ্রি ক্যানসারের জন্য আট রাউন্ড কেমো নিতে হবে আর বাম স্তন পুরোপুরি অপসারণ করতে হবে আমাকে। পৃথিবীর রং ততক্ষণে ধূসর হতে শুরু করেছে। একনাগাড়ে এসব কথা বলার পর একটু আশার বাণী শোনাবার জন্য থামলেন ডাক্তার। এটি নিরাময়যোগ্য তবে কেমো শেষে আরও পরীক্ষা-নিরীক্ষার প্রয়োজন। অর্থাৎ চিকিৎসকও নিশ্চিত নন।
মাত্র ৩২ বছর বয়সে আমার স্তন অপসারণ করা হয়। আমার ডিম্বাণু সংরক্ষণ করে রাখা হয়। চিকিৎসার শেষে আমি তৃতীয়বার রিপোর্ট নিয়ে ডাক্তারের মুখোমুখি হয়েছিলাম। ধারণা করে রেখেছিলাম ডাক্তার গম্ভীর গলায় বলবেন, আমার হাতে মাত্র কয়েক মাস সময় আছে। আমার বোন আমার মনের খবর জানত না। নির্ধারিত দিনে তিনি আমাকে হাসপাতালে নিয়ে গেলেন। এক অনিবার্য আতঙ্কে আমি ভেতরে ভেতরে শিউরে উঠছিলাম বারবার। কিন্তু ডাক্তারের মুখোমুখি হওয়ার পর সব বদলে গেল। তিনি বললেন, আমার শরীরে আর কোথাও ক্যানসার ছড়ায়নি। আমি আগের চেয়ে ভালো আছি। তবে আরও ভালো থাকার জন্য আজীবন কিছু নিয়ম-কানুন মেনে চলতে হবে। আনন্দে চিৎকার করে উঠলাম আমি।
শেষের শুরু
শুরু হলো ক্যানসার-পরবর্তী জীবন। ক্যানসার নির্ণয় ও কেমো শুরুর ব্যাপারটা এত হুড়মুড়িয়ে ঘটে গেল যে তেমন করে ঠাহর করতে পারিনি। আমার জানা ছিল না, ক্যানসারমুক্ত জীবনের কোনো না কোনো ক্যানসারকে বহন করতে হয় আজীবন। সেখান থেকে মানুষের মুক্তি নেই। ভালো থাকার জন্য চিকিৎসক আমাকে রিট্রিট সেন্টারে যাওয়ার পরামর্শ দিলেন। ভেবেছিলাম সেখানে গেলে মানুষের সঙ্গে ক্যানসারের ভয়াবহ অভিজ্ঞতা স্বীকার করে নিলে আমার কষ্ট কমবে। কিন্তু মানুষ ভাবে এক, হয় আরেক।
রিট্রিট সেন্টারটি ফার্মহাউজে। এক সন্ধ্যায় খাড়া কর্দমাক্ত রাস্তা ধরে সেখানে যাচ্ছি আমি। যতই ওপরে উঠছি আমার ফোনের নেটওয়ার্ক ততই কমছে। এক পর্যায়ে তা মিলিয়ে গেল। সেখানে পৌঁছে যেতেই আমাকে অভ্যর্থনা জানাল ডেভিড। আমিসহ সেখানে অংশগ্রহণকারীর সংখ্যা ১৫। সেখানে সবাই সবার আশা-নিরাশার বাণী শোনাই, নিজেকে অন্যের আয়নায় দেখি কিংবা কারও দুঃখে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠি। নিজের কথা বলার সময় মনে হয় দিনে দিনে মানসিকভাবে শক্তিশালী হয়ে উঠছি। সবার গল্প শোনা শেষ হয়ে গেলে এক আশ্চর্য নীবরতা আমাদের ঘিরে ধরে। সেই নীরবতাই আমাদের সার্বক্ষণিক সঙ্গী।
কিভাবে কাটছে দিন
সেখানে ৫ দিন থাকতে হবে আমাদের। এই ৫ দিন কারও সঙ্গে যোগাযোগ করতে না পারার বেদনা আমাকে ঘিরে ধরে। প্রথমে ভেবেছিলাম নতুন মানুষদের পেয়ে আমার দুঃখময় মুহূর্তগুলোকে ভুলে থাকতে পারব আমি। কিন্তু সেরকম কিছু হলো না। ফোনের স্ক্রিন আমাদের জাগতিক দুঃখ ভুলে থাকার উপকরণ বটে, কিন্তু সেসব ছাড়া নিজস্ব দুঃখবোধ দিনে দিনে আরও আঁকড়ে ধরে আমাকে।
সেদিন রাতে আর কিছু ঘটেনি। পরদিন ভোরে উঠতে হলো আমাদের। ১৫ জন মানুষ ভোর সোয়া ৫টা নাগাদ উঠোনে হালকা ব্যায়ামের জন্য বেরিয়ে এসেছি। কুয়াশায় চারপাশ দেখা যাচ্ছে না তেমন। ব্যায়ামের পর শুরু হয় মেডিটেশন (ধ্যান)। সবার চোখ বন্ধ। ডেভিড যতই আমাদের নিশ্বাসের দিকে মনোযোগ দিতে বলেন, ততই সবাই ফোঁস ফোঁস করে নিশ্বাস ফেলি আমরা। কিছুক্ষণ পর আমরা শুনলাম এক নারী ফুঁপিয়ে কাঁদছেন। ধ্যানের আসনের কারণে রক্ত চলাচল বন্ধ হয়ে আমার পা ততক্ষণে অসাড়। আর এসব সাড়-অসাড়ের বালাই না রেখে ওই নারী নিজস্ব দুঃখবোধের কাছে পৌঁছে গেছেন! কীভাবে সম্ভব?
থেরাপির ছায়ায়
আমাদের চিন্তাভাবনাগুলো পর্যবেক্ষণের পরামর্শ দেন ডেভিড। মানুষের আচরণগত মিথস্ক্রিয়াগুলো যেন আমাদের অন্তরকে জাগিয়ে তোলে। কিন্তু আমরা কেউই বোধহয় সেসব অনুভব করতে পারিনি। প্রত্যেকের চারপাশে একটি থকথকে নির্জীব নীরবতা সবসময়ের জন্য আমাদের সবাইকে ঘিরে রেখেছিল। সেসব পেরিয়ে মানুষের উপস্থিতি আমাদের আন্দোলিত করতে সক্ষম নয়। অথচ এই সত্যটাও ডেভিড জানত। আমাদের রিট্রিট সেন্টারটির ডরমেটরি ছিমছাম। পাশেই হাসপাতালের একটি মেডিকেল ইউনিট। সেখানে মানসিক রোগীরা সারারাত কাঁদত। তাদের বিলাপ ও চিৎকারে রাতের নির্জনতা পালিয়ে পথ পেত না। সেই চিৎকারে কেমো দেওয়ার টুকরো টুকরো স্মৃতি ফিরে আসত আমার। একদিন এমন হয়েছে যে ৬ বারের চেষ্টার পরও কেউ আমাকে ক্যানুলা দিতে পারছিলেন না। একটি জরুরি এন্টিবায়োটিকের জন্য ক্যানুলা লাগানো জরুরি হয়ে পড়েছিল সেদিন। কিন্তু সেদিন শিরা খুঁজে পাওয়া যাচ্ছিল না। পরে ভ্যাম্পায়ার নামে এক কর্মী এগিয়ে এলো। এক চাপে ক্যানুলা লাগিয়ে ফেললেন তিনি। আর আমি ব্যথায় চিৎকার করে কাঁদছি। মাত্র কয়েক সপ্তাহ আগের ঘটনা। অথচ সেই জীবন মৃত্যুর সন্ধিক্ষণও পেরিয়ে এসেছি আমি। সবকিছু কী আশ্চর্য লাগে আমার কাছে!
মেডিটেশন
পরদিন সকালে আবার মেডিটেশন হলে জড়ো হই সবাই। কয়েকদিনে মন শান্ত হয়ে এসেছে। ক্যানসার ও জীবনকে স্বাগত জানানোর সময় এখন। প্রথম পাঁচ মিনিটে আমি অনেক কেঁদেছি। ডেভিডের সঙ্গে একান্ত কথোপকথনে অঝোরে কাঁদতে কাঁদতে আমি স্বীকার করেছি যে, নিজের ক্যানসারকে স্বীকার করে নিতে আমার কষ্ট হয়েছে। ক্যানসার হয়েছে আমি সেটি স্বীকার করতে রাজি নই এখনও।
সেদিনের পর আমার ডায়রিয়া সেরে গেল। মনের সঙ্গে নিরাময়ের কত বড় সংযোগ এর আগে কখনো হাতেকলমে দেখা হয়নি। একে একে আমি স্বীকার করে নিই যে, ক্যানসার নিয়ে আমার দুঃখবোধের কারণটি অনির্ণেয়। হ্যাঁ, আমি মারা যেতে পারতাম কিন্তু বেঁচে আছি তো। কেমো আমাকে সন্তানহীন করেছে, আমি সম্ভবত আর কখনো মা হতে পারব না। তবে হাসপাতালের ফ্রিজারে আমার ডিম্বাণু সংরক্ষিত আছে। আমার সব চুল পড়ে গেছে। এখন আবার নতুন চুল গজাচ্ছে। তবে এসব বিকল্প আমাকে শান্তি দেয়নি। আমি কেবল দুঃখকে আঁকড়ে ধরেছি। ফলে আমার দুঃখবোধ আমাকে সবসময় ঘিরে রাখার সুযোগ পাচ্ছে।
বিষণ্নতার অবসান
শেষ কবে হেসেছিলাম সেটি জানি না। এক বিষণ্ন বিকালে মুরল্যান্ডের মধ্য দিয়ে ঘুরতে ঘুরতে আমি একপাল হরিণের মুখোমুখি হই। ততক্ষণ সেই পাল উপত্যকায় মিলিয়ে যাচ্ছে ততক্ষণ পর্যন্ত তাকিয়ে থাকি। আবার ফার্মহাউজে ফিরে রোদ মেখে কেক খাই। সবকিছুই আগের মতোই যথাযথ আর সুন্দর মনে হয়। আনন্দের সঙ্গে দুঃখের সম্পর্ক বোঝার চেষ্টা করি।
১৫ জন মানুষের সঙ্গে রিট্রিট সেন্টারের থেরাপি আমাকে বদলে দিয়েছে। আমি বুঝতে শিখেছি পৃথিবীর কোথাও নিরাপদ স্থান বলে কিছু নেই। আমরা প্রত্যেকে অসংখ্য ট্রমা নিয়ে বড় হই। ভুল উপায়ে সেটি বেরিয়ে আসতে পারে। নিস্তব্ধতা ভেদ করে একটা প্রচণ্ড আর্তনাদ কাউকে পর্যুদস্ত করে ফেলতে পারে। তবে সেসব অনুভূতি স্বীকৃতির দাবিদার। সেদিন ডরমে ফিরে ফোন নিয়ে বেরিয়ে পড়ি। রাস্তার ঢাল বেয়ে নিচে নামতেই নেটওয়ার্কের আভাস মেলে। মেডিটেশন শেষে এক অজানা আতঙ্ক আমাকে গ্রাস করে রেখেছিল। স্বামী জনকে ফোন করি। মেডিটেশন যত গভীর হয় ক্যানসারকে তত কাছ থেকে দেখা শুরু করি আমি। একেক সময় আমার মনে হচ্ছিল আমার শিরা বয়ে বুঝি আবারও কেমো প্রবাহিত হচ্ছে, এবার বুঝি আর বাঁচব না। আমি মেনে নিয়েছি, ক্যানসার হলো সেই ভয়াবহ অনুভূতি যেটা আমাকে মৃতপ্রায় করে দিচ্ছিল বারবার। ধ্যানের জগতে আমি নিজেকে দেখতে পেয়েছি। ধীরে ধীরে ভয় কাটিয়ে নিজের প্রতি সহজ হয়ে উঠেছি। আমি এখন নীরবতা পছন্দ করি। নিজের সঙ্গে
কথোপকথন আরও দীর্ঘ হয় এখন। কেবল কড়া কফি খেলেই ডায়রিয়া ফিরে আসে। আমার বেঁচে থাকাকে সহজ করে তোলে মনের সঙ্গে জীবনের সংযোগ।
তথ্যসূত্র : দ্য গার্ডিয়ান