
প্রযুক্তি-বিপ্লবের কল্যাণে বর্তমান সময়ে যোগাযোগের অন্যতম মাধ্যমে পরিণত হয়েছে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম। মানুষ এখন ঘরের কোনায় বসে মুহূর্তেই বার্তা পৌঁছে দিচ্ছে পৃথিবীর এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে। পুরো দুনিয়ার সঙ্গে সংযোগ স্থাপন করা যাচ্ছে খুব সহজে। মোবাইল ফোনে ইন্টারনেট সেবা সহজ করে দেওয়ার ফলে শিক্ষিত লোক তো বটেই, স্বল্পশিক্ষিতরাও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের ভরপুর ব্যবহার করে চলেছে।
প্রায় সব শ্রেণির মানুষ এখানে প্রাত্যহিক জীবনের একটি গুরুত্বপূর্ণ সময় ব্যয় করছে। সকাল কিংবা সন্ধ্যা, কোনো না কোনো সময় তার ধ্যান-জ্ঞান সোশ্যাল মিডিয়ায় শেয়ার করছে। প্রতিদিনই বাড়ছে এর ব্যবহারকারী। মাধ্যমও বাড়ছে সংখ্যায়। তবে অন্যতম শক্ত অবস্থান দখল করে রেখেছে ফেসবুক, ইউটিউব ও টুইটার।
বর্তমান সময়ে সামাজিক যোগাযোগ বলতে শুধু একটা সমাজের মানুষের মধ্যে যোগাযোগ বোঝায় না। গণমাধ্যমের পরিপূরক হিসেবেও নিচ্ছে অনেকে। সামাজিক যোগাযোগের পরিধি এখন সমাজ, গোষ্ঠী এবং রাষ্ট্রকে ছাড়িয়ে সারা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়েছে।
প্রতি মুহূর্তে দিচ্ছে নানা খবরাখবর। ব্যক্তিবিশেষে এসব খবরের গুরুত্বও বাড়ছে। স্বভাবতই মাধ্যমটি দখল করে নিয়েছে শক্ত অবস্থান। বিশেষ করে বাংলাদেশে অনেক ভুঁইফোঁড় গণমাধ্যমের চেয়ে বিশ্বাসযোগ্য অবস্থানে রয়েছে ফেসবুক। কিন্তু এ দেশে যখন এসব সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের ব্যবহার শুরু হয় তখন থেকে গণমাধ্যমের সহায়ক হিসেবেই কাজ করত এটি। নানা খবরাখবর পাওয়া যেত সামাজিক মাধ্যমে। এখনও পাওয়া যায়। এখান থেকে তথ্য নিয়ে গুরুত্বসহকারে অনুসন্ধান করে আসল রহস্য বের করে এনেছে গণমাধ্যমকর্মীরা। এরপর তা গণমাধ্যমে প্রচারের পর আলোচিত হয়েছে। আবার অনেক সংবাদ গণমাধ্যমে প্রচারের পর সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে তা ছড়িয়ে দেওয়া হতো।
এখনও হয় এটি। কিন্তু দিনে দিনে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের অবস্থান শক্ত হচ্ছে। অনেক ক্ষেত্রে গণমাধ্যমের চেয়েও। প্রভাবও ফেলছে গণমাধ্যমের ওপর। পেশাদার সংবাদপত্র বা টেলিভিশন চ্যানেলগুলো কোনো খবর এড়িয়ে গেলেও ফেসবুকে কারও না কারও ব্যক্তিগত উদ্যোগে প্রকাশ হয়ে যায়, উঠে আসে আলোচনায়। ফলে শুধু যে গণমাধ্যমের অনেক খবরের উৎস হয়ে উঠেছে ফেসবুক তা-ই নয়, অনেক ক্ষেত্রে পত্রিকা ও টেলিভিশনের ওপর চাপও সৃষ্টি করে যাতে খবরটি গুরুত্বের সঙ্গে প্রকাশ ও প্রচার করতে বাধ্য হয়।
উদাহরণস্বরূপ জুলাই আন্দোলনের কথাও উল্লেখ করা যায়। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে এই আন্দোলন ব্যাপকভাবে প্রভাব বিস্তার করে। তাৎক্ষণিক সব তথ্য আদান-প্রদান ও ছড়িয়ে দেওয়ায় প্রবাসীরাও দেশে না থেকেও আন্দোলনে যুক্ত হয়। তারা ঘোষণা দেয়, রেমিট্যান্স না পাঠানোর। এতে বিগত সরকারের আর্থিক খাত চরম অনিশ্চয়তায় পড়ে যায়। এভাবে অন্যদেরও আন্দোলনে যুক্ত করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
উল্লেখ করতেই চাই কয়েক বছর আগে ঘটে যাওয়া সিলেটের আলোচিত শিশু সামিউল হোসেন রাজন হত্যা, বনানীর রেইনট্রি হোটেলে বিশ্ববিদ্যালয়ের দুই তরুণীকে ধর্ষণের ঘটনা ও গুলশানের হলি আর্টিসানে জঙ্গি হামলার বিষয়টি উল্লেখ করা যেতে পারে। রাজন হত্যার ভিডিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভাইরাল হওয়ার পরই তা গণমাধ্যমে উঠে আসে। আলোচিত হয়। শেষ পর্যন্ত অপরাধীদের বিচারের আওতায় আনা হয়।
রেইনট্রি হোটেলে ধর্ষণের বিষয়টিও ওই দুই তরুণীর ফেসবুকের স্ট্যাটাস থেকে প্রথমে প্রচার করা হয়। আর হলি আর্টিসানের স্বচ্ছ বিবরণ তো সম্পূর্ণই ভিডিও ফুটেজ দেখে বের করা হয়। যে ভিডিও ফুটেজ থেকে মানুষ নৃশংস ঘটনাটির সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য কিছু বিবরণ পায়, তা পাশের এক ভবন থেকে একজন কোরীয় নাগরিকের তোলা। ফেসবুকে প্রথম তা প্রকাশ বা প্রচার হয় এবং মুহূর্তেই ছড়িয়ে পড়ে বা ভাইরাল হয়ে যায়। হলি আর্টিসানের ঘটনার তদন্তকারীরা ভিডিওচিত্র থেকে অনেক গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পান, যা তদন্তকে সহায়তা করেছে। সহায়তা করেছে নরঘাতক জঙ্গিদের নির্মূল অভিযানকে। গণমাধ্যমও ফুটেজটি থেকে অনেক তথ্য নিয়েছে। অবশ্য এর সঙ্গে অনেক অনুসন্ধানী প্রতিবেদনও যুক্ত হয়েছে। তবে মূল সূত্র তো ওই ভিডিও থেকেই পেয়েছে। যা ফেসবুকের কল্যাণে পাওয়া।
এ ছাড়াও সাম্প্রতিক সময়ে গণমাধ্যমে উঠে আসা আলোচিত অনেক সংবাদ ঘাটলেই দেখা যাবে এর মূল সূত্র বা ইঙ্গিত ওই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম থেকেই পাওয়া। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের এই শক্ত অবস্থানের পেছনে অবশ্য দুইটি অবস্থাকে চিহ্নিত করা যেতে পারে। প্রথমত, বর্তমান গণ্যমাধ্যমের বিশ্বাসযোগ্যতা কমে যাওয়া। দ্বিতীয়ত, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের সহজলভ্যতা।
প্রথমটির পেছনে অবশ্য অনেক কারণ রয়েছে। হলুদ সাংবাদিকতা, গণসাংবাদিকতা, অসাংবাদিকতা, অপসাংবাদিকতাসহ নানা কারণ নিয়ে আলোচনা হতে পারে। আর দ্বিতীয়টাকে অবশ্যই ইতিবাচকভাবে দেখতে হবে। আজ হাতের মুঠোয় বিশ্ব। প্রত্যন্ত গ্রামাঞ্চলের ঘটনা মুহূর্তেই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে যা এর আগে কখনো গণমাধ্যমে দেওয়ার সুযোগই ছিল না। এমনও অনেক গ্রাম রয়েছে যেখানের সব থেকে গুরুত্বপূর্ণ ঘটনাও গণমাধ্যমে স্থান পায় না।
গণমাধ্যম কর্মীরাই জানেন না। অথবা জানলেও যোগাযোগ ব্যবস্থার দুরবস্থার কারণে সেখানে গিয়ে মূল সংবাদ সংগ্রহ সম্ভব হয়ে ওঠে না। সেসব সংবাদ বর্তমানে মুহূর্তেই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে। বিশ্বের এ প্রান্ত থেকে ওই প্রান্তে পৌঁছে যায় নিমিষেই। আবার ওই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম থেকে নিয়ে অনেক সময় গণমাধ্যমও প্রচার করে।
ফলে পায় প্রচার গ্রহণযোগ্যতা। আবার প্রযুক্তির উন্নতির ফলে দেশের প্রায় সব গণমাধ্যমই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে তাদের নিজস্ব প্রচার-প্রচারণা চালাচ্ছে। গণমাধ্যমে প্রচার হওয়া সংবাদটি বহুল প্রচারের জন্য শেয়ার দেওয়া হয় ফেসবুকে, টুইটারে, হোয়াটসঅ্যাপ ও ইউটিউবে।
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের ব্যপ্তি ও গণব্যবহার লক্ষ করা যাচ্ছে। একসময় মিডিয়ায় বিজ্ঞাপন প্রচারের জন্য ব্যবসায়ীদের প্রচুর টাকা ঢালতে হতো, এখন তুলনামূলক নামমাত্র খরচে সোশ্যাল মিডিয়ায় তারা বিজ্ঞাপন দিতে পারছেন। ফলে বিজ্ঞাপন প্রচার, সংবাদ প্রচার এবং তা প্রয়োজনমতো ছড়িয়ে দেওয়া সবই হচ্ছে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে। গণমাধ্যমে যা যা পাওয়া যায় তার প্রায় সবই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে পাওয়া যাচ্ছে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে বেশিও পাওয়া যাচ্ছে। তবে পাঠকের বৃহৎ একটি অংশ অনায়াসেই আশ্রয় নিচ্ছে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে।
এরপরও গণমাধ্যমের গুরুত্ব কোনোভাবেই কমেনি। নতুন একটি দৈনিক পত্রিকা বাজারে এলে কিংবা পুরোনো পত্রিকা নতুনভাবে বাজারে এলে মানুষের সীমাহীন আগ্রহ দেখা যায়। ইউরোপ-আমেরিকাসহ বিভিন্ন দেশে দৈনিক পত্রিকার বিজ্ঞাপনের মূল্যও অন্যান্য গণমাধ্যমের তুলনায় বেশি। দৈনিক পত্রিকা আদালতের আমলযোগ্য নথি। রেফারেন্স ও বিশ্বাসযোগ্যতার প্রশ্নে অন্য কোনো মাধ্যমই ছাপা পত্রিকার বিকল্প এখনও হয়ে উঠতে পারেনি।
লেখক : প্রাবন্ধিক
সময়ের আলো/জেডআই