কাতারে গাজায় যুদ্ধ বন্ধের প্রচেষ্টা জোরেশোরেই চলছে। দুইপক্ষের নেতাদের মধ্যে মতপার্থক্য কমে আসছে। বিভিন্ন প্রস্তাবে সম্মত হচ্ছে ইসরাইল এবং হামাস। এরইমধ্যে চূড়ান্ত চুক্তির খসড়া পেশ করা হয়েছে। খবরে চুক্তি সম্পাদনের জন্য পরবর্তী কয়েকঘণ্টা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বলে উল্লেখ করা হচ্ছে। ইসরাইলি পক্ষ থেকে জানা যাচ্ছে, হামাস একটি প্রস্তাব মানলে কয়েক দিনের মধ্যে চুক্তি হয়ে যেতে পারে।
ফিলিস্তিনি পক্ষও দোহা থেকে পাওয়া খবর আশাব্যঞ্জক বলে জানিয়েছেন। নবনির্বাচিত প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প তো বারবার যুদ্ধ থামানোর প্রতিশ্রুতি দিয়ে যাচ্ছেন। অন্যদিকে ক্ষমতার শেষ সময়ে নেতানিয়াহুকে অবিলম্বে যুদ্ধ বন্ধ করতে বলে বাইডেনও লাইম-লাইটে থাকতে চাচ্ছেন। দোহায় যুক্তরাষ্ট্র, মিসর ও কাতারের মধ্যস্থতায় নতুন দফার আলোচনায় অভূতপূর্ব উন্নতি হয়েছে। ইসরাইলের গোয়েন্দা সংস্থা মোসাদের প্রধান ডেভিড বার্নিয়া এবং বাইডেনের মধ্যপ্রাচ্য বিষয়ক শীর্ষ উপদেষ্টা ব্রেট ম্যাকগার্ক সরাসরি এই আলোচনায় অংশ নিচ্ছেন। বাইডেন প্রশাসন আশাবাদী যে জানুয়ারির ২০ তারিখের আগে একটি সমঝোতায় পৌঁছানো সম্ভব। তেমনটি হলে আগামী এক সপ্তাহের মধ্যেই যুদ্ধবিরতিতে চুক্তিবদ্ধ হবে হামাস-ইসরাইল।
সোমবার এক প্রতিবেদনে বার্তাসংস্থা রয়টার্স বলছে, গাজাযুদ্ধ বন্ধের লক্ষ্যে ইসরাইল এবং হামাসকে মধ্যস্থতাকারীরা সোমবার একটি চূড়ান্ত চুক্তির খসড়া পেশ করেছেন। জো বাইডেন এবং ডোনাল্ড ট্রাম্প উভয়ের দূতদের অংশগ্রহণে মধ্যরাতের আলোচনায় ‘অভূতপূর্ব সাফল্য’র পর এই পদক্ষেপ নেওয়া হয়।
রয়টার্সের প্রতিবেদনে আলোচনার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট একজন কর্মকর্তার বরাত দিয়ে বলা হয়েছে, কাতারের প্রধানমন্ত্রী, ইসরাইলের মোসাদ এবং শিন বেট গোয়েন্দা সংস্থার প্রধানদের অংশগ্রহণে দোহায় অনুষ্ঠিত আলোচনায় কাতার একটি যুদ্ধবিরতি চুক্তি এবং জিম্মিদের মুক্তির একটি পরিকল্পনা উপস্থাপন করেছে। তিনি জানান, আগামী সপ্তাহে ট্রাম্প রাষ্ট্রপতি পদে ফিরে আসার পর যিনি মার্কিন দূত হতে চলেছেন, সেই স্টিভ উইটকফ বিদায়ি বাইডেন প্রশাসনের দূত ব্রেট ম্যাকগার্কের সঙ্গে আলোচনায় অংশ নিয়েছিলেন।
রয়টার্স লিখেছে, ‘চুক্তি সম্পাদনের জন্য আগামী ২৪ ঘণ্টা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।’ খসড়াটিকে সোমবারের প্রথম প্রহরে অর্জিত একটি বড় অগ্রগতির ফল হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে।
ইসরাইলের কান রেডিও এক ইসরাইলি কর্মকর্তার বরাত দিয়ে সোমবার জানিয়েছে, কাতারে ইসরাইলি এবং হামাসের প্রতিনিধি দল উভয়ই একটি খসড়া পেয়েছে। ইসরাইলি প্রতিনিধি দল ইসরাইলের নেতাদের এ বিষয়ে অবহিত করেছে। তবে রয়টার্স ইসরাইল, হামাস এবং কাতারের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে নিশ্চিত হতে পারেনি। তবে উভয় পক্ষের কর্মকর্তারা, চূড়ান্ত খসড়া তৈরি হয়েছে কি না তা নিশ্চিত না করলেও আলোচনায় অভূতপূর্ব অগ্রগতির কথা জানিয়েছেন।
একজন জ্যেষ্ঠ ইসরাইলি কর্মকর্তা বলেছেন, হামাস যদি একটি প্রস্তাবের জবাব দেয় তবে কয়েক দিনের মধ্যে একটি চুক্তি হতে পারে। আলোচনা ঘনিষ্ঠ একজন ফিলিস্তিনি কর্মকর্তা রয়টার্সকে বলেছেন, দোহা থেকে পাওয়া তথ্য ‘খুবই আশাব্যঞ্জক’। রয়টার্স কর্মকর্তাদের বরাতে লিখেছে, মতপার্থক্য কমে আসছে এবং সবকিছু ঠিকঠাক চললে শেষ পর্যন্ত একটি চুক্তির জন্য জোর প্রচেষ্টা চলছে।
তবে আলোচনায় এখনও নানা প্রতিবন্ধকতা রয়ে গেছে। ইসরাইলের প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহু যুদ্ধবিরতির প্রথম ধাপে সম্মত হতে ইচ্ছুক হলেও গাজায় হামাসের সামরিক সক্ষমতাকে সম্পূর্ণরূপে ধ্বংস করার লক্ষ্যে অবিচল রয়েছেন। হামাসের পক্ষ থেকে সম্পূর্ণ ইসরাইলি সেনা প্রত্যাহারের দাবি থাকলেও নেতানিয়াহু এ বিষয়ে আপসের কোনো ইঙ্গিত দেননি। অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে, যুদ্ধবিরতি প্রতিষ্ঠার প্রচেষ্টায় উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি হলেও চূড়ান্ত চুক্তি হতে এখনও কিছুটা সময় লাগতে পারে। আলোচনার ফলাফল নির্ভর করছে ইসরাইল, হামাস এবং মধ্যস্থতাকারী পক্ষগুলোর মধ্যে বিশ^াস ও সমঝোতার ওপর।
লন্ডন থেকে প্রকাশিত কাতারি সংবাদমাধ্যম আল-কুদস আল-আরাবি জানিয়েছে, গাজা থেকে সেনা প্রত্যাহারে সম্মত হয়েছে ইসরাইল। তবে ইসরাইল ও ফিলিস্তিনি অঞ্চলটির মাঝে অবস্থিত সীমারেখায় তেল আবিবের সেনাদের থাকতে দিতে হবে। এমনই একটি নতুন পরিকল্পনা মধ্যস্থতাকারীদের কাছে জমা দিয়েছে ইসরাইল। একই সঙ্গে, জিম্মি মুক্তি নিয়ে নতুন পরিকল্পনাও অন্তর্ভুক্ত হয়েছে এতে।
লন্ডনভিত্তিক সংবাদমাধ্যমটি জানিয়েছে, ইসরাইল গাজার সীমান্ত বরাবর প্রায় দেড় কিলোমিটার দীর্ঘ একটি বাফার জোন প্রতিষ্ঠার পাশাপাশি তা নিজেদের নিয়ন্ত্রণে রাখার দাবি করেছে। এর আগে, মধ্যস্থতাকারীদের পক্ষ থেকে ৩০০ মিটার এলাকাকে বাফার জোন হিসেবে বিবেচনা করা হয়েছিল। এতে ইসরাইলি প্রতিরক্ষা বাহিনীর (আইডিএফ) সরাসরি উপস্থিতি না থাকলেও অনুপ্রবেশকারীদের লক্ষ্য করে গুলি চালানোর বিষয়টির উল্লেখ ছিল।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, চুক্তির প্রথম ও দ্বিতীয় পর্যায়ে আইডিএফ যেসব এলাকা থেকে সরে যাবে, তা নিয়ে সমঝোতা হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রও চাচ্ছে চুক্তির বর্তমান প্রস্তাবনা অনুযায়ী প্রথম দুই পর্যায়ে সব জিম্মি এবং চুক্তির আওতায় থাকা ফিলিস্তিনি বন্দিদের মুক্তি। তবে এখনও মুক্তি পাওয়া ফিলিস্তিনি বন্দিদের সংখ্যা এবং কঠোর শাস্তি ভোগকারীদের কোথায় ও কীভাবে মুক্তি দেওয়া হবে তা নিয়ে আলোচনা চলছে। ইসরাইল জানিয়েছে, চুক্তিতে সম্মত হওয়ার আগে তারা জানতে চায় কতজন জিম্মি জীবিত রয়েছেন। তবে, গাজা উপত্যকার অভ্যন্তরে মানবিক সহায়তা পরিচালনার বিষয়ে ইতিমধ্যেই সমঝোতা হয়েছে বলে জানিয়েছে সংবাদমাধ্যমটি।
রোববার গাজায় যুদ্ধবিরতি ও জিম্মি মুক্তি চুক্তি নিয়ে বিদায়ি মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের সঙ্গে ফোনালাপ হয় ইসরাইলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর। তার কার্যালয় থেকে প্রকাশিত এক বিবৃতিতে বলা হয়, প্রধানমন্ত্রী মার্কিন প্রেসিডেন্টের সঙ্গে জিম্মি মুক্তি আলোচনার অগ্রগতি নিয়ে আলোচনা করেছেন। জিম্মিদের মুক্তির প্রক্রিয়া এগিয়ে নিতে কাতারের রাজধানী দোহায় আলোচনার দায়িত্বে থাকা দলকে দেওয়া নির্দেশনা তুলে ধরেছেন। বিগত এক বছরেরও বেশি সময় ধরে, যুক্তরাষ্ট্র কাতার ও মিসরের সঙ্গে যৌথভাবে গাজায় যুদ্ধের অবসান এবং অবশিষ্ট জিম্মিদের মুক্তির জন্য একটি চুক্তির আলোচনায় মধ্যস্থতা করছে। গত সপ্তাহে কাতারে পুনরায় যুদ্ধবিরতি ও জিম্মি মুক্তি আলোচনা শুরু করেছে ইসরাইল ও হামাস।
ট্রাম্প এর আগে হামাসকে সতর্ক করে বলেছিলেন, যদি ২০ জানুয়ারি তার শপথ গ্রহণের আগ পর্যন্ত জিম্মিদের মুক্তি না দেওয়া হয়, তা হলে এর জন্য ‘চরম মূল্য দিতে হবে’। বাইডেনও চান, তার প্রশাসন ক্ষমতায় থাকার সময়ের মধ্যেই ইসরাইল ও হামাসের মধ্যে যুদ্ধবিরতি চুক্তি হয়ে যাক।
সময়ের আলো/জেডআই