ই-পেপার শুক্রবার ১৪ মার্চ ২০২৫
শুক্রবার ১৪ মার্চ ২০২৫
ই-পেপার

শুক্রবার ১৪ মার্চ ২০২৫

প্রতিবন্ধীদের অন্তর্নিহিত শক্তি সন্ধান করতে হবে
প্রকাশ: মঙ্গলবার, ৩১ ডিসেম্বর, ২০২৪, ১:৪২ এএম  (ভিজিট : ২৫৪)

প্রতিবন্ধিতা এমন একটি অবস্থার অভিজ্ঞতা যা একজন ব্যক্তির জন্য নির্দিষ্ট কাজ করা অক্ষমতা। এটি বিকাশমূলক ও বুদ্ধিবৃত্তিক হতে পারে। হতে পারে শারীরিক, মানসিক কিংবা সংবেদনশীলতারও। এটি কারও কারও ক্ষেত্রে জন্মগতভাবে হতে পারে আবার কারও কারও ক্ষেত্রে এটি জীবদ্দশাতেও হতে পারে।

বয়স, লিঙ্গ, জাতি, সংস্কৃতি বা সামাজিক অবস্থান অনুযায়ী অন্যরা যা করতে পারে। সে কাজগুলো প্রাত্যহিক জীবনে করতে না পারার অবস্থাটিই হলো প্রতিবন্ধিতা। এটি দেহের কোনো আংশিক বা সম্পূর্ণরূপে, কখনো ক্ষণস্থায়ী বা চিরস্থায়ীভাবে স্বাভাবিক কার্যক্ষমতা হারানোর অবস্থা হতে পারে।

সব ধরনের মানুষ নিয়ে একটি সমাজ গঠিত হয়, সবাই সমাজের অংশ। এই সমাজের কাউকে বাদ দিয়ে উন্নয়নের স্রোতধারা প্রবাহিত হতে পারে না। সে অর্থে প্রতিবন্ধী ব্যক্তিরা সমাজের অংশ, তাদেরও উন্নয়নের মূল স্রোতে সম্পৃক্ত করতে হবে। তাদের নানাভাবে প্রশিক্ষণ দিয়ে দক্ষ করে তুলতে হবে। তারপর যথাযথভাবে সম্মানের সঙ্গে সমাজে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার সুযোগ করে দিতে হবে। অন্তর্ভুক্তিমূলক সমাজ গঠনে অবশ্যই প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের সঙ্গে নিয়ে এগিয়ে যেতে হবে। এ কথাও ঠিক যে, সঠিক শিক্ষা এবং পুনর্বাসনের পর তাদের কাজের ব্যবস্থা না হলে সমস্যার সৃষ্টি হবে। পুনর্বাসনের চূড়ান্ত উদ্দেশ্যই হলো তাদের স্বনির্ভর করে তোলা।

ধরে নেই একজন প্রতিবন্ধী ব্যক্তি পড়াশোনা করে, নানা প্রশিক্ষণের মাধ্যমে দক্ষতা অর্জন করে যদি কোনো চাকরি প্রাপ্ত না হয় বা তার শ্রম এবং মেধা যদি কোথাও প্রয়োগ করতে না পারে তা হলে সঠিক পুনর্বাসন হয় না।

একজন প্রতিবন্ধী ব্যক্তিকে মূলধারায় অন্তর্ভুক্তির জন্য সবার আগে জানতে হবে, এই কাজে কোথায় কী বাধা আছে এবং কীভাবে বাধাগুলো দূর করা যায়। তা হলেই কাজটি সহজ এবং সফল হবে। এর সঙ্গে যুক্ত করতে হবে সদিচ্ছাও।

একই সঙ্গে আমরা বলতে পারি প্রতিবন্ধীদের দক্ষ করে তুলতে সমাজের সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে। এটি হতে হবে সরকারি ও বেসরকারিভাবে। তা ছাড়া অন্যান্য সংস্থাকেও এ কাজে এগিয়ে আসতে হবে। এটি একটি সমন্বিত কার্যক্রম। আমাদের দেশের মোট জনসংখ্যার ১০ শতাংশ প্রতিবন্ধী। সেই হিসেবে একটি বড় অংশই প্রতিবন্ধী, তাই তাদের বাদ দিয়ে কিছুই ভাবা যাবে না, ভাবা উচিতও নয়।

প্রত্যেকে মানুষের ভেতরেই একটি অন্তর্নিহিত শক্তি থাকে, এটি প্রতিবন্ধীদের মধ্যে অন্যদের চেয়ে একটু বেশিই থাকে। তাদের ভেতরের সেই অন্তর্নিহিত শক্তিকে বের করে আনতে হবে। তাদের জন্য সঠিক কর্মপরিবেশ প্রস্তুত করে দিতে হবে। শুধু তাই নয়, সেই পরিবেশে সবাইকে নিয়ে একসঙ্গে কাজ করতে হবে। যথাযোগ্য সম্মান দিয়ে তাদের দক্ষতা উন্নয়ন করে, কর্মসংস্থান সৃষ্টি করে জীবন ও জীবিকার পথ সম্প্রসারিত করতে হবে।

প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের মূল ধারায় অন্তর্ভুক্ত করতে চাইলে লক্ষ্য নির্ধারণের প্রয়োজন রয়েছে। কিছু সুযোগ শুধু তাদের জন্য সুনির্দিষ্টভাবে সংরক্ষণ করা দরকার। প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের জন্য চাকরি প্রদানকে বোঝা হিসেবে দেখা উচিত নয়। বরং তাদের একটি দেশের সম্পদ হিসেবে বিবেচনা করতে হবে। এর সুফল গ্রহণ করার মানসিকতাও থাকতে হবে। একসময় মনে করা হতো প্রতিবন্ধী মানুষের মধ্যে শিক্ষার হার খুব কম, বিশেষ করে গ্রাম ও মফস্বলে। তথ্যটি ভুল। বর্তমানে প্রচুরসংখ্যক প্রতিবন্ধী ব্যক্তি শিক্ষিত হয়ে উঠছে। আমাদের সমাজে প্রতিবন্ধী ব্যক্তিরা যতই শিক্ষিত হোক না কেন, তাদের সহজভাবে নিতে না পারার কারণে কাজে নিয়োগ দেওয়া যায় না।

কর্মস্থলে যাতায়াতের সমস্যার কারণে তাদের কর্মে নিয়োগ দেওয়া হয় না। নতুন করে ভাবার বিষয় হলো, প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের যোগ্যতা ও প্রতিভা থাকলে এবং এর সঙ্গে সুযোগ থাকলে বাসায় বসে কাজ করার সুযোগ করে দেওয়া যায়। তাতে অর্থ উপার্জনের সঙ্গে সঙ্গে পরিবার ও সমাজে তাদের মর্যাদা বৃদ্ধি পাবে। অন্যদের দৃষ্টিতে তারা দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবে।

এ কথাও ঠিক যে, প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের কর্মসংস্থানের ক্ষেত্রে লিঙ্গভিত্তিক ডেটা প্রস্তুত করা দরকার। সেভাবেই কাজে নিয়োগ দিতে হবে। যদিও একজন প্রতিবন্ধী পুরুষের চেয়ে নারীর জীবনযাপনেও এগিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে অন্যদের চেয়ে চ্যালেঞ্জ অনেক বেশি। প্রতিদিনের জীবনের মতো কর্মক্ষেত্রেও তাদের জন্য খুব এক সহজ নয়। তারা অনেক তথ্য সঠিকভাবে পায় না বা নতুন কাজের জন্য এগিয়ে যেতে পারে না। বিষয়টি বিবেচনা সাপেক্ষ।

প্রতিবন্ধী নারীদের যোগ্যতা এবং আগ্রহকে মাথায় রেখে কর্মক্ষেত্র খুঁজে পাওয়ার ওপর গুরুত্ব দিতে হবে। তাদের দিতে হবে সামাজিক নিরাপত্তা এবং একই সঙ্গে দরকার অর্থনৈতিক নিরাপত্তাও। কর্মক্ষেত্র ও অর্থক্ষেত্রে যেন তারা অন্যদের দ্বারা প্রতারিত না হয় তাও খেয়াল রাখতে হবে। তা ছাড়া পেশাগত জীবনে প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের বাসস্থান থেকে কর্মস্থলে যাতায়াতের বিষয়টিও বিবেচনায় রাখতে হবে। কারণ আমাদের দেশে এখন পর্যন্ত কোনো ধরনের প্রতিবন্ধীবান্ধব যানবাহন নেই। সাধারণ যানবাহনে যদি প্রতিবন্ধী আসন থাকেও তা কখনোই তারা ব্যবহার করতে পারে না, সময়ের আগে এসব আসন স্বাভাবিক মানুষের দখলে চলে যায়। প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের জন্য উপযুক্ত যানবাহন রাখতে হবে। সাধারণ যানবাহনে সুনির্দিষ্ট আসনের ব্যবস্থা রাখতে হবে। তারা যেন এসব আসনে বসতে পারে, তাও খেয়াল রাখতে হবে।

প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের জন্য যথোপযুক্ত বাসস্থানের ব্যবস্থা রাখতে হবে। সে বাসস্থান এমন হবে যেন সহজভাবে চলাফেরা করতে পারে। কর্মস্থলে রাখতে হবে প্রতিবন্ধীবান্ধব ও অগ্রাধিকারভিত্তিক শৌচাগার। প্রতিবন্ধী ব্যক্তিরা যেন সমাজে নিজের মতো বাঁচতে পারে, এটাই আমাদের প্রত্যাশা হতে পারে। যে জন্য কাজও করে যেতে হবে এবং তাও করতে হবে সমাজের সবাইকে নিয়ে।

দুঃখজনক হলেও সত্যি যে, সরকারি অফিসে প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের অবস্থান প্রায় শূন্যের কোটায়। প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের জন্য অধিকার সুরক্ষা কমিটিতেও নেই কোনো প্রতিবন্ধী ব্যক্তি, যা ভাবাই যায় না।

আমাদের সমাজে প্রতিবন্ধী ব্যক্তিরা রাজনৈতিক ক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি উপেক্ষিত। সামাজিক ক্ষেত্রেও তাদের অবহেলা করা হয়। এ ছাড়া আরও অনেক ক্ষেত্র আছে। কোনো কোনো পরিবার নিজেরাই তাদের প্রতিবন্ধী সন্তানকে জনসমক্ষে আনতে প্রস্তুত নয়, এটি অত্যন্ত নেতিবাচক দিক। এর ফলে এই সন্তানরা সমাজের জন্য আরও বেশি বোঝা হয়ে যায়।

সময় বদলে গেছে, বিজ্ঞান এগিয়ে গেছে। এখন মানুষের মেধার মূল্য অনেক বেশি। কেউ শারীরিকভাবে অক্ষম হলেই যে মানসিকভাবে অক্ষম হবে এমনটি ভাবার কিছু নেই। তাদের মধ্যে এমন কোনো প্রতিভা থাকা সম্ভব যার দ্বারা সমাজের কল্যাণ হতে পারে। তাই তাদের অবহেলা করা যাবে না।

আমাদের দেশে প্রতিবন্ধী ব্যক্তির অধিকার প্রতিষ্ঠা ও সুরক্ষা নিশ্চিতকরণের লক্ষ্য প্রতিবন্ধী ব্যক্তির অধিকার ও সুরক্ষা আইন ২০২৪-এর ধারাগুলো স্মরণে রাখলে এবং তা কাজে পরিণত করলে প্রতিবন্ধী ব্যক্তিরা সমাজে উপযুক্ত অবস্থানে প্রতিষ্ঠিত হতে পারবে। তাদের জন্য রয়েছে সমঅধিকার, মানবসত্তার মর্যাদা, মৌলিক মানবাধিকার ও সামাজিক সাম্য প্রতিষ্ঠার অঙ্গীকার। এই আইনে প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের মর্যাদা সমুন্নতকরণ, অধিকার সুরক্ষা ও উন্নতিসাধন নিশ্চিত করার কথা বলা হয়েছে।

বিষয়টিকে মাথায় রেখে সবারই সচেতন হওয়ার সময় হয়েছে এখন। এই মর্মে প্রতিবন্ধী মানুষের স্বার্থের কথা মনে রেখে ১৯৯৯ সালে প্রথমবারের মতো জাতীয় প্রতিবন্ধী উন্নয়ন ফাউন্ডেশন গঠন করা হয়েছে। এসব আইন ও বিধিবিধানের আলোকে প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের মৌলিক চাহিদাগুলো পূরণ, ক্ষমতায়ন এবং আমাদের দেশের অন্যান্য জনগণের মতো সমান অধিকার নিশ্চিত করার জন্য কার্যক্রম গ্রহণ করা যায়।
আমাদের মনে রাখা দরকার, প্রতিবন্ধী ব্যক্তিরা সমাজের বোঝা নয়, সম্পদ। তারাও সমাজ ও জনগণের অবিচ্ছেদ্য অংশ, তাই তাদের অবহেলা করা যাবে না, পর্যাপ্ত সুযোগ-সুবিধা, সেবা, চিকিৎসা, শিক্ষা, প্রশিক্ষণ ও দক্ষতা সহায়ক উপকরণ পেলে প্রতিবন্ধী ব্যক্তিরাও সমাজের বিভিন্ন ক্ষেত্রে অসাধারণ অবদান রাখতে সক্ষম। এ জন্য তাদের বিশেষ চাহিদা পূরণে এবং অধিকার রক্ষায় সরকারি ও বেসরকারিভাবে সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে। এ ছাড়া সমাজের সব পেশার মানুষ তাদের প্রতি যথার্থই আন্তরিক হতে হবে। তবেই তারা প্রতিবন্ধকতাকে দূর করে সুন্দর ও সাফল্যের পথে এগিয়ে যেতে পারবে, দেশ ও জাতির জন্য নিয়ে আসতে পারবে সম্ভাবনাময় একটি ভবিষ্যৎ। প্রতিন্দ্বীরা কখনোই সমাজের বোঝা নয়, তারা সমাজের একটি সম্পদ।

লেখক : কথাসাহিত্যিক

সময়ের আলো/জেডআই




https://www.shomoyeralo.com/ad/1698385080Google-News-Update.jpg

সর্বশেষ সংবাদ

সর্বাধিক পঠিত


ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক : সৈয়দ শাহনেওয়াজ করিম, আমিন মোহাম্মদ মিডিয়া কমিউনিকেশন লিমিটেড এর পক্ষে প্রকাশক গাজী আহমেদ উল্লাহ। নাসির ট্রেড সেন্টার, ৮৯, বীর উত্তম সি আর দত্ত সড়ক (সোনারগাঁও রোড), বাংলামোটর, ঢাকা।
ফোন : +৮৮-০২-৯৬৩২৩৬৮-৭৪, ফ্যাক্স : +৮৮-০২-৯৬৩২৩৭৫ | ই-মেইল : shomoyeralo@gmail.com
close