ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে গত ৫ আগস্ট বাংলাদেশের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তার পদ থেকে ইস্তফা দিয়ে ভারতে আশ্রয় নেন। এরপর থেকেই শুরু হয় বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্কে টানাপড়েন।
সবশেষ শেখ হাসিনাকে ফেরত চেয়ে ভারতকে কূটনৈতিক পত্র দিয়েছে বাংলাদেশ। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, যে এই ফেরত চাওয়ার ঘটনা নিয়ে সম্পর্কের টানাপড়েন আরও বাড়তে পারে।
চলতি বছরের শুরু থেকে আগস্ট পর্যন্ত বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ক আগের এক যুগেরও বেশি সময়ের মতো উষ্ণ ছিল। যাকে দুই দেশের সরকার সোনালি অধ্যায় বলে অভিহিত করত। মূলত গত এক যুগেরও বেশি সময় বাংলাদেশ-ভারত দুই দেশের জনগণের মধ্যে সত্যিকারের সম্পর্ক ছিল না, সম্পর্ক ছিল দুই দেশের সরকারের মধ্যে। ভারত তাদের উত্তর-পূর্ব অঞ্চলের নিরাপত্তা ও উন্নয়ন নিশ্চিতে বাংলাদেশে বিগত এক যুগেরও বেশি সময়ের ক্ষমতাসীন দলের (আওয়ামী লীগ) সঙ্গে সখ্যতা গড়েছিল। অন্যদিকে নিজেদের ক্ষমতা টিকিয়ে রাখতে ওই সময়ে বাংলাদেশের ক্ষমতাসীন দল বা সরকার (আওয়ামী লীগ) ভারতের সঙ্গে সুসম্পর্ক বজায় গড়েছিল। যে কারণে বাংলাদেশ তিস্তা নদীর পানি বণ্টন চুক্তি করতে পারেনি।
ভারত নির্বিচারে সীমান্তে হত্যাকাণ্ড ঘটালেও এক যুগেরও বেশি সময় বাংলাদেশ সরকার চুপ থেকেছিল। কমবেশি ৪০ বছর সময় শেষে দুই দেশের স্থল সীমানা চুক্তির বাস্তবায়ন ঘটে। যা ছিল বাংলাদেশের ন্যায্য পাওনা। অথচ ভারত এই বিষয়টিকে সর্বত্র ফুলিয়ে-ফাঁপিয়ে এমনভাবে উপস্থাপন করেছে, যেন তারা বাংলাদেশকে বাড়তি কোনো সুবিধা দিয়েছে। আর এই বিষয়ে হাসিনা সরকারও ‘মিউ মিউ’ সুরে ভারতকে সমর্থন করেছে। এ ছাড়াও হাসিনা সরকার নিজ দেশের স্বার্থ জলাঞ্জলি দিয়ে ভারতকে অবৈধ ট্রানজিট সুবিধাসহ নানা সুযোগ-সুবিধার দুয়ার খোলা রেখেছিল। হাসিনা সরকার শুধু ভারতের বেলাতেই নয় বাংলাদেশের সব ক্ষেত্রেই নিজেদের ব্যক্তিগত স্বার্থ রক্ষায় মশগুল ছিল। এসব অন্যায় আর অনিয়মের প্রতিক্রিয়ায় গত জুলাই-আগস্টে বাংলাদেশের ছাত্র-জনতা হাসিনা সরকারের বিরুদ্ধে অভ্যুত্থান ঘটায়।
কূটনৈতিক সূত্রগুলো বলছে, দুই দেশের মধ্যে যখন সম্পর্কের অবনতি ঘটছে তখন গত ২৮ নভেম্বর কলকাতায় বাংলাদেশ মিশনের সামনে বঙ্গীয় হিন্দু জাগরণ নামে একটি উগ্রবাদী সংগঠন বিক্ষোভ সমাবেশ করে। সমাবেশের ব্যারিকেড ভেঙে মিশনে হামলার চেষ্টা চালায় ও বাংলাদেশের জাতীয় পতাকা পোড়ায়। বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টার কুশপুতুল পুড়িয়ে দেওয়া হয়।
গত ২ ডিসেম্বর আগরতলার বাংলাদেশ মিশনের সামনে প্রতিবাদ সমাবেশ ডাকে উগ্রবাদী সংগঠন হিন্দু সংঘর্ষ সমিতি। সংগঠনের সদস্যরা ব্যারিকেড ভেঙে মিশনে হামলা চালায় এবং বাংলাদেশের জাতীয় পতাকা অবমাননা করে। ঘটনার প্রেক্ষিতে ভারত সরকার দুঃখ প্রকাশ করে। বাংলাদেশ সরকার এ ঘটনার কড়া প্রতিবাদ জানিয়ে যথাযথ তদন্ত দাবি করে। এ ছাড়া চলমান ঘটনার প্রেক্ষিতে ঢাকাস্থ ভারতীয় হাইকমিশনে নিরাপত্তা জোরদার করা হয়। এদিকে আগরতলায় বাংলাদেশ সহকারী হাইকমিশনে প্রবেশ ও ভাঙচুরের অভিযোগে ৭ ব্যক্তিকে গত মঙ্গলবার গ্রেফতার করা হয়েছে বলে পশ্চিম ত্রিপুরা জেলার পুলিশপ্রধান (সুপারিনটেনডেন্ট) কে কিরণ কুমার সাংবাদিকদের জানিয়েছেন।
এ ছাড়া চার পুলিশ সদস্যের বিরুদ্ধে প্রশাসনিক ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। এই চার পুলিশ সদস্যের মধ্যে তিনজন উপ-পরিদর্শক পদমর্যাদার কর্মকর্তা। তাদের সাময়িকভাবে বরখাস্ত করা হয়েছে। আর ডেপুটি সুপারিনটেনডেন্ট পদমর্যাদার এক কর্মকর্তাকে কাজ থেকে বিরত করা হয়েছে। তাকে সদর দফতরে হাজিরা দিতে বলা হয়েছে।
এর আগে গত ৫ আগস্টের পর থেকে ভারতীয় মিডিয়া সংখ্যালঘু ইস্যুতে বাংলাদেশের বিরুদ্ধে অপপ্রচার এবং ভুল তথ্য ছড়িয়েই যাচ্ছে। বাংলাদেশে সংখ্যালঘুদের ওপর নির্যাতন বন্ধ এবং চিন্ময় কৃষ্ণ দাশকে মুক্তি না দিলে সাময়িকভাবে পেট্রাপোল স্থলবন্দর বন্ধ করে দেওয়ার হুমকি দেন পশ্চিমবঙ্গের বিজেপি নেতা শুভেন্দু অধিকারী। এতেও কাজ না হলে নতুন বছর থেকে স্থলবন্দর পুরোপুরি বন্ধ করে ভারত থেকে আলু ও পেঁয়াজ বাংলাদেশে আসা বন্ধ করে দেওয়ার হুমকি দিয়েছেন তিনি। এমন পরিস্থিতিতে বাংলাদেশের জনতার মধ্যে ভারতের বিরুদ্ধে বিরূপ প্রতিক্রিয়া প্রকাশ করতে দেখা গেছে। ঢাকার রাজনীতিবিদ থেকে শুরু করে সব স্তরের জনতাই প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করছে। এমন পরিস্থিতিতে দুই পক্ষের সম্পর্ক স্বাভাবিক করতে চলতি ডিসেম্বরে ভারতের পররাষ্ট্র সচিব ঢাকায় এসে বাংলাদেশের পররাষ্ট্র সচিবের সঙ্গে ফরেন অফিস কনসালটেশন বৈঠক করেন। সবশেষ গত সোমবার বাংলাদেশ আনুষ্ঠানিকভাবে কূটনৈতিক পত্রের মাধ্যমে শেখ হাসিনাকে ভারতের কাছ থেকে ফেরত চায়। এই প্রতিবেদন লেখা পর্যন্ত ভারত হাসিনাকে ফেরত সংক্রান্ত পত্রের কোনো জবাব দেয়নি।
সাবেক রাষ্ট্রদূত মো. মাহফুজুর রহমান সময়ের আলোকে বলেন, আগস্টের পর থেকে দুই পক্ষের সম্পর্কে টানাপড়েন চলছিল। সবশেষ শেখ হাসিনাকে ফেরত চাওয়া সংক্রান্ত কূটনৈতিক পত্রের জেরে এই টানাপড়েন আরও বাড়তে পারে।
সাবেক রাষ্ট্রদূত মো. শহীদুল হক সময়ের আলোকে বলেন, দুই পক্ষের মধ্যে ভারতই টানাপড়েন জিইয়ে রেখেছে। ভারত যদি পরিপক্ক আচরণ করে তবেই চলমান টানাপড়েন থেকে বেরিয়ে এসে দুই দেশের মধ্যে স্বাভাবিক সম্পর্ক ফিরিয়ে আনা সম্ভব।
সময়ের আলো/আরএস/