আমাদের প্রিয় জীবন থেকে আরও একটি বছর চলে গেল। আমরা আরেক ধাপ মৃত্যুর দিকে এগিয়ে গেলাম। সচেতন বুদ্ধিমান মানুষের জন্য হিসাব করার সময় এসেছে, কী পেলাম, কী হারালাম আর কী অর্জন করলাম, কী করতে পারিনি। দুনিয়াবি ক্ষেত্রে মানুষ এই নীতি অবলম্বন করে, মাস বা বছর শেষ হলে ব্যবসা-বাণিজ্যসহ সব ক্ষেত্রেই লাভ-লোকসানের হিসাব করতে বসে। যা মানুষকে সামনের দিনে পথ চলতে ও সফলতা অর্জনে সাহায্য করে। ঠিক তদ্রুপ ঈমান-আমলের ক্ষেত্রে আত্মজিজ্ঞাসা বা মনের হিসাব গ্রহণ মুমিনদের জীবন চলার পাথেয়। প্রত্যেক মুমিনের এই হিসাব করা দরকার, জীবনের কেটে যাওয়া বছরগুলোতে তিনি ঈমান-আমলে কতটুকু উন্নতি করেছেন। আখেরাতের পথে কতটুকু সফলতা অর্জন করছেন।
মানুষের উচিত, আল্লাহর দরবারে আমল ওজন হওয়ার আগে নিজেই নিজের আমল ওজন করা, তার কাছে হিসাব দেওয়ার আগে নিজেই নিজের হিসাব নেওয়া এবং মহান রবের সামনে নিজেকে তুলে ধরার জন্য প্রয়োজনীয় প্রস্তুতি গ্রহণ করা। মানুষের নিজের হিসাব নিজে গ্রহণ সম্পর্কে কুরআন ও হাদিসে গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘হে মুমিনগণ! তোমরা আল্লাহকে ভয় করো। প্রত্যেক ব্যক্তির ভেবে দেখা উচিত, সে আগামী জীবনের জন্য কী অগ্রিম পাঠিয়েছে’ (সুরা হাশর, আয়াত : ১৮)। আল্লামা ইবনে কাসির (রহ.) এ আয়াতের ব্যাখ্যায় বলেন, তোমাদের নিজেদের হিসাবের মুখোমুখি হওয়ার আগে নিজের হিসাব নিজে করে নাও এবং তাকিয়ে দেখো তুমি নিজের চিরস্থায়ী বসবাসের জন্য, তোমার প্রতিপালকের সঙ্গে সাক্ষাতের জন্য কী সঞ্চয় করেছ।
হজরত ওমর (রা.) বলেছেন, ‘তোমরা হিসাবের সম্মুখীন হওয়ার আগে নিজেদের হিসাব করে নাও। আমল ওজন করার আগে নিজেদের আমলের ওজন নিজেরা করে নাও। আজকের হিসাব আগামীকালের হিসাব প্রদানকে সহজ করে দেবে। মহা হিসাবের সম্মুখীন হওয়ার জন্য প্রস্তুতি নাও। সেদিন উপস্থিত করা হবে তোমাদের আর কিছুই গোপন থাকবে না’ (মাওয়ায়েজে সাহাবা)। বিখ্যাত তাবেয়ি হজরত হাসান বসরি (রহ.) বলেন, ‘আল্লাহর কাছে হিসাব দিতে হবে এ ভয় করে যে নিজের কর্মের হিসাব নিজে করবে, সে সত্যিকারের সাহসী মুমিন। যারা দুনিয়াতে নিজেদের কর্মের হিসাব নিজেরা করেছে পরকালে তাদের হিসাব-নিকাশ হালকা ও সহজ হবে। আর যারা পৃথিবীতে নিজেদের হিসাব করেনি, পরকালে তাদের হিসাব দেওয়া হবে অত্যন্ত কঠিন’ (মাওয়ায়েজে সাহাবা)। বুদ্ধিমানের পরিচয় দিতে গিয়ে রাসুলুল্লাহ (সা.) ইরশাদ করেন, প্রকৃত বুদ্ধিমান সেই ব্যক্তি, যে নিজের নফসকে নিয়ন্ত্রণ করেছে এবং মৃত্যুপরবর্তী জীবনের জন্য নেক কাজ করেছে। আর অক্ষম সেই ব্যক্তি, যে নিজের নফসকে প্রবৃত্তির পেছনে পরিচালিত করে এবং আল্লাহর কাছে কেবল প্রত্যাশা করে। হাদিসে নফসকে নিয়ন্ত্রণের অর্থ হলো, কেয়ামতের দিন হিসাব নেওয়ার আগে দুনিয়ায় নিজেই নিজের হিসাব নেওয়া তথা মুহাসাবা করা। (তিরমিজি : ২৪৫৯)
আমাদের প্রত্যেকের কর্তব্য, জীবনের এই পর্বে এসে আত্মজিজ্ঞাসায় ব্রতী হওয়া। আল্লামা ইবনুল কাইয়িম (রহ.) বলেন, প্রথমে হিসাব নিতে হবে আল্লাহ আমার প্রতি যেসব কাজ, আকিদা ও বিশ্বাস ফরজ করে দিয়েছেন আমি সেটা আদায় করছি কি না? আদায় করে থাকলে সেটা কি ইখলাসের সঙ্গে আদায় করছি? সেটা আদায় করতে গিয়ে রাসুলুল্লাহ (সা.) এর সুন্নাহ অনুসরণ করছি কি না? এসব প্রশ্নের উত্তরে যদি কোনো ত্রুটি পরিলক্ষিত হয় তা হলে তা দূর করতে হবে এবং এর জন্য তাওবা ও ইস্তিগফার করতে হবে। এ ক্ষেত্রে প্রথমে তাওহিদকে প্রাধ্যান্য দেবে। দেখতে হবে আমি তাওহিদের পরিপূর্ণ আকিদা পোষণ করছি কি না? সব প্রকার ছোট-বড় শিরক থেকে পবিত্রতা অর্জন করতে পেরেছি কি না? সব ক্ষেত্রে আল্লাহর ওপর ভরসা, তাওয়াক্কুল ও তার কাছে আশ্রয় নেওয়া এবং তার কাছেই প্রার্থনা করছি কি না? অতঃপর ফরজ আমলের হিসাব শুরু করবে। তাতে কোনো ত্রুটি বুঝতে পারলে কাজা অথবা সংশোধনের মাধ্যমে তার প্রতিবিধান করবে। তারপর নিষিদ্ধ বিষয়ের হিসাব নেবে। যখন সে বুঝতে পারবে যে, সে কোনো একটা নিষিদ্ধ কাজ করে ফেলেছে তা হলে তওবা, ইস্তিগফার ও পাপ বিমোচক কোনো পুণ্য কাজ করে তার প্রতিবিধান করবে। তারপর গাফিলতির হিসাব নেবে। নিজের সৃষ্টির উদ্দেশ্য সম্পর্কে যদি সে গাফেল থাকে তা হলে আল্লাহর দিকে ফিরে আসা এবং জিকির করার মাধ্যমে সে গাফিলতির প্রতিবিধান করবে। (ইগাসাতুল লাহফান : ১/৮৩) বছর শেষ কি আনন্দের বিষয়? বর্তমানে বছর শেষ হলে আনন্দের সঙ্গে বর্ষকে বিদায় জানানো হয়। আসলে বর্ষ বিদায় আদৌ কোনো আনন্দের বিষয় নয়। বুদ্ধিমান কখনোই এ কাজ করতে পারে না। বর্ষ বিদায় তো মানুষের জন্য কষ্টের, কান্না ও আফসোসের; কারণ তার প্রিয় জীবন থেকে আরও একটি বছর চলে গেল।
ইমাম ইবনুল জাওজি বলেন, সম্পদ কমে গেলে যদি আফসোস হয়, তা হলে হায়াত কমে যাওয়ার কারণে তো চিৎকার করে কান্না করা উচিত। বছর বিদায় মানে তো আমার হায়াত কমে গেল, তা হলে আমি কীভাবে বছর বিদায়ের আনন্দ উদযাপন করি। কবি বলেছেন, ‘জীবনের দেয়াল থেকে আরেকটি ইট খসে পড়ল। মূর্খ এবং বেকুব বলছে শুভ নববর্ষ।’ বর্ষবরণে আতশবাজির মাধ্যমে অনেক অনাচার ও অত্যাচার করা হয়। অনেক অসুস্থ ব্যক্তির জীবন বিপন্ন হয়। গত বছর আমরা দেখেছি উমায়ের নামের একটি ছোট্ট শিশু আতশবাজির কম্পনে মারা গিয়েছিল। এরপরও যদি আমাদের হুঁশ না আসে, আমরা এগুলো থেকে বিরত না থাকি; তা হলে আমরা মুসলমান হওয়া তো দূরে থাক, এখনও মানুষ হতে পারিনি। মহান আল্লাহ আমাদের সঠিক জ্ঞান দান করুন।
শিক্ষক, প্রাবন্ধিক, আলোচক
সময়ের আলো/জেডআই