বরিশাল ব্যুরো
পরিবেশ অধিদফতরের বরিশাল বিভাগীয় গবেষণাগারে পানি পরীক্ষার সব যন্ত্রপাতি দীর্ঘদিন ধরে অকেজো পড়ে থাকায় বরিশালে পানির ব্যাকটেরিয়া পরীক্ষা দীর্ঘদিন থেকে বন্ধ রয়েছে।
বরিশাল সিটি কপোরেশনের স্বাস্থ্য বিভাগের দাবি, এমন অবস্থা জনস্বাস্থ্যের জন্য মারাত্মক ঝুঁকিপূর্ণ। শিগগির এ অবস্থার পরিবর্তন ঘটবে এ রকম কোনো আভাসও মিলছে না। প্রায় তিন বছর ধরে বরিশাল পরিবেশ অধিদফতরের পানি পরীক্ষার যন্ত্র মাল্টি মিটার, অটোক্লেভ ও ইনকিউবিটার্সসহ সব যন্ত্র অচল হয়ে পড়ে আছে। এ কারণে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা যাচ্ছে না খাবার পানির জীবাণু।
পরিবেশ অধিদফতরের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, বর্তমান পরিস্থিতিতে পানি পরীক্ষার সব কার্যক্রম বন্ধ রয়েছে। ইতিপূর্বে যখন পানি পরীক্ষা করা হতো তখন প্রায়ই নগরী এবং উপজেলা পর্যায়েও হোটেল-রেস্তোরাঁর খাবার পানিতে পাওয়া যেত অতিমাত্রায় ব্যাকটেরিয়া। কিন্তু পানি পরীক্ষার সব যন্ত্র নষ্ট থাকায় সরবরাহকৃত পানির ক্ষতিকর দিক আর জানা যাচ্ছে না।
এ বিষয়ে বরিশাল পরিবেশ অধিদফতরের পরিচালক মুহাম্মদ মুজাহিদুল ইসলাম বলেন, ইতিমধ্যে নতুন ভবনে গবেষণাগারের জন্য আমরা স্থান নির্ধারণ করেছি। প্রকল্প থেকে যন্ত্রপাতি আসার পর আমরা তা স্থাপন করে খাবার পানির দূষণ নির্ণয়ের কাজ শুরু করব। ইতিমধ্যে বিষয়টি আমরা ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে জানিয়েছি।
বরিশাল পরিবেশ অধিদফতরের সিনিয়র কেমিস্ট গোলাম কিবরিয়া বলেন, আমাদের ল্যাবরেটরিতে সব ধরনের পানির মান পরীক্ষা করা হতো। বর্তমানে পানি পরীক্ষার যন্ত্রপাতিগুলো অচল অবস্থায় থাকায় এখানে গবেষণা কাজ বন্ধ আছে। নতুন প্রকল্পের আওতায় আমরা নতুন যন্ত্রপাতির চাহিদাপত্র প্রেরণ করেছি। সেগুলো এলে আমরা কাজ শুরু করতে পারব। আগে প্রতি সপ্তাহে বরিশাল মহানগরীসহ বিভাগীয় পর্যায়ে হোটেল-রেস্তোরাঁ, নলকূপ, পুকুর ও গৃহস্থালি থেকে পানির নমুনা সংগ্রহ করে গুণগত মানের অবস্থা সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে জানিয়ে দেওয়া হতো পরবর্তী ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য। তিনি আরও বলেন, বরিশাল সিটি করপোরেশন থেকে বলা হয়েছে, দীর্ঘদিন ধরে পানির প্রতিবেদন তারা পাচ্ছে না। কিছু নমুনা সংগ্রহ করে তারা পরীক্ষার জন্য ঢাকায় পাঠিয়েছে।
এদিকে পানির বিষয়ে কিছু না জানার কারণে ব্যবস্থা নিতে না পারায় নগরীতে পানিবাহিত রোগের প্রাদুর্ভাব বেড়ে গেছে। এ অবস্থায় সংকটে রয়েছে জনস্বাস্থ্য। এ বিষয়ে বরিশাল সিটি কপোরেশনের স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ডা. খন্দকার মঞ্জুরুল ইসলাম বলেন, আমরা নিয়মিত পানি পরীক্ষার রিপোর্ট না পেয়ে নিজেরাই নমুনা সংগ্রহ করে পরীক্ষার জন্য ঢাকায় পাঠাচ্ছি। কিন্তু ঢাকা থেকে পানি পরীক্ষার রিপোর্ট হাতে পাওয়া অনেক সময়সাপেক্ষ ব্যাপার। আমরা আসলে এক প্রতিষ্ঠান অন্য প্রতিষ্ঠানের ওপর নির্ভরশীল। ইতিমধ্যে নগরীর বস্তি এলাকায় চুলকানিসহ পানিবাহিত বিভিন্ন রোগের মাত্রা বেড়ে গেছে। পানি দূষণের কারণে রোগ ছড়াচ্ছে। এ অবস্থায় পানি পরীক্ষার কার্যক্রম দ্রুত শুরু করতে আমরা প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করব।
খাবার পানি ব্যবহারের বিষয়ে সংশ্লিষ্টরা বলছেন, পানি পানের নামে সবাই কী পান করছেন তা কেউই জানেন না। তারা এ ব্যাপারে সরাসরি দায়ী করেছেন পরিবেশ অধিদফতরকে। স্থানীয়রা বলছেন, গত এক দশকেও বাসাবাড়ি থেকে পানির নমুনা সংগ্রহ করা হয়নি। তাদের মতে, বরিশালের মানুষের জন্য এটি সবচেয়ে বড় দুঃসংবাদ। তারা এ ব্যাপারে সরকারের সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের হস্তক্ষেপ কামনা করেছেন।
নগরীর বগুড়া রোড এলাকার বাসিন্দা মো. জামাল বলেন, আমরা নিয়মিত হোটেলে খাবার খাই। এ সময় যে পানি দেওয়া হয় তা চোখে দেখছি স্বচ্ছ। কিন্তু এ পানি পান করে প্রায়ই অসুস্থ হয়ে পড়ি। পরিবেশ অধিদফতর এ পানি পরীক্ষা করলে আমাদের জন্য ভালো হতো। সদর রোডের বাসিন্দা রিয়াজ শরিফ বলেন, হোটেলে খাই নিয়মিত। পানি কেমন তা জানি না। মাঝেমধ্যে পেটের পীড়া হয়। এই পানির কারণেই এটি হচ্ছে।
হোটেল ব্যাবসায়ী রেজাউল বলেন, আমরা তো খদ্দেরদের পরিষ্কার পানিই দিয়ে থাকি। কিন্তু এ পানির মধ্যে কী আছে তা তো আমরা জানি না। আগে পরিবেশ অধিদফতর থেকে এসে পানির নমুনা সংগ্রহ করে নিয়ে যেত। খারাপ পানি হলে জরিমানাও করত। এখন তারা আর আসে না। শুনেছি তাদের মেশিন নষ্ট।
বরিশাল মহানগরীতে ছোট-বড় তিন হাজার খাবার দোকানে লক্ষাধিক মানুষ প্রতিদিন খানাপিনা করে থাকেন। এই শহরে প্রায় সাড়ে চার লাখ অধিবাসী। তারা সবাই স্বাস্থ্যঝুঁকির মুখে রয়েছেন। পানির মান নির্ণয় বন্ধ থাকায় শঙ্কিত নগরবাসী। যদিও অফিস পরিবর্তনের দোহাই দিয়ে পরিবেশ অধিদফতর থেকে জানানো হয়েছে, নতুন যন্ত্রপাতি এলে আবার গবেষণা শুরু হবে। কিন্তু তা কবে নাগাদ শুরু হবে তার কোনো উত্তর কারও কাছে নেই।