
বিশ্বের সবচেয়ে ঘনবসতিপূর্ণ শহরগুলোর মধ্যে ঢাকা অন্যতম। ওয়ার্ল্ড পপুলেশন রিভিউ অনুসারে ঢাকার বর্তমান জনসংখ্যা ২ কোটি ৩৯ লাখ ৩৫ হাজারের বেশি। রাজধানীতে মানুষের বসবাসের সংখ্যাও দিন দিন বাড়ছে। ২০১৮ সালেও ঢাকা ছিল এই তালিকার ৭ নম্বরে।
৬ বছরের ব্যবধানে এখন ৪ নম্বরে। ঢাকায় জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার ৩ শতাংশেরও বেশি। এই বিশাল মানুষের বোঝা বইতে পারছে না ঢাকা। এর প্রভাব পড়ছে প্রতিটি ক্ষেত্রেই। আর দুর্বিষহ হয়ে উঠেছে নগরজীবন। অলিগলিতে, রাস্তাঘাটে, পাড়ায় মহল্লায় যেখানেই বের হবেন, দেখতে পাবেন যেন সর্বত্রই হাটবাজার।
রাজধানী শহর ঢাকা বাসযোগ্যতা হারিয়েছে অনেক আগেই। দূষণেও সেরাদের তালিকায় স্থান পেয়েছে। দীর্ঘদিন থেকেই দূষণের নগরীর হিসেবে পরিচিতি পেয়েছে দুই কোটিরও বেশি মানুষের এই শহর। পানি-বায়ু-শব্দ-সব ধরনের দূষণে নাজুক এখন ঢাকা। আমরা যারা ঢাকা শহরে বাস করি তারা জানি, প্রতি পদে কত যন্ত্রণা ভোগ করি। ধুলায়, ধোঁয়ায় আচ্ছন্ন পুরো শহর, নিশ্বাস নিতে কষ্ট হয়। শরীর অসুস্থ হয়ে পড়ে। অতিরিক্ত ট্রাফিক জ্যামের কারণে দশ মিনিটের পথ পার হতে দুই ঘণ্টা লেগে যায়। সময়মতো গন্তব্যে পৌঁছাতে পারে না মানুষ। চারশ বছরের পুরোনো এই শহর আমাদের অতি আপন, হৃদয়ের অংশ। বাসিন্দা হিসেবে দূষিত বায়ুতে ধুঁকে ধুঁকে আর মরতে চায় না মানুষ। এই নগরীর গর্বিত নাগরিক হিসেবে আমরা প্রাণোচ্ছল জীবন চাই, চাই আনন্দে বেঁচে থাকতে। জনবহুল শহরের তালিকায় বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকার অবস্থান চতুর্থ। দিনে দিনে রাজধানী ঢাকার আয়তন যেভাবে বাড়ছে তেমনি বাড়ছে জনসংখ্যা। বাড়তি মানুষের চাপে ঢাকা বসবাসের অযোগ্য হয়ে উঠছে। নানা সংকটে জর্জরিত নগরবাসীর নাভিশ্বাস চরমে উঠছে। যানজট, পানি, গ্যাস, বিদ্যুৎ সংকট, মাদকের আগ্রাসন, চুরি, ছিনতাই, চাঁদাবাজি, মশার উপদ্রব প্রভৃতি সমস্যাকে নিত্যসঙ্গী করে বসবাস করছেন সবাই।
উচ্চবিত্ত, মধ্যবিত্ত, নিম্নবিত্ত, বিত্তহীন, ছিন্নমূল বস্তিবাসী সবাইকে একধরনের অস্থিরতা, অতৃপ্তি, অশান্তি, অতুষ্টি নিয়ে থাকতে হচ্ছে ঢাকায়। এত সমস্যা, সংকট, অস্বস্তি, অস্থিরতা, অনিশ্চয়তার কথা জানার পরও প্রতিদিনই গ্রাম ছেড়ে ঢাকায় পা রাখছেন অগণিত নারী-পুরুষ। দরিদ্রের কারণেই যে গ্রামের মানুষ শহরমুখী হন তা বলা যায় না এখন। অস্বাভাবিক হারে বাড়ছে ঢাকামুখী জনসংখ্যার চাপ। গ্রামাঞ্চলের তুলনায় নগরীতে কর্মসংস্থান এবং নাগরিক সুবিধা বেশি থাকায় দিন দিন উদ্বেগজনক হারে বেড়েই চলেছে রাজধানীর লোকসংখ্যা। গ্রাম থেকে মানুষের ঢাকায় আসা কমাতে বা বন্ধ করতে চাইলে ব্যাপকভিত্তিক বিকেন্দ্রীকরণের পাশাপাশি গ্রামে কর্মসংস্থান ও নাগরিক সুবিধাদি সহজলভ্য করার বিকল্প নেই। সচ্ছলতা থাকার পরও আজকাল অনেকেই গ্রাম কিংবা মফস্বল শহর ছেড়ে অপেক্ষাকৃত উন্নত এবং মানসম্মত জীবনযাপনের আশায় ঢাকায় চলে আসছেন। ফলে গ্রামগুলোতে কৃষিকাজের লোকের অভাবে কৃষিজমি পতিত থেকে যাচ্ছে। কৃষি শ্রমিকের অভাবে ফসল আগের মতো আর ফলানো যাচ্ছে না। ফলে বাধ্য হয়ে চাহিদা মেটাতে কৃষিপণ্য পার্শ্ববর্তী দেশ থেকে আমদানি
করতে হচ্ছে।
১৯৭১ সালে দেশ স্বাধীন হওয়ার পর থেকে বাংলাদেশের বেশিরভাগ মানুষ ঢাকামুখী হয়েছে। ১৩৪ বর্গমাইল আয়তনের ঢাকায় মোট জনসংখ্যা প্রতি বর্গমাইলে প্রায় ১ লাখ ১৫ হাজার লোকেরও বেশি বাস এবং প্রতিদিনই নতুন করে যোগ হচ্ছে। এ বর্ধিত লোকসংখ্যা খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান, চিকিৎসা, শিক্ষা এবং যাতায়াতের ওপর চাপ সৃষ্টি করে চলেছে অবিরত। শুধু ঢাকা শহর নয়, জনসংখ্যা শহর এবং গ্রাম নির্বিশেষে পুরো দেশের সামাজিক পরিবর্তন ঘটায়। জনসংখ্যা সমস্যা সমাজের প্রতিটি ক্ষেত্রে সমাজের পরিবর্তন ঘটায়। তা ছাড়া জনসংখ্যা বৃদ্ধির ফলে দেশের যানবাহনেরও সংকট সৃষ্টি হয়েছে।
বাংলাদেশের সমাজ পরিবর্তনে ঢাকা এ সমস্যাগুলোর মূলে রয়েছে জনসংখ্যা বৃদ্ধি। জনসংখ্যা শুধু গ্রাম আর শহর নয়, পুরো দেশের সামাজিক পরিবর্তন ঘটায়। দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি, নিম্ন মাথাপিছু আয়, খাদ্যঘাটতি, বেকার সমস্যা আমাদের নিত্যদিনের সঙ্গী। আর এর মূলে রয়েছে জনসংখ্যা বৃদ্ধি। সুন্দর ভবিষ্যৎ সবার কাম্য। কিন্তু আমরা কয়জনেই-বা এর গুরুত্ব অনুধাবন করতে পারছি। যারা এ কর্তব্য মেনে চলছেন, তাদের বাসস্থান, চিকিৎসা, শিক্ষা ইত্যাদি বিষয়ে তেমন বেগ পেতে হচ্ছে না।
বাংলাদেশের জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার রোধ করতে হলে পুরোনো যত কুসংস্কার আছে, সেগুলোকে পরিশোধন করে সমাজব্যবস্থায় নতুন পরিকল্পনা গ্রহণ করতে হবে। জনসংখ্যা বৃদ্ধির জন্য দায়ী মূলত অশিক্ষা, দারিদ্র্য, অসচেতনতা, পিছিয়ে পড়া সমাজব্যবস্থা; সেইসঙ্গে কুসংস্কার, কুশিক্ষা, ধর্মীয় মূর্খতা এবং সংশ্লিষ্টদের দায়িত্বহীনতা । এ সমস্যাগুলো নিয়েই এগিয়ে যেতে হচ্ছে বিশ্বকে। আমাদের আগামী প্রজন্মের জন্য ভবিষ্যৎ পৃথিবীকে বাসযোগ্য করতে হলে জনসংখ্যাকে পৃথিবীর ধারণক্ষমতার মধ্যে সীমিত রাখা অতি জরুরি। ঢাকার বাইরে জেলা ও উপজেলা শহর এবং বাজারকেন্দ্রিক মফস্বল শহর রয়েছে। নগরে বসবাসের সুযোগ তৈরি, অর্থায়ন, নগর দারিদ্র্য, দরিদ্র জনগোষ্ঠীর সংখ্যা নিয়ন্ত্রণ এবং মানুষের কর্মসংস্থান এসব বিষয় নগরায়ণের শর্ত। বাংলাদেশে আগামী ৭ বছরের মধ্যে মোট জনসংখ্যার ৪৫ শতাংশের বেশি শহরে বসবাস করবে। ওই সময়ের মধ্যে দেশের জনসংখ্যা হবে ১৮ কোটি ৪০ লাখ। সেই হিসেবে ২০৩০ সালের মধ্যে ৮ কোটি ৩৯ লাখের বেশি মানুষ শহরে বসবাস করবে। বিশ্বব্যাংকের ‘বিশ্ব উন্নয়ন সূচক’ সংক্রান্ত বার্ষিক প্রতিবেদনের (২০২৩ সালের) তথ্য-উপাত্ত তুলে ধরে ‘বাংলাদেশের জনসংখ্যা : অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যৎ’ শীর্ষক একটি গবেষণা প্রতিবেদনে এসব তথ্য তুলে ধরা হয়েছে। গবেষণায় বলা হয়েছে, দেশে দ্রুত নগরায়ণ হলেও বিপুল মানুষকে ধারণ করার জন্য নগরগুলো মোটেই প্রস্তুত নয়। আবাসন, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, যোগাযোগসহ নানা পরিষেবায় নগরগুলো বেশ পিছিয়ে। এ অবস্থায় ভবিষ্যতের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা কঠিন হয়ে পড়বে।
বিশ্বের জনসংখ্যা প্রায় ৮০০ কোটি। এই সংখ্যা ২০৩০ সালের মধ্যে ১০০০ কোটি ছাড়িয়ে যাবে। অথচ অর্ধশতাব্দীকাল আগেও বিশ্বের জনসংখ্যা ছিল মাত্র ২৫০ কোটি। জাতিসংঘ জনসংখ্যা তহবিলের (ইউএনএফপি) প্রকাশিত এক পরিসংখ্যান থেকে জানা যায়, ১৮০৪ সালে বিশ্বের জনসংখ্যা ছিল ১০০ কোটি। এই সংখ্যা দ্বিগুণ হতে সময় লেগেছিল ১২৩ বছর। অর্থাৎ ১৯২৭ সালে বিশ্বের জনসংখ্যা দাঁড়ায় ২০০ কোটিতে। এক পরিসংখ্যান থেকে জানা যায়, ১৬৫৩ সালে বাংলাদেশের জনসংখ্যা ছিল ১ কোটি। ১৮৬০ সালে ২ কোটিতে বৃদ্ধি পায়।
জনসংখ্যা বিস্ফোরণ বলতে একটি এলাকায় মানুষের সংখ্যা দ্রুত বৃদ্ধিকে বোঝায়। এটি এমন একটি পরিস্থিতি যেখানে দেশের অর্থনীতি দ্রুত জনসংখ্যা বৃদ্ধির সঙ্গে মানিয়ে নিতে পারে না। সহজ কথায় এটি এমন একটি পরিস্থিতি যেখানে অর্থনীতি তার জনগণকে যথাযথ সুবিধা দিতে পারে না। জনসংখ্যা বৃদ্ধি এমন দেশগুলোতে ঘটে যা মানুষের ক্রমবর্ধমান সংখ্যাকে পরিচালনা করার জন্য অপ্রস্তুত। ১৯৭৪ সালে নগরে বাস করা মানুষের হার ছিল মোট জনসংখ্যার মাত্র ৯ শতাংশ। নগরায়ণের সবচেয়ে বড় চাপ ঢাকার ওপরে। ঢাকা এখন জনসংখ্যার বিচারে বিশ্বের নবম বৃহত্তম নগর। জাতিসংঘের জনসংখ্যা বিভাগের সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, ২০৩০ সালের মধ্যে ঢাকার অবস্থান হবে তৃতীয়। প্রজননযোগ্য বয়সের মানুষের সংখ্যা বৃদ্ধি।
বৃহত্তর চিকিৎসা মনোযোগসহ রোগ নিয়ন্ত্রণ এবং উন্নত জনস্বাস্থ্য পরিচর্যা। জনসংখ্যা বিস্ফোরণ নিয়ন্ত্রণের পদক্ষেপ গ্রহণ করা খুবই জরুরি। মানুষকে ছোট পরিবারের সুবিধা সম্পর্কে শিক্ষিত করা উচিত। পুরুষ ও মহিলাদের বিবাহযোগ্য বয়স সংবিধিবদ্ধভাবে বৃদ্ধি জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণের একটি কার্যকর উপায় হতে পারে। প্রজনন বয়সের দম্পতিরা জন্মনিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা গ্রহণের মাধ্যমে পরিবার পরিকল্পনায় উদ্বুদ্ধ করেও জনসংখ্যা বৃদ্ধি নিয়ন্ত্রণ করা যায়। গ্রামীণ সমাজজীবনে অনেকেই নিরাপত্তাহীনতায় ত্যক্ত-বিরক্ত হয়ে শহরে চলে আসছেন, বাসা ভাড়া করে পরিবার-পরিজন নিয়ে উঠছেন। আবার সন্তানদের উচ্চতর শিক্ষার ব্যাপারটিকে গুরুত্বপূর্ণ মনে করে কেউ কেউ শহরমুখী হচ্ছেন। অতিরিক্ত জনসংখ্যার চাপ সামলাতে গিয়ে রাজধানী ঢাকা বেসামাল একটি নগরীতে পরিণত হয়েছে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, হাসপাতাল ইত্যাদি গড়ে উঠেছে রাজধানী ঢাকাকে কেন্দ্র করে।
ফলে তৈরি হয়েছে অসংখ্য কর্মসংস্থানের। জীবিকা ও প্রয়োজনের তাগিদে এবং শহুরে জীবনের টানে মানুষ রাজধানীমুখী হতে বাধ্য হচ্ছে। রাজধানীর ওপর থেকে ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যার চাপ কমাতে হলে রাজধানীকে সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনামাফিক গড়ে তুলতে হবে। গ্রামাঞ্চল এবং ছোট শহরগুলোতে প্রয়োজনীয় বিদ্যুৎ-গ্যাসের সরবরাহ নিশ্চিত করে ক্ষুদ্র ও মাঝারি ধরনের শিল্পের বিস্তার ঘটিয়ে ব্যাপক কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি করতে পারলে রাজধানীর ওপর অতিরিক্ত জনংসখ্যার চাপ স্বাভাবিকভাবে কমে আসবে।
সাবেক রেজিস্ট্রার, বিএসএফএমএসটিইউ
সময়ের আলো/আরএস/