ই-পেপার বুধবার ২২ জানুয়ারি ২০২৫
বুধবার ২২ জানুয়ারি ২০২৫
ই-পেপার

বুধবার ২২ জানুয়ারি ২০২৫

ঢাকা-বেইজিং সম্পর্ক
দৃঢ় অংশীদারত্বের প্রতিশ্রুতি পুনর্ব্যক্ত
প্রকাশ: বুধবার, ২২ জানুয়ারি, ২০২৫, ১:১৬ এএম  (ভিজিট : ৯০)
এলডিসি (স্বল্পোন্নত দেশ) থেকে উত্তরণের পরের ৩ বছর ধরে চীনা বাজারে বাংলাদেশি পণ্যের শুল্ক ও কোটামুক্ত প্রবেশাধিকার অব্যাহত রাখার আশ্বাস পাওয়া গেছে। নীতিগতভাবে ঋণ পরিশোধের সময়কাল বাড়ানোর বিষয়ে সম্মত এবং ঋণের সুদের হার হ্রাসের অনুরোধ খতিয়ে দেখার আশ্বাস দিয়েছে চীন।

বাংলাদেশি রোগীদের চিকিৎসার জন্য কুনমিংয়ে ৩/৪টি বিশ্বমানের হাসপাতাল বিশেষভাবে মনোনীত করবে চীন। পাশাপাশি ঢাকাতেও একটি বিশেষায়িত চীনা হাসপাতাল প্রতিষ্ঠা করা হবে। বাংলাদেশের পররাষ্ট্র উপদেষ্টা এবং চীনের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর মধ্যে মঙ্গলবার বেইজিংয়ের একটি রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবনে দ্বিপক্ষীয় বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। ওই বৈঠক থেকে এমন তথ্য পাওয়া গেছে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন যে, এই বৈঠকের মধ্য দিয়ে দুই পক্ষের সম্পর্ক নতুন মাত্রায় উন্নীত হয়েছে।

পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় মঙ্গলবার রাতে জানিয়েছে, বেইজিংয়ের একটি রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবনে পররাষ্ট্র উপদেষ্টা মো. তৌহিদ হোসেন এবং চীনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ওয়াঙ ই-য়ের মধ্যে মঙ্গলবার সকালে অনুষ্ঠিত দ্বিপক্ষীয় আলোচনায় বাংলাদেশ ও চীন ‘ব্যাপক কৌশলগত সহযোগিতামূলক অংশীদারত্বে’র প্রতি তাদের প্রতিশ্রুতি পুনর্ব্যক্ত করেছে। চীনা পররাষ্ট্রমন্ত্রীর আমন্ত্রণে উপদেষ্টা তৌহিদ হোসেন চীনে সরকারি সফর করছেন। বাণিজ্য ও পানিসম্পদ মন্ত্রণালয় এবং অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা পররাষ্ট্র উপদেষ্টার সফরসঙ্গী হিসেবে দ্বিপক্ষীয় বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন। পররাষ্ট্র উপদেষ্টার দায়িত্ব গ্রহণের পর মো. তৌহিদ হোসেন বন্ধুপ্রতিম রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে প্রথমবারের মতো চীনে দ্বিপক্ষীয় সফর করছেন। চলতি বছর দুই দেশের সম্পর্কের ৫০ বছর পূর্তি হয়েছে।

দ্বিপক্ষীয় আলোচনার আগে চীনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ওয়াং ই বাংলাদেশের উপদেষ্টা তৌহিদ হোসেনকে উষ্ণ অভ্যর্থনা জানান। উন্নয়ন সহযোগিতা, বাণিজ্য ও বিনিয়োগ, অবকাঠামো উন্নয়ন, খাতভিত্তিক সহযোগিতা এবং দুই দেশের জনগণের মধ্যে যোগাযোগসহ সম্পর্কের সব বিষয়ে দ্বিপক্ষীয় বৈঠক অত্যন্ত সৌহার্দপূর্ণ পরিবেশে অনুষ্ঠিত হয়। বৈঠকে উভয় পক্ষ পারস্পরিক স্বার্থের ক্ষেত্রে সহযোগিতা আরও গভীর করার এবং ভাগাভাগি সমৃদ্ধির সুযোগ কাজে লাগানোর প্রতিশ্রুতি ব্যক্ত করেছে।

বাংলাদেশে চলমান উন্নয়ন প্রকল্পগুলো বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে চীনের সমর্থন ও সহযোগিতা অব্যাহত থাকবে, এমন তথ্য উল্লেখ করে দ্বিপক্ষীয় বৈঠকে চীনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ওয়াং ই বলেন, চীন বাংলাদেশের সার্বভৌমত্ব এবং আঞ্চলিক অখণ্ডতার প্রতি শ্রদ্ধাশীল এবং বাংলাদেশের স্থিতিশীলতা, সংস্কার, গণতান্ত্রিক উত্তরণ এবং উন্নয়নমূলক উদ্যোগের প্রতি চীনের অব্যাহত সমর্থন থাকবে। বাংলাদেশের জনগণ অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব দিয়েছেন, যিনি দেশের সভ্যতা ও ঐক্য বজায় রাখার জন্য কাজ করেছেন। চীন তার কূটনীতিতে প্রতিবেশী দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশকে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ মনে করে। বৈঠকে চীনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী গত জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের ফাঁকে অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে তার ফলপ্রসূ বৈঠকের কথা স্মরণ করেন।

বৈঠকে বাংলাদেশের পররাষ্ট্র উপদেষ্টা মো. তৌহিদ হোসেন জোরালোভাবে বলেন, দুই পক্ষের সম্পর্কে বাংলাদেশ নতুন গতি (আরও বেগবান) সঞ্চার করতে চায়। যার প্রতিফলন হচ্ছে প্রথম দ্বিপক্ষীয় সফর হিসেবে পররাষ্ট্র উপদেষ্টার চীন সফর। বৈঠকে পররাষ্ট্র উপদেষ্টা ‘এক চীন নীতি’র প্রতি বাংলাদেশের দৃঢ় প্রতিশ্রুতি এবং জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের ২৭৫৮ নম্বর প্রস্তাবের প্রতি অটল সমর্থন পুনর্ব্যক্ত করেন। তিনি উল্লেখ করেন যে, ২০২৪ সালের জুলাই-আগস্ট আন্দোলন বাংলাদেশে আমাদের জাতিকে সমতা, বৈষম্যহীনতা, দুর্নীতিমুক্ত ব্যবস্থা এবং সবার জন্য সম্পদের সমান প্রবেশাধিকারের নীতিতে পুনর্গঠনের সুযোগ করে দিয়েছে। তিনি চীনকে প্রেফারেন্সিয়াল বায়ারস ক্রেডিট (পিবিসি) ঋণ এবং সরকারি ছাড়পত্র ঋণ (জিসিএল) উভয়ের জন্য সুদের হার ২-৩ শতাংশ থেকে কমিয়ে ১ শতাংশ করার, প্রতিশ্রুতি ফি মওকুফ করার এবং ঋণ পরিশোধের সময়কাল ২০ বছর থেকে ৩০ বছর করার অনুরোধ করেন। ঋণ পরিশোধে বাংলাদেশের অতীত রেকর্ডের প্রশংসা করে, চীনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী নীতিগতভাবে ঋণ পরিশোধের সময়কাল বাড়ানোর বিষয়ে সম্মত হন এবং সুদের হার হ্রাসের অনুরোধটি খতিয়ে দেখার আশ্বাস দেন। পাশাপাশি চীনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উত্তরণের পরের ৩ বছর ধরে চীনা বাজারে বাংলাদেশি পণ্যের শুল্ক ও কোটামুক্ত প্রবেশাধিকার অব্যাহত রাখার আশ্বাস দেন।

দ্বিপক্ষীয় বৈঠকে পররাষ্ট্র উপদেষ্টা মো. তৌহিদ হোসেনের অনুরোধে চীনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ওয়াঙ ই বলেন, বাংলাদেশি রোগীদের চিকিৎসার জন্য চীনের কুনমিংয়ে ৩/৪টি বিশ্বমানের হাসপাতাল বিশেষভাবে মনোনীত করা হবে। বাংলাদেশ-চীন কূটনৈতিক সম্পর্কের ৫০ বছর পূর্তি উপলক্ষে শুভেচ্ছার নিদর্শন হিসেবে ঢাকায় একটি বিশেষায়িত চীনা হাসপাতাল প্রতিষ্ঠা করতে বাংলাদেশের প্রস্তাবকে বৈঠকে চীনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী স্বাগত জানান। বৈঠকে দুই পক্ষের মধ্যে শিক্ষা, রেলওয়ে, কৃষি, পানিসম্পদ ব্যবস্থাপনা, পশুপালন, মৎস্য, জাহাজ ভাঙ্গা, টেকসই ও পুনঃবাস্তবায়নযোগ্য জ্বালানি এবং নীল অর্থনীতির মতো খাতে আর্থিক, প্রযুক্তিগত এবং সক্ষমতা বৃদ্ধির সহযোগিতা এবং সহায়তা নিয়ে আলোচনা হয়েছে।

বৈঠকে উভয় পক্ষ বাংলাদেশ ও চীনের মধ্যে কূটনৈতিক সম্পর্কের ৫০তম বার্ষিকী জাঁকজমকপূর্ণভাবে উদযাপনের জন্য বিভিন্ন কর্মসূচি আয়োজনের জন্য তাদের প্রস্তুতি ব্যক্ত করে। এই অঞ্চলে বাংলাদেশের কৌশলগত অবস্থান স্বীকার করে, উভয় পক্ষ চীনের বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভের (বিআরআই) অধীনে অব্যাহত সহযোগিতার ওপর জোর দেয়। উভয়েই চীনা অর্থায়নে প্রস্তাবিত প্রকল্প যেমন দাশেরকান্দি পয়ঃনিষ্কাশন শোধনাগার, মোংলা বন্দরের উন্নয়ন ও আধুনিকীকরণ, ডিজিটাল সংযোগ স্থাপন এবং ফোরজি ইন্টারনেট সম্প্রসারণে ঘনিষ্ঠভাবে কাজ করার ইচ্ছা প্রকাশ করেন।

দ্বিপক্ষীয় বৈঠকে উভয়েই রোহিঙ্গা সংকট নিয়ে আলোচনা করেন এবং এই সমস্যার টেকসই সমাধান খুঁজে বের করার জন্য একটি রোডম্যাপ তৈরিতে কাজ করার জন্য তাদের যৌথ প্রতিশ্রুতি পুনর্ব্যক্ত করেন। পরিস্থিতি মোকাবিলা এবং আঞ্চলিক স্থিতিশীলতা বৃদ্ধির জন্য মিয়ানমারের সঙ্গে চীনের অব্যাহত সম্পৃক্ততার আশ্বাস দেন চীনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ওয়াং ই।

বৈঠকে পররাষ্ট্রমন্ত্রী ওয়াং ই বাংলাদেশকে চীনের রাষ্ট্রপতি শির তিনটি বৈশ্বিক উদ্যোগ (জিডিআই, জিএসআই এবং জিসিআই) এ যোগদানের কথা বিবেচনা করার অনুরোধ করেন। 

জবাবে বাংলাদেশের পররাষ্ট্র উপদেষ্টা বলেন, ঢাকা এই সব ইস্যুতে আরও পর্যবেক্ষণ করতে চায়।
দ্বিপক্ষীয় বৈঠকে নদী সংক্রান্ত ‘ইয়ালুজাংবু-যমুনা’ নদীর জলবিদ্যুৎ সংক্রান্ত তথ্য বিনিময় সংক্রান্ত সমঝোতা স্মারক সই করা হয়। পররাষ্ট্র উপদেষ্টা মো. তৌহিদ হোসেন চীনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ওয়াং ই-কে সুবিধাজনক সময়ে বাংলাদেশ সফরের আমন্ত্রণ জানান। চীনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী বাংলাদেশের পররাষ্ট্র উপদেষ্টা এবং তার প্রতিনিধি দলের সম্মানে মধ্যাহ্নভোজের আয়োজন করেন।

পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় আরও জানিয়েছে, পররাষ্ট্র উপদেষ্টা মো. তৌহিদ হোসেন চীনা কমিউনিস্ট পার্টির আন্তর্জাতিক বিভাগের মন্ত্রীর সঙ্গেও বৈঠক করেন। এ ছাড়া মঙ্গলবার বিকালে চীন আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সহযোগিতা সংস্থার (সিআইডিসিএ) চেয়ারম্যানের সঙ্গে বৈঠক করেছেন সফররত পররাষ্ট্র উপদেষ্টা। তারা বাংলাদেশে চীনা অর্থায়নে পরিচালিত প্রকল্পগুলো নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করেন। সফর শেষে আগামী ২৪ জানুয়ারি দেশে ফেরার কথা রয়েছে পররাষ্ট্র উপদেষ্টার।

আন্তর্জাতিক বিশ্লেষক এবং অধ্যাপক নাজমুল ইসলাম দৈনিক সময়ের আলোকে বলেন, চীন বাংলাদেশের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ উন্নয়ন অংশীদার। এই সময়ে ভূ-রাজনীতিতে অনেক পরিবর্তন ঘটছে। এর আগে গত ৫ আগস্ট বাংলাদেশের পটপরিবর্তনের পর এই অঞ্চলের রাজনীতিতেও ব্যাপক পরিবর্তন আসছে। সে দিক থেকে এই অঞ্চলের রাজনীতিতে বাংলাদেশের সঙ্গে যাদের (ভারত) দূরত্বের সৃষ্টি হচ্ছে-সেই জায়গায় চীন ঢুকতে চাচ্ছে। এই সময়ে বাংলাদেশকে তীক্ষè পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে এগিয়ে যেতে হবে। বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের পররাষ্ট্র উপদেষ্টা দায়িত্ব নেওয়ার পর চীনের সঙ্গেই প্রথম কোনো দ্বিপক্ষীয় বৈঠক করলেন, যা তাৎপর্যপূর্ণ।

সময়ের আলো/আরএস/ 




https://www.shomoyeralo.com/ad/1698385080Google-News-Update.jpg

সর্বশেষ সংবাদ

সর্বাধিক পঠিত


ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক : সৈয়দ শাহনেওয়াজ করিম, আমিন মোহাম্মদ মিডিয়া কমিউনিকেশন লিমিটেড এর পক্ষে প্রকাশক গাজী আহমেদ উল্লাহ। নাসির ট্রেড সেন্টার, ৮৯, বীর উত্তম সি আর দত্ত সড়ক (সোনারগাঁও রোড), বাংলামোটর, ঢাকা।
ফোন : +৮৮-০২-৯৬৩২৩৬৮-৭৪, ফ্যাক্স : +৮৮-০২-৯৬৩২৩৭৫ | ই-মেইল : shomoyeralo@gmail.com
close