বায়ুদূষণের কারণে বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হয়ে প্রতি বছর ৬ লাখ ৭০ হাজার রোগী হাসপাতালের জরুরি বিভাগে ভর্তি হচ্ছে। এতে বছরে ২৬৩ মিলিয়ন কর্মদিবস নষ্ট হয়। শুধু তাই নয়, বায়ুদূষণের প্রভাবে বছরে ৯ লাখ অকাল প্রসব এবং ৭ লাখ কম ওজনের শিশু জন্মগ্রহণ করেছে। এসব স্বাস্থ্য সমস্যার সঙ্গে বিরাট অর্থনৈতিক ব্যয় জড়িত। ২০১৯ সালে এ ব্যয়ের পরিমাণ ছিল ১১ বিলিয়ন মার্কিন ডলার, যা বাংলাদেশের জিডিপির প্রায় ৫ শতাংশ। এর প্রভাবে বছরে দেশে ৫ হাজার ২৫৮ শিশুসহ ১ লাখ ২ হাজার ৪৫৬ জন মানুষের অকাল মৃত্যু হচ্ছে। এমনই একটি গবেষণা প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে সেন্টার ফর রিসার্চ অন এনার্জি অ্যান্ড ক্লিন এয়ার (সিআরইএ)।
জাতীয় প্রেস ক্লাবের মানিক মিয়া হলে সিআরইএ ও বায়ুমণ্ডলীয় দূষণ অধ্যয়ন কেন্দ্রের (ক্যাপস) একটি যৌথ সংবাদ সম্মেলনে ‘বাংলাদেশে সূক্ষ্মকণা বায়ুদূষণে জনস্বাস্থ্য প্রভাব’ শীর্ষক আলোচনা সভায় এই গবেষণা প্রকাশ করা হয়।
সিআরইএর গবেষণা বলছে, ২০২৩ সালে বাংলাদেশ বিশ্বের শীর্ষ দূষিত দেশের তালিকায় স্থান পায়। যেখানে প্রতি ঘনমিটার বাতাসে অতি ক্ষুদ্র বালু কণার মান ৭৯ দশমিক ৯ মাইক্রোগ্রাম ছিল। যা ছিল জাতীয় মানদণ্ড ৩৫ মাইক্রোগ্রামের দ্বিগুণের বেশি। এ ছাড়া বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মানদণ্ড ৫ মাইক্রোগ্রামের ১৫ গুণ বেশি। বায়ুর এমন চরম দূষণ বিভিন্ন বয়সিরা নানা জটিল রোগে আক্রান্ত হওয়ার পাশাপাশি ৫ বছর কম বয়সি শিশুদের ওপর সবচেয়ে ক্ষতিকর প্রভাব পড়ছে। এর ফলে হার্ট ডিজিস, স্ট্রোক, হাঁপানি-শ্বাসতন্ত্রের সংক্রমণ ও ফুসফুস ক্যানসারের মতো মরণব্যাধিতে আক্রান্ত হচ্ছে মানুষ। এর নতুন এক গবেষণায় এসব তথ্য উঠে এসেছে।
সেন্টার ফর রিসার্চ অন এনার্জি অ্যান্ড ক্লিন এয়ারের বিশ্লেষণে দেখা যায়, বাংলাদেশের জাতীয় বায়ু মানের মানদণ্ড পূরণ করা সম্ভব হলে মৃত্যুহার ১৯ শতাংশ হ্রাস, আয়ুষ্কালজনিত সমস্যা ২১ শতাংশ এবং অক্ষমতার সঙ্গে বসবাস করা বছর ১২ শতাংশ হ্রাস করতে পারে। এ ছাড়া ডব্লিউএইচওর ২০২১ সালের কঠোর নির্দেশিকা বায়ুর মান প্রতি ঘনমিটারে ৫ মাইক্রোগ্রাম অর্জন করা সম্ভব হলে মৃত্যুহার ৭৯ শতাংশ হ্রাস পাবে। যা প্রতি বছর ৮১ হাজার ২৮২ মানুষের জীবন রক্ষা করবে।
সেন্টার ফর রিসার্চ অন এনার্জি অ্যান্ড ক্লিন এয়ারের বায়ু মান বিশ্লেষক ড. জেমি কেলি বলেন, বাংলাদেশের বায়ুদূষণের কারণে প্রতি বছর হাজার হাজার অপরিণত শিশু, কম ওজনের শিশুর জন্ম এবং শিশু মৃত্যু ঘটছে। এ পরিস্থিতি এমন হস্তক্ষেপের জরুরি প্রয়োজনীয়তা তুলে ধরে, যা সবচেয়ে অরক্ষিতদের সুরক্ষা দিতে সক্ষম। বাংলাদেশের বায়ুদূষণ সমস্যার সমাধান জনস্বাস্থ্য এবং অভ্যন্তরীণ অর্থনীতিতে বিনিয়োগের সমতুল্য।
সংবাদ সম্মেলনে ক্যাপস চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. আহমদ কামরুজ্জমান মজুমদার বলেন, আগে বায়ুদূষণ শুধু বলা হতো; কিন্তু বর্তমানে তা দেখা যাচ্ছে। কারণ কুয়াশার সঙ্গে ধুলাবালি মিলে বায়ুর পরিস্থিতি খারাপ করে তোলে। এটি প্রতিটি নিশ্বাসে সিগারেটের মতো ক্ষতি করছে। বাংলাদেশে নাগরিকদের গড় আয়ু হ্রাস পেয়েছে ৪ দশমিক ৮ বছর। তাই এই মুহূর্ত থেকেই দূষণ রোধে কার্যকর পদক্ষেপ না নেওয়া হলে বর্তমান ও পরবর্তী প্রজন্মকে বায়ুদূষণের কারণে অনেক বেশি স্বাস্থ্যগত ঝুঁকির সম্মুখীন হতে হবে।
আলোচনা সভায় পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব তপন কুমার বিশ্বাস বলেন, বায়ুদূষণের কারণে দেশে এখল গরম ও শীত দুই ঋতু দেখা যায়। এটি নিঃসন্দেহ জনস্বাস্থ্যের জন্য বড় হুমকি হয়ে দেখা দিয়েছে। এর কারণে আমাদের ফুসফুস মারাত্মকভাবে ক্ষতি হচ্ছে। বায়ুদূষণ কমাতে সরকার সর্বোচ্চ সামর্থ্য দিয়ে কাজ করছে।
বায়ুদূষণের জন্য সরকারকে দায়ী করে বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানার্সের (বিআইপি) সভাপতি অধ্যাপক আদিল মুহাম্মদ খান বলেন, আমাদের দেশে দীর্ঘদিন ধরেই বায়ুদূষণ হয়ে আসছে। এর জন্য সরকার দায়ী। কারণ বিগত সরকার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল আগে উন্নয়ন তার পর সংস্কার। এর ফলে বায়ুদূষণের মাত্রা ব্যাপক হারে বেড়ে গেছে। বায়ুদূষণের নামে হাজার কোটি টাকা ব্যয় করলেও কোনো কাজ করেনি। বরং মেগা প্রকল্পের নামে পার্ক ও জলাভূমি ধ্বংস করেছে। রাস্তায় শুধু পানি ছিটিয়ে কখনো বায়ুদূষণরোধ করা সম্ভব নয়। সরকার মূলত ব্যবসায়ীদের সঙ্গে আঁতাত করে কাজ করছে। এর ফলে বায়ুদূষণের জন্য দায়ী জেনেও তাদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে না।