১৫ জানুয়ারির মধ্যে ‘জুলাই অভ্যুত্থানের ঘোষণাপত্র’ দেওয়ার দাবি জানিয়েছেন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন ও নাগরিক কমিটি। মঙ্গলবার (৩১ ডিসেম্বর) বিকেলে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে 'মার্চ ফর ইউনিটি কর্মসূচী'তে এ দাবি জানান তারা। এসময় আওয়ামী লীগের বিচার এবং ফ্যাসিবাদী ব্যবস্থা বিলাপ না করা পর্যন্ত রাজপথে ছেড়ে না যাওয়ার প্রত্যয়ও জ্ঞাপন করেছেন তারা।
এর আগে বিকাল ৩টায় অনুষ্ঠান শুরুর কথা থাকলেও জুলাই গণঅভ্যুত্থানে শহীদদের স্মরণে এক মিনিট নীরবতা পালনের মাধ্যমে বিকেল ৪ টায় সমাবেশের আনুষ্ঠানিকতা শুরু হয়। কর্মসূচি উপলক্ষে সকাল থেকেই ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে ছাত্র-জনতা মিছিল আর ব্যানার, পতাকা, ফেস্টুন নিয়ে জড়ো হতে শুরু করেন।
সমাবেশস্থলে ‘ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে, ডাইরেক্ট অ্যাকশন’, ‘দিল্লি না ঢাকা, ঢাকা ঢাকা’, ‘মুজিববাদের ঠিকানা, এই বাংলায় হবে না’, ‘আবু সাইদ মুগ্ধ, শেষ হয়নি যুদ্ধ’, ‘মুজিববাদ মুর্দাবাদ, ইনকিলাব জিন্দাবাদ’ ‘এই মূহুর্তে দরকার, বিচার আর সংস্কার’সহ নানা স্লোগান দেন আগতরা।
বিকেল তিনটার আগে বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের বিভিন্ন দুর্নীতি নিয়ে একটি তথ্যচিত্র প্রদর্শন করে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন। এরপর মঞ্চ থেকে স্লোগান শুরু হয়। পরে একজন শহীদের পিতার বক্তব্যের মধ্য দিয়ে সমাবেশ শুরু হয়।
শহীদ শাহরিয়ার হাসান আলভীর পিতা আবুল হাসান বলেন, আমার ছেলে শাহরিয়ার নবম শ্রেণির শিক্ষার্থী আন্দোলনের সময় মিরপুর ১০ এ শহীদ হয়েছে। আমাদের কান্না কখনো থামবে না, এই বেদনা শেষ হওয়ার নয়। খুনি হাসিনা ও তার হেমলেট বাহিনী আমাদের ওপর পাখির মতো গুলি চালিয়েছে। আমরা খুনি হাসিনার ফাঁসি চাই।
সমাবেশে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের আহবায়ক হাসনাত আব্দুল্লাহ বলেন, ৫ আগস্টের পর আমাদের মধ্যে শত্রু নেই। আমাদের একমাত্র শত্রু আওয়ামী লীগ। আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে সকল ফ্যাসিবাদবিরোধী রাজনৈতিক শক্তির সংগ্রাম চলবে।
তিনি বলেন, ৫ আগস্টের পর আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নয়ন হয়নি, দ্রব্যমূল্যের দাম কমেনি। অন্তর্বর্তীকালীন সরকার বলে 'সিন্ডিকেটের পরিবর্তন হয়েছে'। তাহলে সরকারের কাজ কি—এমন প্রশ্ন রাখেন হাসনাত আবদুল্লাহ।
তিনি আরও বলেন, অতীতে ছিলো ‘সতীদাহ প্রথা’ এখন হয়েছে ‘নথিদাহ প্রথা’। ৫ আগস্টের পর অনেকেই এই অভ্যুত্থানকে মেনে নিতে পারেনি। ফল সচিবালয়ে, পুলিশে,বিচার বিভাগে বিভিন্ন সময়ে আমাদের বিরুদ্ধে নানা ষড়যন্ত্র চলে। যারা সচিবালয়ে আমাদের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করছেন, বলতে চাই —আপনারা ‘রিয়েলিটি মাইনা’ নেন। আপনাদের ‘আম্মু’ আর দেশে ফিরবে না। আমরা তাকে সীমান্তের ওপারে পাঠিয়েছি। এ দেশে হাসিনার পুনর্বাসন হবে না।
সমাবেশে নাগরিক কমিটির আহবায়ক নাসিরুদ্দীন পাটোয়ারী বলেন, আগামীতে যে ঘোষণাপত্র আসবে, সেখানে প্রত্যেক শহীদের রক্তের ফোঁটার কথা উল্লেখ থাকতে হবে। যদি আমরা সে কথাগুলো না পাই, তাহলে বাংলার চব্বিশের বাঘের বাচ্চারা তা মেনে নেবে না। ঘোষণাপত্রে ৫৩ বছরে যে প্রতিষ্ঠানগুলো ধ্বংস হয়েছে, তা সংস্কারের ইঙ্গিত থাকতে হবে। আমরা এক নতুন বাংলাদেশ দেখতে চাই। নতুন বাংলাদেশে কোনো শহীদ বা আহতের উপর চোখ রাঙানো চলবে না। টেন্ডারবাজি-চাঁদাবাজি হবে না।
নাগরিক কমিটির সদস্য সচিব আখতার হোসেন বলেন, বাংলাদেশের মানুষ জুলাই ঘোষণাপত্র চায়। তারা সংস্কার চায়, নতুন সংবিধান চায়। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন যখন জুলাই ঘোষণাপত্র পাঠ করার ঘোষণা দিয়েছে, তখন সরকার সকল রাজনৈতিক দলের সাথে আলোচনার ভিত্তিতে জুলাই ঘোষণাপত্র পাঠ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এটি বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের বিজয়।
তিনি বলেন, সরকারকে জানুয়ারির ১৫ তারিখের মধ্যে :জুলাইয়ের প্রোকলেমেশন' ঘোষণা করতে হবে। আমাদেরকে বলা হয়—নতুন সংবিধান করবে তার ম্যান্ডেট কোথায়? আমরা বলি নির্বাচিত প্রতিনিধিদের মাধ্যমেই নতুন সংবিধান হবে। বাংলাদেশের আগামী নির্বাচন হবে গণপরিষদ নির্বাচন। নির্বাচনে যারা জয়ী হবে, তারা একইসাথে সংবিধান বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেবে। নতুন সংবিধান গঠন করবে এবং আইনসভার সদস্য হিসেবে ভূমিকা পালন করবে।
জাতীয় নাগরিক কমিটির মূখ্য সংগঠক সারজিস আলম বলেন, আমাদের সামনে এখনও খুনী ও খুনীদের দোসররা উন্মুক্ত ঘুরছে। তিনি বলেন, আমরা গণহত্যার বিচার চাই, সিন্ডিকেট থেকে মুক্তি চাই, পাচারকৃত অর্থ ফেরত চাই, দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণ করে মানুষের স্বস্তি চাই, আহতদের সুচিকিৎসা চাই। যে স্বপ্ন নিয়ে এত মানুষ জীবন দিয়েছে কেউ যদি সে স্বপ্নের সঙ্গে, স্পিরিটের সঙ্গে সচিবালয় বসে, পুলিশে বসে— বিশ্বাসঘাতকতার চেষ্টা করে তাকে সমূলে উৎপাটিত করতে হবে।
জাতীয় নাগরিক কমিটির মুখপাত্র সামান্তা শারমিন বলেন, অভ্যুত্থানের পাঁচ মাস হলেও আমরা কাউকে দেখিনি 'জুলাই প্রোক্লেমেশন' ঘোষণার উদ্যোগ নিতে। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনকেই আবার দায়িত্ব নিতে হয়েছে ঘোষণাপত্র দেঅওয়ার জন্য। আমাদের উদ্যোগের পরেই সরকার 'প্রোক্লেমেশন' ঘোষনার উদ্যোগ নিয়েছে।
তিনি বলেন, জানুয়ারির ১৫ তারিখের মধ্যে তাদের জুলাই ঘোষণাপত্র দিতে হবে হবে। নয়তো ছাত্র-জনতা আবারও ৩ আগষ্ট ও ৩১ ডিসেম্বরের মতো লাখে লাখে রাজপথে নেমে আসবে।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের মুখপাত্র উমামা ফাতেমা বলেন, জুলাই ঘোষণাপত্র নিয়ে আমরা কালক্ষেপণ চাই না। আজ রীতিমতো বাধ্য হয়ে আমরা এখানে একত্রিত হয়েছি।
তিনি বলেন, আওয়ামী লীগের বিচারের আগে কোন নির্বাচন হবে না। আমরা জুলাইয়ের স্পিরিট নিয়ে রাজপথে আছি। নব্বইয়ের মতো, একাত্তরের মতো— জুলাইকে ব্যর্থ হতে দিব না।
আওয়ামীলীগ শাসনামলে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে কারাবন্দী থাকা জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী খাদিজাতুল কুবরা সমাবেশে বলেন, আমি খুনী হাসিনাকে ফ্যাসিস্ট বলার কারণে ১৫ মাস জেল খেটেছি। বর্তমানে দেখছি, আওয়ামী লীগের খুনিরা নিজেদের খোলোস পাল্টিয়ে বিএনপি এবং শিবিরে যোগ দিচ্ছে।এটা গ্রহণযোগ্য নয়। আমরা হাসিনার বিচার চাই এবং আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধ চাই।
গণ অভ্যুত্থানে নিহত মীর মুগ্ধ'র পিতা মীর মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, খুনীদের বিচার নিয়ে সরকারের যারা গাফিলতি করবে তাদের অবিলম্বে পদত্যাগ চাই। মীর মুগ্ধসহ যারা গণঅভ্যুত্থানে শহীদ হয়েছেন, আহত হয়েছেন, অংশগ্রহণ করেছেন সবাইকে 'বিপ্লবী যোদ্ধা' হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়ার জন্য দাবি জানাই।
সময়ের আলো/এম