ই-পেপার বুধবার ২২ জানুয়ারি ২০২৫
বুধবার ২২ জানুয়ারি ২০২৫
ই-পেপার

বুধবার ২২ জানুয়ারি ২০২৫

বিবিসির প্রতিবেদন
খালার আমলে মানুষ গুমের পরও টিউলিপকে কেন মন্ত্রী করলেন স্টারমার
প্রকাশ: বুধবার, ২২ জানুয়ারি, ২০২৫, ১:৩১ এএম  (ভিজিট : ১৮২)
মীর আহমেদ বিন কাসেমকে যখন রাতে সশস্ত্র ব্যক্তিরা বাড়ি থেকে অপহরণ করে নিয়ে যান, তখন সেখানে তার ৪ বছরের কন্যাও ছিল। কিন্তু ছোট এই শিশুটি বুঝতেই পারেনি কী ঘটতে চলেছে।
আহমেদ বিন কাসেম বলেন-তারা আমাকে টানাহ্যাঁচড়া করে নিয়ে যাচ্ছিল, আমি ছিলাম খালি পায়ে। ছোট মেয়েটা আমার জুতা হাতে নিয়ে পিছু পিছু দৌড়ে আসছিল। বলছিল, নাও, বাবা। মনে হয়, সে ভাবছিল, আমি বাইরে যাচ্ছি।

মীর আহমেদকে ৮ বছর বিনা বিচারে আটকে রাখা হয়েছিল। এ সময় তার হাত ও চোখ থাকত বাঁধা। তিনি আজও জানেন না, কোথায় ছিলেন, কেনইবা তাকে এতদিন আটকে রাখা হয়েছিল।
যুক্তরাজ্যে প্রশিক্ষিত এই ব্যারিস্টার (৪০) বাংলাদেশে ‘গুম’ হওয়া মানুষের একজন। শেখ হাসিনার 
শাসনামলে গুম হওয়া এই ব্যক্তি ছিলেন তার সমালোচক। গত আগস্টে ছাত্রজনতার অভ্যুত্থানে ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার আগপর্যন্ত ২০ বছরের বেশি সময় বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী ছিলেন হাসিনা।

১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের পর হাসিনার আমলেই সবচেয়ে বেশি সহিংসতা দেখেছে বাংলাদেশ। নিহত হয়েছেন শত শত মানুষ। তার ক্ষমতায় আঁকড়ে থাকার শেষ দিনটিতেও অন্তত ৯০ জন নিহত হন।
অত্যন্ত নিষ্ঠুর হাসিনা যুক্তরাজ্যের ক্ষমতাসীন লেবার পার্টির আইনপ্রণেতা (এমপি) টিউলিপ সিদ্দিকের খালা। নিজের বিরুদ্ধে দুর্নীতির একাধিক অভিযোগ ওঠার পর গত সপ্তাহে টিউলিপ প্রধানমন্ত্রী কিয়ার স্টারমারের দুর্নীতি প্রতিরোধবিষয়ক মন্ত্রীর পদ থেকে পদত্যাগ করেন। যদিও অভিযোগ অস্বীকার করেছেন তিনি ।

অভিযোগগুলোর একটি হলো-বাংলাদেশের অবকাঠামোগত ব্যয় থেকে ৩৯০ কোটি পাউন্ড ( প্রায় ৫৮ হাজার ১১০ কোটি টাকা) পর্যন্ত আত্মসাৎ করেছে টিউলিপের পরিবার। এ ছাড়া লন্ডনে তিনি তার খালার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ঘনিষ্ঠ ব্যক্তিদের সম্পত্তি ব্যবহার করেছেন।

কিয়ার স্টারমার সরকারের তদন্তে মন্ত্রিত্বের আচরণগত নীতিমালা টিউলিপ ভাঙেননি বলে দেখা গেছে। তবে যেকোনোভাবেই হোক পদত্যাগ করেছেন তিনি।যদিও বিষয়টির এখানেই শেষ হয়ে যাওয়া আবশ্যকীয় নয়।

কিয়ার স্টারমারের জন্য প্রশ্ন
এ ঘটনা কিয়ার স্টারমারের বিবেচনাবোধ ও বাংলাদেশি বংশোদ্ভূতদের ভোট আকর্ষণে লেবার পার্টির দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে যন্ত্রণাদায়ক নানা প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে।

ঘুরপাক খাওয়া প্রশ্নগুলোর একটি, কেলেঙ্কারিতে জড়িয়ে পড়া খালার সঙ্গে টিউলিপের যে সংশ্লিষ্টতা রয়েছে, সে বিষয়ে অনেক আগে থেকে জানার পরও লেবার পার্টি এখনকার ঘটনা আঁচ করতে পারল না কেন। কেননা, হাসিনার আমলে সেই ২০১৬ সালেই বিন কাসেমের ঘটনা প্রথম প্রকাশ্যে এসেছিল।
বিন কাসেম ও অন্য বাংলাদেশিদের ‘গুম’ হওয়ার ঘটনা মানবাধিকার বিষয়ে ওই সময় থেকে টিউলিপের সোচ্চার হওয়া নিয়ে একটা অসামঞ্জস্যপূর্ণ ভাবনারও জন্ম দিয়েছে।

উদাহরণ হিসেবে, নিজ নির্বাচনি এলাকার বাসিন্দা নাজানিন জাঘারি র‌্যাটক্লিফকে ইরান থেকে মুক্ত করার জন্য দীর্ঘ প্রচার চালিয়েছেন টিউলিপ। বিপরীতে বাংলাদেশে তার খালার শাসনামলে লোকজনের দুঃখ-দুর্দশা এবং বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড নিয়ে জনসমক্ষে বক্তব্য দেওয়ার ক্ষেত্রে টিউলিপের নির্লিপ্ততা ছিল উল্লেখ করার মতো।

অতীতে রুশ প্রেসিডেন্ট পুতিনের সঙ্গে তার খালার বৈঠকে টিউলিপকে পাশে দেখা গেছে। আওয়ামী লীগের মুখপাত্র হয়ে বিবিসি টেলিভিশনেও হাজির হয়েছেন তিনি। ১৯৮১ সাল থেকে দলটির নেতৃত্বে দিয়ে আসছেন হাসিনা।

যুক্তরাজ্যে লেবার দল থেকে ২০১৫ সালে এমপি নির্বাচিত হতে সহায়তা করায় আওয়ামী লীগের সদস্যদের ধন্যবাদও জানিয়েছিলেন টিউলিপ। দলটির সঙ্গে নিজের সংশ্লিষ্টতার বিষয়ে তিনি ২০০৮ ও ২০০৯ সালে তার ওয়েবসাইটে ২ পৃষ্ঠাজুড়ে বর্ণনা দেন। পরে তা মুছে ফেলা হয়।

যদিও একসময় পার্লামেন্টে টিউলিপ সাংবাদিকদের উদ্দেশে বলেছিলেন, ‘বাংলাদেশের রাজনীতিতে প্রভাব খাটানোর কোনো সক্ষমতা বা আকাক্সক্ষা’ তার নেই।

সব মিলিয়ে, আওয়ামী লীগের সঙ্গে টিউলিপের সংশ্লিষ্টতা গোপন ছিল না। তবে সম্ভবত লেবার পার্টি এ সংশ্লিষ্টতাকে খারাপ হিসেবে দেখেনি। বিশেষ করে সাম্প্রতিক বছরগুলোয় আওয়ামী লীগের সঙ্গে দলটির দূরত্ব বজায় রাখার লক্ষণ খুব কমই দেখা গেছে।

তৎকালীন লেবার পার্টির এমপি জিম ফিজপ্যাট্রিক ২০১২ সালে কমন্স সভায় বলেছিলেন, তারা ‘সহযোগী সংগঠন’। একই রকম ধারণা পোষণ করতেন তার অনেক সহকর্মীও।২০১৫ সালে স্টারমারও টিউলিপের পাশের আসন থেকে নির্বাচিত হয়ে পার্লামেন্টে প্রবেশ করেন। একাধিকবার হাসিনার সঙ্গে দেখা করেছেন তিনি।

হাসিনার সঙ্গে স্টারমারের এমন এক সাক্ষাৎ ঘটেছিল ২০২২ সালে। বাংলাদেশের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী হাসিনা ওই সময় রানী দ্বিতীয় এলিজাবেথের শেষকৃত্যানুষ্ঠানে যোগ দিতে লন্ডনে ছিলেন। ওই বৈঠককে ‘হৃদয়বিদারক ও মর্মন্তুদ’ বলে আখ্যায়িত করেন বিন কাসেম।

তবে স্টারমারের একজন সহযোগী যুক্তি দিয়ে বলেন, হাসিনার সঙ্গে স্টারমারের ওই সাক্ষাৎ করা ছিল ‘খুবই যৌক্তিক’। বৈঠকটি হাসিনার নীতির প্রতি তার সমর্থনের বহিঃপ্রকাশ ছিল না।

বাংলাদেশকে বছরের পর বছর লেবার পার্টির পাশে রাখার দৃশ্যত এমন চেষ্টা ছিল যুক্তরাজ্য, বিশেষ করে রাজধানী লন্ডনের অংশবিশেষের রাজনৈতিক বাস্তবতারই হয়তো প্রতিফলন।

লেবার পার্টির একজন বিশিষ্ট নেতা বিষয়টিকে এভাবে ব্যাখ্যা করেন, বাংলাদেশি ভোট না বুঝে পূর্ব লন্ডনে আপনি সফল হতে পারবেন না। তিনি আরও বলেন, ‘আপনার কথা ও কাজের মধ্যে সতর্কভাবে ভারসাম্য বজায় রাখা উচিত। আপনি যদি একটি দলের (বাংলাদেশি) ব্যাপারে অতিরিক্ত খোলামেলাভাব দেখান, তবে আপনার সমালোচনা হবেই।’

দ্য ফিন্যান্সিয়াল টাইমসের (এফটি) এক বিশ্লেষণে এমন ইঙ্গিত পাওয়া যায়, যুক্তরাজ্যের অন্তত ১৭টি আসনে ভোটার হওয়ার উপযুক্ত বয়সি বাংলাদেশিদের মধ্যে লেবার সংখ্যাগরিষ্ঠতা বেশি।
স্টারমারের হলবর্ন ও সেন্ট প্যানক্রাস আসনে বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত প্রাপ্তবয়স্ক ব্যক্তির সংখ্যা অন্তত ৬ হাজার।

সম্ভাব্য অনাবিষ্কৃত উদ্বেগের ক্ষেত্র : গত জুলাইয়ে নির্বাচনে জেতার অল্প পরই স্টারমার যুক্তরাজ্যের দুর্নীতিবিরোধী প্রচেষ্টায় নেতৃত্ব দিতে টিউলিপকে নিয়োগ দেন। ওই সময় আওয়ামী লীগের প্রতি লেবার পার্টির সহানুভূতি ও লন্ডনের রাজনৈতিক বাস্তবতাই কি দুর্নীতি নিয়ে সম্ভাব্য ঝড়ের ব্যাপারে স্টারমারের বিচারবোধ মøান করে দিয়েছিল? উঠেছে এমন প্রশ্ন।

একটি লেবার সূত্র বলেছে, ‘নিজের বন্ধুবান্ধব ও রাজনৈতিক সহকর্মীদের প্রতি স্টারমারের অন্ধভক্তি রয়েছে। এটা নতুন কিছু নয়।’

অনুসন্ধানী সাংবাদিক ডেভিড বার্গম্যান বাংলাদেশের রাজনীতির সঙ্গে টিউলিপের এক দশকের সংশ্লিষ্টতার ওপর আলোচনা করেছেন। এ ক্ষেত্রেও তিনি ‘পটভূমিই সবকিছু’ বলে ইঙ্গিত দেন। তিনি বলেন, ‘লেবার পার্টির ক্ষমতায় আসা ও টিউলিপ সিদ্দিক মন্ত্রী হওয়া এবং আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের আগে এটি (টিউলিপকে নিয়ে হইচই, তার সম্ভাব্য পদত্যাগ ও সরকারের ঝামেলায় পড়া) কোনো বড় গল্প ছিল না।’

বার্গম্যানের যুক্তি, অনেক বছর আগেই টিউলিপের ব্যাপারে লেবার পার্টির কারও না কারও উদ্বেগ প্রকাশ করা উচিত ছিল। টিউলিপকে নিয়ে প্রথম অনাবিষ্কৃত উদ্বেগের ক্ষেত্র ছিল, বাংলাদেশে জোর করে গুমের ঘটনায় তার সাড়া দেওয়ার ব্যর্থতার বিষয়টি। এরপরের ক্ষেত্রটি ছিল আওয়ামী লীগের সঙ্গে তার সংশ্লিষ্টতার বিষয়টি।

এ বিষয়ে লেবার পার্টির এমপিদের কাছে জানতে চাইলে তারা বলেন, ব্রিটিশ গণমাধ্যমের পাশাপাশি লেবার পার্টির মধ্যে বাংলাদেশকে নিয়ে জানার ঘাটতি আছে। যুক্তরাজ্যে প্রায় ৬ লাখ বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত ব্রিটিশ রয়েছেন। তাদের কথায়, এটি বিশ্বের অষ্টম বৃহৎ জনসংখ্যার দেশ। অথচ ৫ আগস্টের পর এখানকার গণমাধ্যমের কাছ থেকে বাংলাদেশকে নিয়ে আমরা কোনো খবর শুনিনি।
হাসিনার বিরুদ্ধে আরও কিছুদিন দুর্নীতির তদন্ত চলতে পারে। ফলে টিউলিপ লেবার পার্টির এমপি থাকতে পারবেন কি না, সামনের মাসগুলোয় সেটিও স্টারমারের শীর্ষস্থানীয় কর্মকর্তাদের জন্য সম্ভাব্য আলোচ্য বিষয় হয়ে উঠতে পারে।

হাসিনা সরকারের পতনের পর আহমেদ বিন কাসেমকে হঠাৎই তার কক্ষ থেকে জাগিয়ে তোলা হয়। পরে একটি গাড়িতে উঠিয়ে খাদে ফেলে দেওয়া হয়। শেষবধি তিনি বাড়িতে তার দুই মেয়ের কাছে ফিরতে পেরেছেন।

এর আগে সর্বশেষ ২০১৬ সালে বিন কাসেম যখন সন্তানদের দেখেছিলেন, তখন বয়সে তারা ছিল শিশু। এখন তারা কিশোরী। অশ্রুসিক্ত এই বাবা বলেন, আসলেই আমি ওদের চিনতে পারিনি, আর তারাও আমাকে চিনতে পারেনি।




https://www.shomoyeralo.com/ad/1698385080Google-News-Update.jpg

সর্বশেষ সংবাদ

সর্বাধিক পঠিত


ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক : সৈয়দ শাহনেওয়াজ করিম, আমিন মোহাম্মদ মিডিয়া কমিউনিকেশন লিমিটেড এর পক্ষে প্রকাশক গাজী আহমেদ উল্লাহ। নাসির ট্রেড সেন্টার, ৮৯, বীর উত্তম সি আর দত্ত সড়ক (সোনারগাঁও রোড), বাংলামোটর, ঢাকা।
ফোন : +৮৮-০২-৯৬৩২৩৬৮-৭৪, ফ্যাক্স : +৮৮-০২-৯৬৩২৩৭৫ | ই-মেইল : shomoyeralo@gmail.com
close