ই-পেপার শুক্রবার ১৪ মার্চ ২০২৫
শুক্রবার ১৪ মার্চ ২০২৫
ই-পেপার

শুক্রবার ১৪ মার্চ ২০২৫

খালেদা জিয়ার লন্ডন যাত্রা এবং আগামীর গণতন্ত্র
প্রকাশ: শুক্রবার, ১০ জানুয়ারি, ২০২৫, ১:১১ এএম  (ভিজিট : ৬৩৪)

স্বৈরশাসনের করালগ্রাস থেকে মুক্ত আপসহীন নেত্রী সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার লন্ডন যাত্রা আগামীর রাজনীতিতে এক নতুন প্রেক্ষাপট তৈরি করতে যাচ্ছে। বিগত ২০২৪ সালে ৫ আগস্ট সরকার পতনের পর থেকেই মুক্ত খালেদার চিকিৎসার উদ্দেশ্যে বিদেশযাত্রায় কার্যত তেমন কোনো বাধা ছিল না। অথচ খালেদা জিয়ার চিকিৎসা নিয়ে দীর্ঘ ১৫ বছর রাজনীতি হয়েছে এ দেশে। তবু কেন দীর্ঘ ছয় মাস অপেক্ষা? তা হলে কি তিনি রাজনীতির জটিল কোনো সমীকরণ এড়াতেই বিদেশ যেতে এত দেরি করলেন? নাকি অসাধারণ রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বের অধিকারী খালেদা জিয়া চিরদিনই আপসহীন থাকতে চেয়েছিলেন?

তবু নানাভাবে কিছু লোকের সমালোচনা তাকে সহ্য করতে হবে। কেউ কেউ খুব জোরালোভাবে এটাও বলতে চেষ্টা করছে কার্যত দেশে মাইনাস টু ফর্মুলা কার্যকর হলো। এ কথা সত্য বাংলাদেশে এমন পরিস্থিতি কেউ কখনো কল্পনা করেনি। মূলত ১/১১-এর পরেই মাইনাস টু ফর্মুলা জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। স্বৈরশাসক হিসেবে শেখ হাসিনার পতনের পর বিরোধী পক্ষ মাইনাস টু ফর্মুলা প্রতিষ্ঠিত করার চেষ্টা করছে। কেন মাইনাস টু ফর্মুলা হঠাৎ রাজনীতিতে সামনে আনার চেষ্টা করা হচ্ছে? অন্তর্বর্তী সরকারের আচরণের মধ্যে কেউ কি এ ধরনের ইঙ্গিত পাচ্ছেন? বিশেষ করে খালেদার জিয়ার উন্নত চিকিৎসায় যাওয়ার পরই এ ধরনের আলোচনা বেশি হচ্ছে।

দলের নেতাকর্মীদের বক্তব্যের মধ্যেও রয়েছে উদ্বেগ এবং উৎকণ্ঠা। খালেদা জিয়া চিকিৎসা শেষে স্বাভাবিকভাবে দেশে ফিরতে পারবে কি না অথবা স্বাভাবিকভাবে ফিরতে ভবিষ্যতে কোনো সমস্যা হতে পারে কি না এসব বিষয়ও ভাবছে শীর্ষস্থানীয় নেতাকর্মীরা। সেনা সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় আওয়ামী সভানেত্রী শেখ হাসিনার দেশে ফেরা নিয়ে সংশয় তৈরি হয়েছিল। সেই শঙ্কা থেকেই নেতাকর্মীসহ অনেকের মনে সংশয় থাকা অস্বাভাবিক কিছু নয়। বর্তমানে দেশে এমন কোনো পরিস্থিতি তৈরি হয়নি। খালেদা জিয়া কোন চাপের মুখে দেশ ছেড়ে চিকিৎসা নিতে যাচ্ছেন না। তবু কেন এই ধরনের আলোচনা সামনে আসছে? এটি হতে পারে জনমনে অস্বস্তি তৈরি করে বিগত সরকারের সুবিধাভোগীরা দেশকে অস্থিতিশীল করা। অথবা অন্তর্বর্তী সরকারের ভেতর কোনো অশুভ চিন্তা থাকলে তা থেকে সরকার ও জনগণকে সতর্ক করা।

এবারের চিকিৎসার উদ্দেশ্যে লন্ডন যাত্রা দীর্ঘদিনের পরিকল্পনার একটি অংশ এবং প্রত্যাশিত। তবু রাজনীতি ঘিরে যেন সংশয় কাটছে না। সবারই স্মরণ থাকার কথা, ১/১১ তৎকালীন সেনা শাসকের বন্দুকের মুখে অনিশ্চয়তা থাকা সত্ত্ব্ওে কেবল খালেদা জিয়াই আপসহীন থাকতে পেরেছিলেন। এখন তীরে এসে যেকোনো ধরনের প্রস্তাব তার মতো আপসহীন নেত্রী মেনে নেবেন এটি অবিশ্বাস্য। চরম বৈরী পরিবেশেও তার দেশ ছেড়ে যাওয়ার কোনো নজির নেই। অন্যভাবে বলতে গেলে স্বাধীনতা-পরবর্তী প্রত্যেক শাসকের গায়ে কোনো না কোনোভাবে স্বৈরশাসকের তকমা লাগলেও খালেদা জিয়া ব্যতিক্রম। একজন রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বসম্পন্ন মানুষ হিসেবে অনেক ব্যর্থতার পরও এখন পর্যন্ত গণতন্ত্রের আপসহীন নেত্রী হিসেবে তার অর্জনের পাল্লা নিঃসন্দেহে ভারী। এ দেশে যতটুকু গণতন্ত্র বজায় আছে তার কৃতিত্বে সর্বাগ্রে খালেদা জিয়াকেই রাখতে হবে।

এদিকে অন্তর্বর্তী সরকার জনগণের সরকার কি না এ নিয়ে পক্ষে-বিপক্ষে বহু বিতর্ক করা যায়। আবার গণঅভ্যুত্থান অথবা গণবিপ্লব যাই বলি জনগণের ব্যাপক সমর্থন ব্যতীত কী কখনো সম্ভব? জনগণের অকুণ্ঠ সমর্থন ছাড়া বিপ্লব হয় না। কোনো সরকারকে পতনের জন্যও ব্যাপক জনসমর্থন প্রয়োজন। তবু গণতন্ত্রে ভোটই সরকার গঠনের প্রধান ম্যান্ডেট। ২০২৪ সালের জুলাই বিপ্লবের প্রধান বৈশিষ্ট্য হচ্ছে কোনো রাজনৈতিক দল এককভাবে স্বৈরাচার সরকারের পতন ঘটায়নি। এখানে প্রধান ভূমিকা রেখেছে ছাত্র-জনতা আর সহযোগী হিসেবে রাজনৈতিক দলগুলো অংশগ্রহণ ছিল চোখে পড়ার মতো। এ জন্যই জনআকাক্সক্ষা যেকোনো সময়ের অনেক বেশি। তাই নিঃসন্দেহে বলা যায় অন্য যেকোনো সরকারের চেয়ে চাপও বেশি এই অন্তর্বর্তী সরকারের ওপর।

বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারকে গতানুগতিক সরকার বলা যায় না। দীর্ঘদিন গণতন্ত্রের বাইরে থাকা নির্বাচন সুষ্ঠু ও স্বচ্ছ করতে গিয়ে সরকারকে হাঁটতে হচ্ছে ভিন্ন পথে। কেননা বিগত সরকারের ১৬ বছরের স্বৈরশাসনের ফলে রাষ্ট্রযন্ত্র বেশিরভাগই প্রশ্নবিদ্ধ। এ অবস্থা থেকে উত্তরণের উপায় বের করতে অন্তর্বর্তী সরকার জরুরি সংস্কারকাজ সম্পন্ন করেই নির্বাচনে যেতে চাচ্ছে এবং গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে ক্ষমতা হস্তান্তরের পক্ষে সরকার চেষ্টা করছে বলা যায়। কতটুকু পারছে অথবা পারবে তা এখনও নিশ্চিত করে বলা যাচ্ছে না। বিভিন্ন ইস্যু নিয়ে এখনও আন্দোলন চলমান, জাতি এখনও বিভিন্ন বিষয়ে দ্বিধাবিভক্ত। রাজনৈতিক ঐকমত্য এখনও প্রতিষ্ঠিত হয়নি। ভিন্নমতকে দমনের প্রচেষ্টা কাম্য নয়।

একটি রাষ্ট্রের যে সরকারই ক্ষমতায় থাক, পররাষ্ট্রনীতি হবে এক ও অভিন্ন। কিন্তু আমাদের বাংলাদেশেই একমাত্র ব্যতিক্রম। সরকার পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে পররাষ্ট্রনীতি পরিবর্তন হয়ে যায়। রাষ্ট্রীয় অনেক গুরুত্বপূর্ণ মীমাংসিত বিষয় নিয়ে বিতর্ক তৈরি করে দেশকে অস্থিতিশীল করা উচিত নয়। স্বাধীনতার পঞ্চাশ বছর পরেও নতুন প্রজন্মের কাছে মুক্তিযুদ্ধের সঠিক ইতিহাস তুলে ধরতে পারছি না। পৃথিবীর অন্য কোনো দেশে এ রকমটি আছে কি না আমার জানা নেই। তাই এবারের নির্বাচনটা আরও গুরুত্বপূর্ণ।

স্বৈরশাসক তৈরির পথ রুদ্ধ করতে রাষ্ট্র সংস্কারের কাজে গিয়েই অন্তর্বর্তী সরকার অনেক সমালোচনার জন্ম দিচ্ছে। কিন্তু প্রধান প্রধান রাজনৈতিক দল শুধু নির্বাচনের জন্য প্রয়োজনীয় সংস্কার করে নির্বাচিত সরকারের কাছে অবশিষ্ট সংস্কার কাজের দায়িত্ব দেওয়ার পক্ষপাতী। একটা প্রশ্ন করা যেতে পারে এসব রাজনৈতিক দল পরবর্তীতে সংস্কার কাজে আগ্রহী হবে কি? তাদের অতীত নিয়েও যথেষ্ট প্রশ্ন আছে। তাই অন্তর্বর্তী সরকার একটি গ্রহণযোগ্য সংস্কার কাজ ব্যতীত নির্বাচনে আগ্রহী নয়। সরকার ইতিমধ্যে প্রায় ছয় মাস অতিবাহিত করেছে। শুরু থেকেই চাপের মধ্যে থেকে কতটুকু এগোতে পেরেছে অন্তর্বর্তী সরকার? এখনও রাজনীতি অস্থিতিশীল। অস্থিতিশীল রাজনীতিতে শুধু নির্বাচনই কি মুখ্য?

নতুন বছর হোক নির্বাচনের বছর। প্রধান রাজনৈতিক দলের মূল টার্গেট এ বছরই নির্বাচন হতে হবে। সে লক্ষ্যেই অন্তর্বর্তী সরকারকে নির্বাচনি রোডম্যাপ ঘোষণার জন্য বারবার চাপ দিয়ে আসছিল। সম্প্রতি অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা চলতি বছর ডিসেম্বর অথবা ২০২৬ সালের শুরুর দিকে নির্বাচন করার ঘোষণা দেন। দুয়েকটি দল বিষয়টি সহজভাবে নিলেও প্রধান রাজনৈতিক দল বিএনপি এ বছরই নির্বাচনের পক্ষে জোরালো বক্তব্য দিচ্ছে। জনগণ নির্বাচন এবং রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা উভয়ই চায়।
জুলাই বিপ্লবে স্বৈরাচার শেখ হাসিনার পতনের পর গণতন্ত্রের পুনরুদ্ধারে বিরামহীন কাজ করছে অন্তর্বর্তী সরকার। জনগণের আকাশ সমান আশা-আকাক্সক্ষা নিয়ে বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের দায়িত্ব গ্রহণ করেন ড. মুহাম্মদ ইউনূস। জনগণের প্রত্যাশা পূরণ করতে গিয়েই রাষ্ট্রের বিভিন্ন সংস্কার কাজে হাত দিয়েছে। ইতিমধ্যে ছয়টি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে সংস্কার কমিশন গঠন করেছে সরকার। চুলচেরা বিশ্লেষণ চলছে সংস্কার কমিশন নিয়েও। অল্প কয়েক দিনের মধ্যে প্রায় সব কমিশনের সুপারিশ জনগণ জানতে পারবে। সত্যি কথা বলতে সংস্কার কমিশনের সুপারিশ এবং দিকনির্দেশনার ওপরই আগামীর গণতন্ত্র কেমন হবে তা নির্ভর করছে।

তবে খালেদা জিয়ার লন্ডন যাত্রায় নিশ্চয়ই রাজনৈতিক সংকট দৃশ্যমান হতে পারে। বাংলাদেশ কখনোই আরেকটি ১/১১ মেনে নেবে না। মানুষ কখনো ভাবেনি এই দুই নেত্রীবিহীন কোনো বাংলাদেশ হতে পারে। তবু রাজনীতিতে শেষ বলতে কিছু নেই। অনেক কিছুই ঘটতে পারে। অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস নিশ্চয়ই জনগণের অনুভূতি বুঝবেন। জনগণের আশা-আকাক্সক্ষা প্রতিফলন ঘটাতে যথা শিগগির সম্ভব একটি অসাধারণ এবং বিশ্বাসযোগ্য নির্বাচন উপহার দিয়ে জনগণের ক্ষমতা জনগণের কাছে ফিরিয়ে দিয়ে নজির স্থাপন করবেন। চব্বিশের জুলাই-আগস্ট বিপ্লবকে কেন্দ্র করে যে জাতীয় ঐক্য তৈরি হয়েছে তা যাতে কোনোভাবেই ব্যর্থ না হয় তার ব্যবস্থা এ অন্তর্বর্তী সরকারকেই করতে হবে।

স্বৈরশাসন থেকে মুক্ত বাংলাদেশে নতুন বছরের রাজনীতি কেমন হতে যাচ্ছে? রাজনৈতিক দলগুলোর আচরণ কেমন হবে? কখন নির্বাচন হবে? আগে স্থানীয় নির্বাচন না জাতীয় নির্বাচন? গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারে অন্তর্বর্তী সরকার বিগত ছয় মাসে কতদূর কাজ করতে পেরেছে? অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস ঘোষিত সময়ের মধ্যে কি জনগণের প্রতিনিধির কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করতে পারবে? এতসব প্রশ্নের উত্তরের আশায় গোটা জাতি।

এ দেশের আপামর জনসাধারণের আকাক্সক্ষা দ্রুত সুস্থ হয়ে গণতন্ত্রকে পুনরুদ্ধারের জন্য অবিশ্বাস্য শক্তি নিয়ে খালেদা জিয়া ফিরে আসবেন শিগগিরই। গণতন্ত্রকে ফিরিয়ে আনতে এবং দেশকে একটি সুস্থ ধারার রাজনীতি পরিচালিত করতে খালেদা জিয়াকেই সবথেকে এখন বেশি প্রয়োজন। ফেরার সময় নিশ্চয়ই পুত্র তারেক রহমানকে সঙ্গে নিয়ে অতীতের সব রেকর্ড ভঙ্গ করে নতুন করে দেশ গড়ার কাজে আত্মনিয়োগ করবেন। ২০২৫ সালই হোক গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের বছর এবং দেশে চালু হোক নতুন ধারার সুস্থ রাজনৈতিক চর্চা।

গবেষক
বাংলাদেশ উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়, গাজীপুর



সময়ের আলো/আরএস/





https://www.shomoyeralo.com/ad/1698385080Google-News-Update.jpg

সর্বশেষ সংবাদ

সর্বাধিক পঠিত


ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক : সৈয়দ শাহনেওয়াজ করিম, আমিন মোহাম্মদ মিডিয়া কমিউনিকেশন লিমিটেড এর পক্ষে প্রকাশক গাজী আহমেদ উল্লাহ। নাসির ট্রেড সেন্টার, ৮৯, বীর উত্তম সি আর দত্ত সড়ক (সোনারগাঁও রোড), বাংলামোটর, ঢাকা।
ফোন : +৮৮-০২-৯৬৩২৩৬৮-৭৪, ফ্যাক্স : +৮৮-০২-৯৬৩২৩৭৫ | ই-মেইল : shomoyeralo@gmail.com
close