
আজকের দিনে পারমাণবিক যুদ্ধের ক্রমবর্ধমান ঝুঁকির কারণে সহজেই আতঙ্কিত হওয়া স্বাভাবিক। রাশিয়া নিয়মিত পারমাণবিক হুমকি দিচ্ছে। আমেরিকা একটি বৃহৎ পরিসরের পারমাণবিক আধুনিকীকরণ প্রোগ্রাম হাতে নিয়েছে। চীন তাদের পারমাণবিক অস্ত্রভান্ডার বৃদ্ধি করছে। পারমাণবিক অস্ত্রধারী দেশগুলোর মধ্যে উত্তেজনা ক্রমাগত বাড়ছে। কিন্তু পারমাণবিক অস্ত্র মানব জীবনের অবশ্যম্ভাবী বাস্তবতা নয়। এগুলো দূর করা অসম্ভব নয় এবং এই লক্ষ্যে সাধারণ মানুষ, আপনি আর আমি, কাজ করতে পারি।
গণবিধ্বংসী অস্ত্র সমস্যার সমাধানের নজির রয়েছে। একসময় যুক্তরাষ্ট্র এবং সোভিয়েত ইউনিয়ন (পরবর্তী সময়ে রাশিয়া) একত্রে ৭০,০০০ টনেরও বেশি রাসায়নিক অস্ত্র মজুদ করেছিল। কিন্তু ২০২৩ সালের ৭ জুলাই যুক্তরাষ্ট্র ঘোষণা করে যে, ১৯৯৭ সালের রাসায়নিক অস্ত্র কনভেনশনের অধীনে তারা তাদের রাসায়নিক অস্ত্র মজুদের শেষ অংশটি ধ্বংস করেছে। রাশিয়া কয়েক বছর আগেই একই কাজ সম্পন্ন করেছে।
যখন কোনো দেশ এ ধরনের চুক্তি লঙ্ঘন করে, যেমন ২০১৮ সালে সিরিয়া চুক্তির সদস্য হওয়া সত্ত্বেও রাসায়নিক অস্ত্র ব্যবহার করেছিল, তারা খুব কম লাভবান হয়, বরং দ্রুত আন্তর্জাতিক নিন্দার সম্মুখীন হয়। গণবিধ্বংসী অস্ত্র ব্যবহারের ফলে সিরিয়ার কৌশলগত অবস্থান হঠাৎ করে উন্নত হয়নি। বিশ্ব রাসায়নিক এবং জৈব অস্ত্রকে অত্যন্ত বিপজ্জনক হিসেবে দেখে, তবে ক্ষমতার উৎস হিসেবে নয়।
পারমাণবিক অস্ত্রও তাদের এই ক্ষমতা হারাতে পারে। প্রচলিত ধারণার বিপরীতে, পারমাণবিক অস্ত্রযুদ্ধের জন্য অত্যন্ত অকার্যকর সরঞ্জাম। এগুলো বিশ্রী, ব্যয়বহুল এবং সামরিক দিক থেকে খুব একটা কার্যকর নয়। এদের ব্যবহারের ফলে ভয়াবহ ধ্বংসযজ্ঞ হবে, লক্ষাধিক নিরপরাধ বেসামরিক মানুষের মৃত্যু ঘটবে এবং প্রজন্ম থেকে প্রজন্ম পর্যন্ত সীমানা অতিক্রম করে তেজস্ক্রিয় দূষণ ছড়িয়ে পড়বে। এমন একটি পরিস্থিতি কল্পনা করা কঠিন যেখানে একটি দেশ পারমাণবিক অস্ত্রের পরিবর্তে প্রচলিত অস্ত্র ব্যবহার না করে লাভবান হবে, কারণ পারমাণবিক অস্ত্র ব্যবহারের ফলে সেই দেশ এবং তার মিত্রদের জন্য বিশাল ক্ষতির সম্ভাবনা রয়েছে। এমনকি পারমাণবিক অস্ত্রধারী দেশগুলোও প্রকাশ্যে স্বীকার করে যে, এই অস্ত্রগুলো কখনোই ব্যবহার করা উচিত নয়।
প্রচলিত অস্ত্রের বিপরীতে, পারমাণবিক অস্ত্রের মূলত ধারণাগত উপকারিতা হলো-অন্যদের ভয় দেখানো এবং প্রতিরোধ সৃষ্টি করা। এই অস্ত্রগুলোর ক্ষমতা তাদের কার্যকর ব্যবহারে নয়, বরং রাষ্ট্র এবং তাদের প্রতিপক্ষের দৃষ্টিভঙ্গিতে নিহিত। এই ধারণাটি, যা পারমাণবিক প্রতিরোধ হিসেবে পরিচিত, তখনই কাজ করে, যখন আপনার প্রতিপক্ষ তা কার্যকর বলে মেনে নেয়; এটি একটি অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ নিরাপত্তা কৌশল।
এই ঝুঁকিই আমাদের পরিবর্তনের সবচেয়ে বড় সুযোগ। যেহেতু অন্য কোনো অস্ত্র এতটা জনমতের ওপর নির্ভরশীল নয়, সাধারণ মানুষের হাতে এই অস্ত্রগুলোর ভবিষ্যতের ওপর একটি বিশেষ ক্ষমতা রয়েছে। রাশিয়া যখন পারমাণবিক অস্ত্র ব্যবহারের হুমকি দেয়, তখন ইউক্রেনীয় জনগণের সেই হুমকিকে উপেক্ষা করার দৃঢ়তা একটি উদাহরণ যে, কীভাবে সাধারণ মানুষ পারমাণবিক হুমকির ধারণা পরিবর্তন করতে পারে এবং একটি দেশের পারমাণবিক অস্ত্রভান্ডারের প্রভাব কমাতে পারে। হুমকি উপেক্ষা করলে তারা তাদের কার্যকারিতা হারায়।
পরমাণু অস্ত্রবিরোধী আন্দোলন পারমাণবিক অস্ত্রের বিস্তার রোধ এবং পারমাণবিক যুদ্ধ প্রতিরোধে অনেক সাফল্য অর্জন করেছে। ছাত্রসংগঠন, শ্রমিক ইউনিয়ন, পেশাজীবী সংগঠন, বিজ্ঞানী, শিল্পী এবং স্থানীয় সরকারগুলো পারমাণবিক অস্ত্রব্যবস্থার বিরুদ্ধে লড়াইয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। এমন গণআন্দোলনের মাধ্যমে সৃষ্ট রাজনৈতিক চাপ এবং দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তনের ফলে বিশ্বের বেশিরভাগ দেশ পারমাণবিক অস্ত্রমুক্ত অঞ্চল এবং জাতিসংঘের পারমাণবিক অস্ত্র নিষিদ্ধকরণ চুক্তিতে সই করেছে। যুক্তরাষ্ট্র এবং রাশিয়া ১৯৮৫ সালের পর থেকে তাদের পারমাণবিক অস্ত্রের মজুদ ৮০ শতাংশেরও বেশি কমিয়েছে। উত্তর কোরিয়ার ব্যতিক্রম ছাড়া পারমাণবিক অস্ত্র পরীক্ষা বন্ধ রয়েছে। ১৯৪৫ সালের পর থেকে কোনো দেশ যুদ্ধক্ষেত্রে পারমাণবিক অস্ত্র ব্যবহার করেনি। পারমাণবিক অস্ত্রধারী রাষ্ট্রের সংখ্যা এখনও সীমিত, ১৯৩টি জাতিসংঘ সদস্য রাষ্ট্রের মধ্যে মাত্র ৯টি। পারমাণবিক অস্ত্র না থাকা এখন নিয়মিত বিষয়, ব্যতিক্রম নয়।
আমেরিকার পারমাণবিক কার্যক্রমবিরোধী আন্দোলনের গুরুত্বপূর্ণ মুহূর্তগুলোর কথা বিবেচনা করা যাক। আশি দশকে যুক্তরাষ্ট্রের ২৫টি বৃহত্তম শ্রমিক ইউনিয়ন পারমাণবিক অস্ত্র প্রতিযোগিতা থামানোর এবং তা উল্টে দেওয়ার জন্য নিউক্লিয়ার ফ্রিজ আন্দোলনকে সমর্থন করেছিল। ইন্টারন্যাশনাল ফিজিশিয়ানস ফর দ্য প্রিভেনশন অব নিউক্লিয়ার ওয়ারের মতো পেশাজীবী সংগঠনগুলো চিকিৎসা পেশাজীবীদের একত্রিত করেছিল। ব্রুস স্প্রিংস্টিনসহ শিল্পীরা ১৯৭৯ সালে ম্যাডিসন স্কয়ার গার্ডেনে ‘নো নিউকস’ কনসার্টের মতো সাংস্কৃতিক আয়োজন তৈরি করেছিলেন। দ্য ডে আফটারের মতো প্রভাবশালী চলচ্চিত্র নির্মাতারা জনসাধারণের দৃষ্টিভঙ্গি বদলে দিয়েছিলেন এবং এমনকি রাজনৈতিক নেতাদের, যেমন-রোনাল্ড রিগানকে প্রভাবিত করেছিলেন। স্থানীয় পর্যায়ের অংশগ্রহণ ছিল বিশেষভাবে শক্তিশালী, ১৯৮২ সালে কয়েকটি রাজ্য, শত শত সিটি গভর্নমেন্ট এবং নিউ ইংল্যান্ডের ৪০০-এর বেশি টাউন হলে ফ্রিজ রেজ্যুলিউশন পাস করেছিল।
আজ আমরা নতুন উদ্যোগের সম্ভাবনা দেখতে পাচ্ছি, যার নেতৃত্বে রয়েছে ইন্টারন্যাশনাল ক্যাম্পেইন টু অ্যাবলিশ নিউক্লিয়ার ওয়েপন্স, একটি সংগঠন যা আমি ২০১৪ থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত পরিচালনা করেছি এবং যা ২০১৭ সালের নোবেল শান্তি পুরস্কার পেয়েছে। ‘ওপেনহাইমার’ এবং আসন্ন ‘লাস্ট ট্রেন ফ্রম হিরোশিমা’-এর মতো চলচ্চিত্র পারমাণবিক অস্ত্রের হুমকিকে আবার জনসচেতনতার কেন্দ্রে নিয়ে আসছে।
তা হলে ব্যক্তি কীভাবে অবদান রাখতে পারে? প্রথমত, নিজের ক্ষমতা স্বীকৃতি দিন। একটি গুরুত্বপূর্ণ উপায় হলো-পারমাণবিক অস্ত্র নিয়ে আলোচনার ধরন পরিবর্তন করা। এগুলোকে জাদুকরী সরঞ্জাম হিসেবে ভাবার পরিবর্তে এগুলোকে অযৌক্তিক এবং বাস্তব সামরিক পরিস্থিতির জন্য অপ্রয়োজনীয় হিসেবে বিবেচনা করা উচিত। কৌশলগত স্থিতিশীলতা এবং পারস্পরিক ধ্বংসের মতো বিমূর্ত তত্ত্ব নিয়ে আলোচনা করার বদলে, আলোচনাকে এগুলোর ব্যবহারের ফলাফল এবং বৈজ্ঞানিক প্রমাণের ওপর কেন্দ্রীভূত করা উচিত। আমরা সবাই এই সাধারণ ধারণাগুলো প্রশ্ন করতে পারি যে, এসব অস্ত্র আমাদের নিরাপদ রাখার জন্য তৈরি এবং বৈশ্বিক গণআত্মহত্যার হুমকির ওপর ভিত্তি করে জাতীয় নিরাপত্তা কৌশলগুলোর অযৌক্তিকতাকে উন্মোচিত করতে পারি। যদি আপনি একজন ছাত্র হন, তা হলে ক্যাম্পাসে আলোচনার আয়োজন করুন। যদি আপনি একজন পেশাজীবী হন, তা হলে আপনার নেটওয়ার্কের মাধ্যমে সক্রিয় হন। যদি আপনি একজন শিল্পী হন, তা হলে এই বিষয়গুলো নিয়ে কাজ করতে আপনার দক্ষতাকে ব্যবহার করুন।
আপনার নির্বাচিত প্রতিনিধিদের সঙ্গে যোগাযোগ করুন, তবে শহরের কাউন্সিল, রাজ্যের প্রতিনিধিরা এবং কমিউনিটি গ্রুপগুলোর সঙ্গে যুক্ত হওয়াও ভুলবেন না। শহর এবং স্থানীয় কর্তৃপক্ষ এখন রাজনীতি এবং কূটনীতিতে আরও সক্রিয় হয়ে উঠছে। আপনার শহর বা রাজ্যকে যুক্ত করা, যেসব স্থানীয় কর্তৃপক্ষ এই বিষয়ে উদ্যোগ নিচ্ছে, সেই সংখ্যা বাড়ানোর মাধ্যমে এমন এক নতুন প্রজন্মের রাজনৈতিক নেতা তৈরি করতে সাহায্য করতে পারে যারা এই বিষয়টি সামনে নিয়ে আসবে। অবশেষে, মনে রাখবেন যে শুধু সরকারই পরিবর্তন আনতে হবে তা নয়। আমাদের পেনশন ফান্ড, বিশ্ববিদ্যালয় এবং আর্থিক প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে আমরা করপোরেট আচরণে প্রভাব ফেলার চেষ্টা করতে পারি, যেমন-পারমাণবিক অস্ত্র তৈরিতে জড়িত কোম্পানিগুলো থেকে বিনিয়োগ প্রত্যাহার করা। বোয়িং, লকহিড মার্টিন, নর্থরপ গ্রুম্যান এবং অন্যান্য সামরিক ঠিকাদার কোম্পানির ওপর চাপ প্রয়োগ করে, যারা পারমাণবিক অস্ত্র প্রযুক্তি তৈরি করে, আমরা গণবিধ্বংসী অস্ত্র উৎপাদনকে করপোরেট খ্যাতির জন্য ব্যয়সাপেক্ষ করে তুলতে পারি।
বিনিয়োগ প্রত্যাহার ক্যাম্পেইন অন্যান্য ক্ষেত্রে যেমন তামাক এবং জীবাশ্ম জ্বালানির ক্ষেত্রে সচেতনতা বাড়াতে কার্যকর প্রমাণিত হয়েছে এবং এটি পারমাণবিক অস্ত্র উৎপাদনকে অগ্রহণযোগ্য প্রমাণ করতে একইভাবে সহায়ক হতে পারে।
যুদ্ধের ঝুঁকি বেড়ে চলেছে এবং বৈশ্বিক উত্তেজনার বৃদ্ধি অজেয় মনে হতে পারে। তবে কীভাবে আমরা অস্ত্রের বিস্তার কমিয়েছি এবং গণবিধ্বংসী অস্ত্র হ্রাস করেছি তার ইতিহাস প্রমাণ করে যে সম্মিলিত উদ্যোগ অসম্ভব পরিস্থিতিকেও বদলে দিতে পারে। ভবিষ্যতের পথ ভয় দিয়ে নয়, বরং নিরবচ্ছিন্ন, সমন্বিত প্রচেষ্টার মাধ্যমে তৈরি হতে পারে। প্রতিটি আলোচনা, প্রতিটি স্থানীয় প্রস্তাবনা এবং প্রতিটি শিল্পকর্ম যা পারমাণবিক অস্ত্রের মিথকে চ্যালেঞ্জ করে, বৃহত্তর আন্দোলনের অংশ হিসেবে কাজ করে।
আমাদের ক্ষমতা রয়েছে পারমাণবিক অস্ত্রকে অতীতের একটি ভুল ধারণার নিদর্শনে পরিণত করার।
সাবেক নির্বাহী পরিচালক,
ক্যাম্পেইন টু অ্যাবোলিশ নিউক্লিয়ার উইপনস
সময়ের আলো/আরএস/