বাংলাদেশে ওয়াজ-মাহফিলের মৌসুম হলো শীতকাল। বছরব্যাপী কমবেশি স্বাভাবিক মাহফিল, সভা-সমাবেশ অনুষ্ঠিত হলেও শীতকালে এর পরিমাণ থাকে বেশি। যুগ যুগ ধরে এমনটাই ধারাবাহিকভাবে চলে আসছে। তীব্র শীতে গায়ে চাদর জড়িয়ে খড়কুটোর ওপর বসে ওলামায়ে কেরামের মুখনিঃসৃত হেদায়েতি বয়ান শ্রবণ যেন বাংলাদেশের ঐতিহ্য। কিন্তু বর্তমান সময়ের ওয়াজ-মাহফিল আগেকার সেই জৌলুস হারিয়ে ফেলেছে। হারিয়ে গেছে বক্তাদের কথার প্রভাবও। আগের মতো এখন আর তা হৃদয়ে প্রভাব ফেলে না।
ওয়াজ-মাহফিলের বহুবিধ উপকার যেমন আছে, তেমনি বর্তমান সময়ের ওয়াজ-মাহফিলের রয়েছে নানা ক্ষতিকর দিকও। সবচেয়ে বড় ক্ষতিকর দিকটা হলো, একশ্রেণির বাজারি বক্তা এটাকে বানিয়ে ফেলেছে নিজেদের ইনকামের উৎস। ইখলাস ও খোদাভীতিকে পাশ কাটিয়ে তারা মাহফিলের স্টেজগুলো রূপান্তর করেছে নাট্যমঞ্চে। এখানে বসে ধর্মের বাণী ছড়িয়ে দেওয়ার পরিবর্তে বিভিন্ন অভিনয়, কৌতুকের মাধ্যমে তারা মানুষকে নিজেদের প্রতি আকৃষ্ট করে বেড়ায়। কেউ কেউ তো মঞ্চে বসে দেশি-বিদেশি নায়ক-নায়িকা, ফিল্ম-মুভির বর্ণনা দিতে থাকে দ্বিধাহীন। কেউ করে পবিত্র কুরআনের মনগড়া তাফসির। কেউ আবার অনর্গল বলে যায় জাল হাদিসের চটকদার কল্পকাহিনি। কারও বয়ান-বক্তৃতায় থাকে না ইখলাসের ছিটেফোঁটা। ফলে যে মঞ্চ থেকে মানুষের হৃদয়-মনে প্রবেশ করত হেদায়েতের নুর, সেখানে এখন কিছু অর্থের অপচয় ছাড়া বিশেষ কিছু পাওয়া যায় না।
বক্তাদের জন্য ইখলাস খুবই জরুরি। ইখলাস ছাড়া কোনো আমল আল্লাহ তায়ালা কবুল করবেন না। এর কোনো প্রতিদানও পাওয়া যাবে না। হজরত আবু উমামা বাহিলি (রা.) বলেন, ‘এক ব্যক্তি রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর কাছে এসে জিজ্ঞেস করল ওই লোক সম্বন্ধে আপনার অভিমত কী, যে ব্যক্তি সম্পদ ও সুনামের জন্য জিহাদ করে, সে কী পাবে? রাসুলুল্লাহ (সা.) বললেন, সে কিছুই পাবে না। সে তিনবার এ কথাটি জিজ্ঞেস করল। রাসুলুল্লাহ (সা.) প্রতিবারই বললেন, সে কিছুই পাবে না। অতঃপর মহানবী (সা.) বলেন, যা দ্বারা আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন ব্যতীত ভিন্ন কোনো উদ্দেশ্য থাকে না, এমন খালেস আমল ব্যতীত আল্লাহ তায়ালা কিছুই কবুল করেন না।’ (নাসায়ি, হাদিস : ৩১৪৪)
ইবাদতে ইখলাস না থাকার পরিণাম জাহান্নাম। হজরত আবু হুরায়রা (রা.) কর্তৃক বর্ণিত হাদিসে রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘বিচার দিবসে আল্লাহ তায়ালা যে তিনজন লোকের মাধ্যমে বিচারকাজ শুরু করবেন তার মধ্যে একজন হবে এমন আলেম যে দ্বীনের জ্ঞান নিজে শিখেছে, অন্যকে শিখিয়েছে এবং পবিত্র কুরআন অধ্যয়ন করেছে। তাকে (বিচারের কাঠগড়ায়) উপস্থিত করা হবে। অতঃপর আল্লাহ তায়ালা তাকে (দুনিয়াতে) প্রদত্ত নেয়ামতের কথা স্মরণ করাবেন। সেও যাবতীয় নেয়ামতের কথা স্মরণ করবে। এরপর আল্লাহ তায়ালা বলবেন, এত নেয়ামতের বিনিময়ে তুমি কী করেছ?
সে বলবে, আমি দ্বীনের জ্ঞান নিজে শিখেছি, অন্যকে শিখিয়েছি এবং তোমার সন্তুষ্টি লাভের উদ্দেশ্যে কুরআন অধ্যয়ন করেছি। জবাবে আল্লাহ তায়ালা বলবেন, তুমি মিথ্যা বলছ। তুমি দ্বীনের জ্ঞান শিখেছিলে এ জন্য, যেন লোকেরা তোমাকে ‘আলেম’ বলে। কুরআন অধ্যয়ন করেছিলে এ জন্য, যেন লোকেরা তোমাকে ‘কারি’ বলে। তা (দুনিয়াতে) বলা হয়ে গেছে। এরপর নির্দেশ দেওয়া হবে এবং নির্দেশ মোতাবেক তাকে জাহান্নামে নিক্ষেপ করা হবে’ (মুসলিম, হাদিস : ১৯০৫)। এ হাদিস থেকে বুঝা গেল, ইখলাস না থাকার কারণে দ্বীনি কাজকর্ম করেও জাহান্নামে নিক্ষিপ্ত হতে হবে।
আর অনেক বক্তাকে দেখা যায় জাল বা বানোয়াট হাদিস বর্ণনা করতে। জাল ও বানোয়াট হাদিস বর্ণনার পরিণতি ভয়াবহ। অথচ আমাদের মাহফিলগুলোতে এর ছড়াছড়িই সবচেয়ে বেশি লক্ষ করা যায়। জাল হাদিস বর্ণনা করা মানে রাসুলের প্রতি মিথ্যা আরোপ করা। যা তিনি বলেননি, সেগুলো তাঁর নামে চালিয়ে দেওয়া। এর পরিণতি জাহান্নাম। হজরত মুগিরা (রা.) থেকে বর্ণিত-রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘আমার প্রতি মিথ্যা আরোপ করা অন্য কারও প্রতি মিথ্যা আরোপ করার মতো নয়। যে ব্যক্তি আমার প্রতি মিথ্যা আরোপ করে, সে যেন অবশ্যই তার ঠিকানা জাহান্নাম বানিয়ে নেয়।’ (বুখারি, হাদিস : ১২৯১)
বর্তমান সময়ের ওয়াজ-মাহফিলের আরেকটা ভয়াবহ দিক হলো ওয়াজের নামে মনগড়া তাফসির করতে থাকা। কেউ কেউ তো তাফসির মাহফিলে বসে পবিত্র কুরআন সামনে রেখে নাটক-সিনেমার গালগল্প আরম্ভ করে এবং নায়ক-নায়িকাদের নগ্ন দেহের আকর্ষণীয় বর্ণনা দিতে থাকে। মনগড়া তাফসিরের পরিণাম সম্পর্কে রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘যে ব্যক্তি কুরআনের (ব্যাখ্যায়) নিজের মনগড়া কোনো কথা বলেছে, সে যেন নিজের ঠিকানা জাহান্নামে বানিয়ে নিয়েছে।’ অন্য বর্ণনায় এসেছে, ‘যে ব্যক্তি কুরআনের মর্ম উদঘাটন বিষয়ে নিশ্চিত জ্ঞান ছাড়া মনগড়া কথা বলবে, সে যেন তার ঠিকানা জাহান্নাম বানিয়ে নিল’ (জামে তিরমিজি : ২/২৩)। পবিত্র কুরআনের তাফসির করার ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ সতর্কতা অবলম্বন করা জরুরি।
এদিকটার প্রতি গুরুত্বারোপ করেই রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘যে ব্যক্তি কুরআনের ব্যাখ্যায় নিজের মনগড়া কথা বলেছে, ঘটনাক্রমে তা যদি সত্যও হয়, তবু সে নিশ্চয় ভুল করেছে’ (তিরমিজি : ২/১২৩)। আল্লাহ তায়ালা ওয়াজ-মাহফিলগুলো মানুষের হেদায়েতের মাধ্যম হিসেবে কবুল করুন। সব ধরনের মনগড়া, বানোয়াট, অর্থহীন কাজকর্ম থেকে আমাদের হেফাজত করুন।
মুহাদ্দিস, জামিয়া আরাবিয়া দারুস সুন্নাহ রাজাবাড়ী
দক্ষিণ কেরানীগঞ্জ, ঢাকা