
‘কারও পৌষ মাস, কারও সর্বনাশ’ উত্তরের জেলা গাইবান্ধার চর-দ্বীপচরের মানুষের যাপিত জীবনে প্রবাদটি যেন অক্ষরে অক্ষরে মিলে যায়। শহুরে মানুষের জন্য শীত পিঠা-পুলি উৎসবের উপলক্ষ হয়ে এলেও চরগ্রামের মানুষের জন্য নিয়ে আসে বাড়তি কষ্ট। হাড়কাঁপানো শীতে একটু উষ্ণতার খোঁজে প্রাণান্তকর চেষ্টা তাদের।
গত কয়েক দিন ধরেই নদ-নদী বেষ্টিত জেলার সুন্দরগঞ্জ, সদর, ফুলছড়ি ও সাঘাটা উপজেলার ১৬৫ চর-দ্বীপচরে বেড়েছে শীতের প্রকোপ। ঘন কুয়াশায় ঢাকা পড়ছে চরাঞ্চলের দৃশ্যপট। কনকনে শীত আর হু হু করে বয়ে যাওয়া হিমেল বাতাসে বিপর্যস্ত চরের মানুষ।
জেলা ত্রাণ ও পুনর্বাসন অফিস জানায়, প্রধান উপদেষ্টার ত্রাণ তহবিল থেকে গাইবান্ধার সাত উপজেলায় ২০ হাজার কম্বল বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া শীতার্তদের জন্য ৪৭ লাখ ৫০ হাজার টাকা বরাদ্দ দিয়েছে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়। এসব নগদ টাকা ও শীতবস্ত্র বিতরণের কাজ চলছে। ইতিমধ্যে আরও ১ লাখ শীতবস্ত্রের চাহিদা জানিয়ে মন্ত্রণালয়কে চিঠি দেওয়া হয়েছে।
গাইবান্ধা জেলা ত্রাণ ও পুনর্বাসন কর্মকর্তা শরিফুল ইসলাম বলেন, চরের মানুষের জন্য বিশেষ বরাদ্দ দেয় না মন্ত্রণালয়। গাইবান্ধায় চরের সংখ্যা বেশি হওয়ায় শীতবস্ত্রের চাহিদা বেশি। দুর্গম চরে যাওয়া কষ্টসাধ্য হওয়ায় দাতারাও সেখানে যেতে চান না। এসব এলাকার জন্য বিশেষ বরাদ্দ দেওয়া হলে শীতার্তরা উপকৃত হবেন।
তিস্তা, ব্রহ্মপুত্র-যমুনা বেষ্টিত উত্তর জনপদের জেলা গাইবান্ধার অন্ততপক্ষে ৩৫ শতাংশ নদী ও চরাঞ্চল। জেলার মোট জনসংখ্যার ৩০ শতাংশ মানুষের বসবাস সুন্দরগঞ্জ, সদর, ফুলছড়ি ও সাঘাটা উপজেলার ২৮টি ইউনিয়নের ১৬৫টি চর-দ্বীপচরে। সেখানে অন্ততপক্ষে ৪৭ শতাংশ মানুষেরই জীবনমান দারিদ্র্যসীমার নিচে। বন্যা, নদীভাঙন, শৈত্যপ্রবাহ, খরার মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগের সঙ্গে প্রতিনিয়ত যুদ্ধ করেই কেটে যায় এসব মানুষের যাপিত জীবন। শীতের কুয়াশায় ঢেকে যাওয়া চরগ্রামগুলোতে এই সময়ে নেমে আসে নানা সমস্যা। এ সময় গবাদি পশু নিয়ে বিপাকে পড়েন চরের মানুষ। কনকনে শীত, ঘন কুয়াশা আর হিমেল বাতাসের কারণে চরের স্বাভাবিক জীবনযাত্রা ব্যাহত হয়। বিকাল গড়িয়ে সন্ধ্যা নামতে না নামতেই ফাঁকা হয়ে যায় স্থানীয় হাট-বাজার। কমতে থাকে মানুষের চলাচল। ফলে অর্ধেকে নেমে যায় দোকানের কেনাবেচা। এখানেই শেষ নয়, কুয়াশাচ্ছন্ন সকালে চর থেকে মূল ভূখণ্ডে আসতে গেলে দৃশ্যমানতা কম থাকায় পড়তে হয় বিড়ম্বনায়। আবার ফেরার সময় সন্ধ্যার আগেই ফিরতে হয় চরে। ফলে এই সময়ে কোনো কাজ করে স্বস্তি মেলে না বলে দাবি চরগ্রামের বাসিন্দাদের। সব মিলিয়ে শীতে কাঁপতে থাকে অবকাঠামোহীন চরাঞ্চলের মানুষ।
কেবল শীত নয়, চরের মানুষের সমস্যা বারো মাস। বর্ষায় বানের জলে ডুবে যায় ঘর, তলিয়ে যায় ফসলের মাঠ। গ্রীষ্মকাল মানে দুঃখ কষ্টের পাহাড় এখানে। নদ-নদী শুকিয়ে যেন মরা কঙ্কাল হয়ে যায়। তখন মাইলের পর মাইল পথ পাড়ি দিতে হয় পায়ে হেঁটে।
এখানে রোগে-শোকে পর্যুদস্ত হলেও সুযোগ-সুবিধার অভাবে নিরুপায় সাধারণ মানুষগুলো। কখনো কখনো বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের দেখা পাওয়ার আগেই মৃত্যুকে বরণ করে নিতে হয়। বর্ষায় ফুঁসে ওঠা তিস্তা, ব্রহ্মপুত্র-যমুনা স্বরূপ হারিয়ে শুষ্ক মৌসুমে পরিণত হয় মরা খালে। পলি বহন করতে গিয়ে দীর্ঘতম ব্রহ্মপুত্র নদের অস্তিত্বই প্রায় বিপন্ন। গত কয়েক দশকে প্রস্থে দ্বিগুণ হলেও কমেছে গভীরতা। এ কারণে সংকটে পড়েছে নদীনির্ভর লাখো মানুষের জীবন-জীবিকা। গাইবান্ধার ফুলছড়ি অংশে ব্রহ্মপুত্র নদ, চাষাবাদে সহযোগী হলেও প্রায় পানিশূন্য ব্রহ্মপুত্রে চলছে ঘোড়ার গাড়ি। অভ্যন্তরীণ নৌরুট বন্ধ হওয়ার পর পানির অভাবে ঠেলে-ঠুলে চলছে আন্তঃজেলা রুটের কয়েকটি নৌকা। যোগাযোগব্যবস্থার সঙ্গে সংকটাপন্ন কৃষি, জীববৈচিত্র্য আর জীবন-জীবিকা। গাইবান্ধা পানি উন্নয়ন বোর্ড বলছে, দ্বিগুণ হয়ে এলাকাভেদে ব্রহ্মপুত্রের প্রস্থ ঠেকেছে ১৬ থেকে ১৮ কিলোমিটারে। বছরে প্রায় সাড়ে ৭২ কোটি টন পলি বহন করতে গিয়ে কমেছে গভীরতা। শত শত চর-দ্বীপচর জেগে সৃষ্টি হয়েছে অসংখ্য চ্যানেল।
বিভিন্ন চরগ্রামের মানুষের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, প্রতি বছরই শীতসহ নানা প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবিলা করতে হয় চরাঞ্চলবাসীর। শীতের তীব্রতায় বিপাকে পড়েছেন কৃষি শ্রমিক ও স্বল্প আয়ের খেটে-খাওয়া মানুষ। তীব্র শীতে অনেকেই কাজে যেতে পারছেন না। এদিকে দিনের বেলা তাপমাত্রা কিছুটা বৃদ্ধি পেলেও বিকাল থেকে তাপমাত্রা কমতে থাকে। মধ্যরাত থেকে সকাল পর্যন্ত শীতের তীব্রতা বেশি অনুভূত হয়। চরের বেশিরভাগ মানুষ নিম্ন আয়ের। শীতে কাবু হলেও অধিকাংশেরই নেই শীতবস্ত্র কেনার সামর্থ্য। সরকারি, বেসরকারি ও ব্যক্তি উদ্যোগে শীতবস্ত্র বিতরণ করা হলেও দুর্গম চরগুলোতে শীতবস্ত্র পৌঁছায় না। অথচ বিস্তীর্ণ বালুকাময় এসব এলাকায় শীতের প্রকোপ বেশি।
ফুলছড়ি উপজেলার ফজলুপুর ইউনিয়নের পূর্ব খাটিয়ামারি চর এলাকার বাসিন্দা রিয়াজ মিয়া বলেন, গত কয়েক দিন ধরে সন্ধ্যা পেরিয়ে রাত বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে ঘন কুয়াশা পড়ছে। কুয়াশায় চারপাশ ঢাকা থাকে সকাল ১০-১১টা পর্যন্ত। তীব্র শীত আর কুয়াশার কারণে হাট-বাজারে ক্রেতাদের উপস্থিতি থাকে না বললেই চলে। শীতের কয়েক মাস শিশু ও বয়স্করা খুব কষ্টে থাকে। শীতের তীব্রতায় তারা ঠান্ডাজনিত রোগে আক্রান্ত হচ্ছে। শীতের কারণে মাঠে কাজ করতেও কষ্ট হয়।
কনকনে শীতের সঙ্গে নদ-নদীর ওপর দিয়ে হু হু করে বয়ে আসে হিমেল বাতাস। এ সময় জীর্ণ-শীর্ণ কম দামি শীতের পোশাকে নিজেদের কোনোক্রমে বাঁচিয়ে রাখেন চরের মানুষ। গাইবান্ধা সদরের কামারজানি ইউনিয়নের কুন্দেরপাড়া চরের বাসিন্দা মিজানুর রহমান বলেন, একদিকে হিমেল হাওয়া, অন্যদিকে মাথার ওপর টিনের ছাউনি। সব মিলিয়ে রাত বাড়ার সঙ্গে সঙ্গেই হাড় হিম করা ঠান্ডা বয়ে যায়।