প্রশাসনের প্রাণকেন্দ্র সচিবালয়ের সাত নম্বর ভবনে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডে ৬ থেকে ৯ তলা পর্যন্ত চারটি ফ্লোর পুড়ে ছাই হয়ে গেছে। পুড়ে যাওয়া চারটি ফ্লোরে যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয়, শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়, ডাক ও টেলিযোগাযোগ বিভাগ, স্থানীয় সরকার বিভাগ, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় বিভাগ এবং সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগ ছিল।
ফায়ার সার্ভিসের তথ্য অনুযায়ী, বুধবার রাত ২টার কিছু আগে এ ভবনে আগুন লাগে। দীর্ঘ প্রায় ছয় ঘণ্টার চেষ্টায় সকাল ৮টা ৫ মিনিটে আগুন নিয়ন্ত্রণে আসে। আগুন পুরোপুরি নেভাতে সময় লাগে ১০ ঘণ্টা। এ ছাড়া আগুন নেভানোর জন্য সচিবালয়ের গেট দিয়ে ফায়ার সার্ভিসের বড় গাড়ি ঢোকানো যাচ্ছিল না বলে জানানো হয়েছে বাহিনীর পক্ষ থেকে।
সচিবালয়ে অগ্নিকাণ্ডের কারণ ও উৎস খুঁজে বের করতে উচ্চ পর্যায়ের কমিটি গঠন করা হয়েছে। আগুনের ঘটনার তদন্ত করবে সেনাবাহিনীও। ঘটনা তদন্তে মন্ত্রণালয়ের ক্ষয়ক্ষতি নিরূপণে দুটি কমিটি গঠন করেছে শ্রম মন্ত্রণালয়ও। এদিকে অগ্নিনির্বাপনে গিয়ে ট্রাকচাপায় ফায়ার ফাইটার নয়ন নিহত হওয়ার ঘটনায় মামলা করেছে ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স কর্তৃপক্ষ। সচিবালয়ের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা জানান, এ ভবনের পাঁচ তলা পর্যন্ত আগুনে কোনো ক্ষতি হয়নি।
ভবনের ষষ্ঠ তলায় শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয় এবং যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয়। সপ্তম তলায় স্থানীয় সরকার বিভাগ ও পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় বিভাগ। অষ্টম তলায় রয়েছে স্থানীয় সরকার বিভাগের কিছু অংশ এবং ডাক ও টেলিযোগাযোগ বিভাগের কিছু অংশ। নবম তলায় রয়েছে সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগ। এ চারটি তলা পুরো পুড়ে গেছে। প্রতিটি কক্ষের সবকিছু পুড়ে ছাই হয়ে গেছে। কোথাও কোথাও দেয়ালের অংশ খসে পড়েছে। সিঁড়ি ধসে গেছে। ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে পোড়া ধ্বংসস্তূপ। তবে ভেতরের এ অবস্থা বাইরে থেকে বোঝার উপায় নেই। ৭ নম্বর ভবনের চারপাশে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রয়েছে জানালার ভাঙা কাচের গুঁড়া। ভবনের দক্ষিণ পাশে মরে পড়ে আছে কয়েকটি কবুতর। আগুন নেভার পর পুরো ভবনটি ঘিরে রাখে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি ছাড়া কাউকে ভেতরে প্রবেশ করতে দেওয়া হয়নি। পুড়ে যাওয়া অংশ থেকে বিভিন্ন আলামত সংগ্রহ করেন আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা। সচিবালয়ের ভেতরে টহল দিতে দেখা যায় সেনা সদস্যদের।
আগুন নিয়ন্ত্রণে আসার পর সকালে ভবনটি পরিদর্শন করেন স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) মো. জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী। দুপুর সাড়ে ১২টার দিকে আসেন শ্রম ও কর্মসংস্থান এবং নৌপরিবহন উপদেষ্টা ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) এম সাখাওয়াত হোসেন, পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান; স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় এবং যুব ও ক্রীড়া উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়া। ব্রিগেডিয়ার (অব.) সাখাওয়াত হোসেনকে আসিফ মাহমুদ বলেন, আমাদের সব শেষ হয়ে গেছে। ব্রিগেডিয়ার সাখাওয়াত এ সময় আসিফ মাহমুদকে সান্ত্বনা দেন। সব ফাইল পুড়ে গেছে বলে এ সময় জানান শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা।
আগুন নিয়ন্ত্রণে আনতে ফায়ার সার্ভিসের ১৯টি ইউনিটের ২১১ জন ফায়ার ফাইটার কাজ করেন। টানা ১০ ঘণ্টা চেষ্টা চালিয়ে বৃহস্পতিবার বেলা ১১টা ৪৫ মিনিটে সম্পূর্ণরূপে আগুন নেভাতে সক্ষম হয় ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স অধিদফতর। আগুন নেভাতে ফায়ার সার্ভিসের পাশাপাশি সেনাবাহিনী ও নৌবাহিনী সহযোগিতা করে।
সচিবালয়ের বাইরে আবদুল গনি রোড থেকে সরেজমিন দেখা গেছে, ৯ তলাবিশিষ্ট সচিবালয়ের ৭ নম্বর ভবনটি পূর্ব-পশ্চিমে বিস্তৃত। ভবনের একেবারে পশ্চিম পাশে ৮ এবং ৯ তলার কিছু অংশে আগুন লেগেছে। আবার মাঝখানে একইভাবে ৮ ও ৯ তলায় এবং পূর্ব পাশে ৭, ৮ ও ৯ তলার কিছু অংশ আগুনে পুড়েছে। এদিকে ঘটনার পর সচিবালয়ের এক ও দুই নম্বর গেট বন্ধ রাখা হয়েছে। সকাল ৯টার আগেই প্রবেশের জন্য বিপুলসংখ্যক কর্মকর্তা-কর্মচারী সচিবালয়ের গেটগুলোর সামনে অপেক্ষা করতে থাকেন। পরে প্রেস ক্লাবের দিকে ৫ নম্বর গেট দিয়ে সীমিত পরিসরে কর্মকর্তা-কর্মচারীদের প্রবেশ করানো হয়। তবে এর কিছুক্ষণ পর থেকে কর্মকর্তা ও কর্মচারীরা সচিবালয় থেকে বের হতে থাকেন। তাদের কাছে বের হওয়ার কারণ জানতে চাইলে কর্মকর্তারা জানান, ক্ষতিগ্রস্ত ভবনকে ঘিরে রেখেছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী এবং ফায়ার সার্ভিস কর্মীরা কাজ করছেন। তবে সচিবালয়ের সব ভবনে বিদ্যুৎ সংযোগ নেই। এ কারণে সেখানে গিয়ে কাজ করা যাচ্ছে না। তাই বাইরে বের হয়ে এসেছেন তারা।
সচিবালয়ের গেট দিয়ে ফায়ার সার্ভিসের বড় গাড়ি ঢোকানো যাচ্ছিল না : সচিবালয়ের আগুন নেভাতে গিয়ে বিভিন্ন প্রতিবন্ধকতার মুখে পড়তে হয়েছে ফায়ার সার্ভিসকে। ফায়ার সার্ভিসের একাধিক সদস্য জানান, সচিবালয়ের গেট দিয়ে ফায়ার সার্ভিসের বড় গাড়ি ভেতরে প্রবেশ করাতে বেশ বেগ পেতে হয়েছে তাদের। আগুন নেভানোর জন্য ফায়ার সার্ভিসের দুটি টার্নটেবল লেডার (টিটিএল) ভেতরে ঢুকতে পেরেছে। যদি আরও বেশি টিটিএল ঢুকতে পারত, তা হলে আরও আগে আগুন নেভানো সম্ভব হতো।
সচিবালয়ে ঢোকার মোট পাঁচটি গেট থাকলেও ফায়ার সার্ভিসের গাড়ি ঢোকার গেট আছে মাত্র দুটি। এ দুই গেট দিয়েও ফায়ার সার্ভিসের বড় গাড়ি ঢুকতে সমস্যা হয়েছে। কর্মকর্তারা বলেন, সচিবালয়ের ৪ নম্বর গেট দিয়ে ঢুকতে গিয়ে ফায়ার সার্ভিসের একটি গাড়ি ভেঙে গেছে। আগুন নেভানোর কাজ শেষে ফায়ার সার্ভিসের গাড়ি সচিবালয় থেকে বের করতেও বেশ সমস্যা হয়েছে বলেও জানান তারা। গাড়ি বের করতে গিয়ে দেয়ালের কয়েকটি জায়গা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এর আগে বিভিন্ন সময় সচিবালয়ে ঢোকার গেট সম্প্রসারণ করার কথা বলা হলেও তা করা হয়নি বলে একাধিক কর্মকর্তা জানিয়েছেন।
মন্ত্রণালয়গুলো কাঠ ও পার্টিক্যাল বোর্ড দিয়ে সৌন্দর্যবর্ধনের কাজ করেছে। বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের করিডোরগুলোতেও বোর্ড দিয়ে সৌন্দর্যবর্ধন করা হয়েছে। আগুন দ্রুত ছড়িয়ে পড়ার একটি বড় কারণ হলো কাঠ দিয়ে এই সৌন্দর্যবর্ধন কাজ। এটি যখন করা হয়, তখন ফায়ার সার্ভিসের পক্ষ থেকে নিষেধ করা হলেও তা বন্ধ করা হয়নি বলে সংশ্লিষ্টরা অভিযোগ করেন। আগুন নেভানোর কাজে জড়িত ফায়ার সার্ভিসের একাধিক কর্মকর্তা বলেন, অভিযান পরিচালনা করতে তাদের বেশ সমস্যা হয়েছে।
সকাল পৌনে ৭টার দিকে সচিবালয়ের সামনে ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স অধিদফতরের মহাপরিচালক (ডিজি) ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মুহাম্মদ জাহেদ কামাল সাংবাদিকদের বলেন, ‘রাত ১টা ৫২ মিনিটে আমরা মেসেজ পাই সচিবালয়ের ৭ নম্বর ভবনে আগুন লেগেছে। ১টা ৫৪ মিনিটের মধ্যে আমাদের ইউনিট পৌঁছে যায়। এখানে ১৯টি ইউনিট নিয়োজিত করা হয়েছে। তবে ফায়ার সার্ভিসের বড় গাড়িগুলো ঢুকতে না পারায় কাজে বেগ পেতে হয়েছে। সামনের গেট ভেঙে দুটো গাড়ি ঢুকিয়েছি। সকাল ৮টা ৫ মিনিটে আগুন নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আসা হয়। ১০ তলা ওই ভবনের ৬, ৭, ৮, ৯ এই চারটি তলায় আগুন ধরেছে।’
দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা ফারুক ই আজম বলেন, সচিবালয়ের ভেতর কিছু স্থাপনা করা হয়েছে আন্তঃমন্ত্রণালয়ে যাওয়ার জন্য, সিঁড়ির মতো করা হয়েছে। সে জন্য ফায়ার সার্ভিসের গাড়ি ঠিক সময়ে যেতে পারেনি।
সকালে আগুন নিয়ন্ত্রণে আসার পর পুরো ভবনের চারপাশ ঘুরে দেখেন স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) মো. জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী, গৃহায়ন ও গণপূর্ত উপদেষ্টা আদিলুর রহমান খান, সমাজকল্যাণ উপদেষ্টা শারমীন মুরশিদসহ অন্যরা। এ সময় ফায়ার সার্ভিসের গাড়ি ঢোকানোর সমস্যা নিয়ে কথা হয়। তখন গণপূর্ত সচিব হামিদুর রহমান খান বলেন, ৬ নম্বর ভবনের সামনের চলন্ত করিডোর ভেঙে দেওয়া হবে।
উচ্চ পর্যায়ের কমিটি গঠন
সচিবালয়ে অগ্নিকাণ্ডের কারণ ও উৎস খুঁজে বের করতে উচ্চ পর্যায়ের কমিটি গঠন করা হয়েছে। এই কমিটিকে আগামী তিন দিনের মধ্যে প্রাথমিক রিপোর্ট দিতে বলা হয়েছে। রাজধানীর ফরেন সার্ভিস একাডেমিতে এক সংবাদ সম্মেলনে পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান গণমাধ্যমকে বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় এ কথা জানান।
এদিকে সন্ধ্যায় জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় থেকে কমিটি গঠনের বিষয়ে একটি প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়েছে। একই সঙ্গে বৃহস্পতিবার সকালে মন্ত্রিপরিষদ গঠিত কমিটি বাতিল করা হয়েছে বলে প্রজ্ঞাপনে উল্লেখ করা হয়।
বন ও পরিবেশ উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান বলেন, প্রধান উপদেষ্টার সভাপতিত্বে একটি জরুরি বৈঠক হয়েছে। বৈঠকে একটি উচ্চ পর্যায়ের কমিটি গঠনের সিদ্ধান্ত হয়। কমিটিকে আগামী তিন দিনের মধ্যে প্রাথমিক রিপোর্ট দিতে বলা হয়েছে। এই কমিটির সভাপতির দায়িত্ব পালন করবেন স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব। সদস্য হিসেবে থাকবেন-গৃহায়ন ও গণপূর্ত সচিব, পুলিশের আইজিপি, ফায়ার সার্ভিস এবং সিভিল ডিফেন্সের মহাপরিচালক (সদস্য সচিব), সশস্ত্র বাহিনীর একজন বিস্ফোরক বিশেষজ্ঞ এবং বুয়েট থেকে তিনজন বিশেষজ্ঞ, একজন সিভিল ইঞ্জিনিয়ার, একজন কেমিক্যাল ইঞ্জিনিয়ার এবং একজন ইলেট্রনিক ইঞ্জিনিয়ার।
বন ও পরিবেশ উপদেষ্টা আরও জানান, প্রাথমিক প্রতিবেদনের বিষয়টি গণমাধ্যমকে বিস্তারিত জানানো না গেলেও পূর্ণাঙ্গ প্রতিবেদন গণমাধ্যমকে পুরোটাই জানানো হবে। যত দ্রুত সম্ভব এই প্রতিবেদন দেওয়া হবে।
এ সময় সংবাদ সম্মেলনে আরও উপস্থিত ছিলেন স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) মো. জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী, সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় এবং যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়া, প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম।
অগ্নিকাণ্ডের বিষয়ে সরকার কি ধারণা করছে-এমন প্রশ্নের জবাবে সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান বলেন, সরকার এভাবে ধারণা করতে পারে না। সরকার বিষয়টিকে খুবই গুরুত্বের সঙ্গে নিয়েছে। কারণ এটি আমাদের সবার নিরাপত্তার বিষয়। সচিবালয়ে রাষ্ট্রীয় অনেক গুরুত্বপূর্ণ দলিল থাকে। ফলে এ বিষয়টিকে সরকার খুবই গুরুত্বের সঙ্গে নিয়েছে, যার জন্য তিন দিনের মধ্যে প্রাথমিক প্রতিবেদন দিতে উচ্চ পর্যায়ের কমিটি করা হয়েছে।
আগুন নেভাতে দীর্ঘ সময় লাগা এবং দুই প্রান্তে আগুনের বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, আগুনটা আরও আগে নেভানো যেত কি না, আগুন নেভাতে বিলম্ব হয়েছে কি না-এগুলো কমিটির প্রতিবেদন না পাওয়া পর্যন্ত আমরা উত্তর দিতে পারব না। আপনারা প্রথম দিকে গিয়ে থাকলে, ভিডিও করে থাকলে তদন্ত কমিটিকে দিয়ে সহায়তা করতে পারেন। অনেক প্রশ্ন অনেকের মনে আছে, সব প্রশ্নের উত্তর যদি আমরা আমাদের মতো দিতে থাকি, তা হলে তো তদন্ত কমিটি করে কোনো লাভ হচ্ছে না। যার যা বক্তব্য আছে, কারও কাছে কোনো তথ্য থাকলে প্রয়োজন মনে করে তদন্ত কমিটিকেই জানিয়ে দেবেন। এই ঘটনার অবশ্যই একটা সুষ্ঠু এবং বিস্তারিত তদন্ত হতে হবে। আজকের ঘটনার কারণটা যখন আমরা নির্ধারণ করতে পারব, সে অনুযায়ী আমরা অবশ্যই সিদ্ধান্ত নেব। এই ধরনের ঘটনা আর যাতে কখনো না ঘটে, সে ব্যবস্থাও আমাদের নিতে হবে। অনেক নথি পুড়ে গেছে। এখানে নিরাপত্তার ব্যত্যয় ছিল কি না, অন্য কোনো বিষয় ছিল কি না, কী কারণে অগ্নিকাণ্ড ঘটেছে-এগুলো সবই তদন্ত কমিটি খতিয়ে দেখবে।
কয়টা মন্ত্রণালয়ের নথি পুড়েছে এবং পুড়ে যাওয়া নথিপত্র পুনরুদ্ধার করা সম্ভব হবে কি না, জানতে চাইলে স্থানীয় সরকার ও সমবায় এবং যুব ও ক্রীড়া উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়া বলেন, প্রায় ৫টি মন্ত্রণালয়ের নথি পুড়ে গেছে। ডাক ও টেলিযোগাযোগ বিভাগ আংশিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয় ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। যুব ও ক্রীড়া এবং স্থানীয় সরকার পল্লী উন্নয়ন এবং সমবায় মন্ত্রণালয়, সড়ক ও জনপদ বিভাগও ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এর মধ্যে যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয়ের নথি কার্যক্রম অনলাইনে থাকার কারণে আমরা উদ্ধার করতে পারব। স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন এবং সমবায় মন্ত্রণালয়ের কার্যক্রম পুরোটাই অ্যানালগভাবে ফাইলে হয়। তাই যে শাখাগুলোর নথিগুলো পুড়ে গেছে, সেগুলো কতটা রিকভার করা যাবে তা নিরূপণ করার জন্য মন্ত্রণালয় পর্যায়ে একটা কমিটি করা হয়েছে। সেই কমিটি কাজ করে প্রতিবেদন দিলে আমরা বুঝতে পারব, কী পরিমাণ ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে।
‘যড়যন্ত্র’ নিয়ে দেওয়া বক্তব্যের বিষয়ের জানতে চাইলে তিনি বলেন, স্থানীয় সরকার বিভাগে আমি দায়িত্ব নেওয়ার পর আমরা কিছু অর্থনৈতিক অসঙ্গতি লক্ষ্য করেছি। বিশেষ করে পিরোজপুর জেলায় বিভিন্ন প্রকল্পে অর্থ লোপাটের প্রাথমিক প্রমাণ আমরা পেয়েছি। এর সঙ্গে সাবেক মুখ্যসচিব তোফাজ্জল হোসেনের প্রাথমিক সম্পৃক্ততার প্রমাণ পাওয়া গেছে। সেটির বিস্তারিত তদন্ত এখনও চলছে। আমরা প্রথমে ধারণা করেছিলাম, তদন্তের যে ফাইনালগুলো ছিল মন্ত্রণালয়ে সেগুলো ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। কিন্তু এটি যেহেতু জেলা পর্যায়ে সংঘটিত হয়েছে, সে জন্য আমরা এগুলো উদ্ধার করতে পারব। আমাদের তদন্ত কর্মকর্তারা পিরোজপুরে আছেন।
এক প্রশ্নের জবাবে আসিফ মাহমুদ বলেন, ক্ষতিগ্রস্ত মন্ত্রণালয়গুলোর কার্যক্রম অস্থায়ীভাবে পরিচালনার জন্য আমরা সচিবালয়ের খালি জায়গা খোঁজার চেষ্টা করছি।
অগ্নিকাণ্ডের বিষয়ে ষড়যন্ত্র বলা হচ্ছে। সরকারের কাছে কি কোনো গোয়েন্দা তথ্য ছিল-এমন প্রশ্নে সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান বলেন, গোয়েন্দা তথ্য থাকলে সরকার ব্যবস্থা নিত। তথ্যের প্রবাহ ঠিক আছে কি না, তা তদন্ত কমিটির মাধ্যমে দেখতে হবে। কিন্তু তথ্য থাকলে আমরা বসে থাকতাম না।
বাংলাদেশের বেশিরভাগ তদন্তই আলোর মুখ দেখে না, এ তদন্ত কি নির্দিষ্ট সময়ে শেষ হবে-এ প্রশ্নের জবাবে পরিবেশ উপদেষ্টা বলেন, তিন দিনের মধ্যে প্রাথমিক প্রতিবেদন তারা দেবেন। আমরা সেখানে অফিস করি, এটা তো আমাদেরও নিরাপত্তার বিষয়। রাষ্ট্রীয় গুরুত্বপূর্ণ নথির বিষয়। প্রাথমিক প্রতিবেদনের পরে তারা যখন চূড়ান্ত প্রতিবেদন দেবেন, তা অবশ্যই আপনারা পাবেন। তদন্তের স্বার্থে হয়তো প্রাথমিক প্রতিবেদন প্রকাশ সম্ভব নাও হতে পারে। চূড়ান্ত প্রতিবেদন দ্রুততার সঙ্গেই হবে। সেই প্রতিবেদন আপনারা পাবেন।
আগুনের উৎসের বিষয়ে তদন্ত কমিটিই সঠিক বলতে পারবে। প্রাথমিক তথ্যের বিষয়টি সবাই জেনে গেছেন।
অন্য এক প্রশ্নের জবাবে সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান বলেন, আমরা কাউকে ছাড় দিচ্ছি না। রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে অপরাধী সাব্যস্ত করার আগে তদন্ত করতে হয়, সেই অনুযায়ী অনেকের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে, অনেককে চাকরি হতে সরানো হয়েছে, কাউকে কাউকে ওএসডি করা হয়েছে, কেউ কেউ কারাগারেও গেছেন। প্রশাসনের গতিটা রেখে ঢেলে সাজানোর কাজ আমরা করছি। এটি এমন না যেকোনো দাগী আসামির বিরুদ্ধে অভিযোগ এসেছে কিন্তু আমরা তদন্ত করিনি। সরকার আইনানুগ প্রক্রিয়া ফলো করে এগোচ্ছে। তিনি বলেন, আমরা অনেক ডিজিটালাইজেশনের কথা শুনে দায়িত্বে এসেছিলাম। আগুনের ঘটনার পরে আমরা দেখলাম যে, ডিজিটাল বাংলাদেশের সুফল আমাদের কোনো মন্ত্রণালয় পাচ্ছে না। নামকাওয়াস্তে একজন কর্মকর্তা ও প্রযুক্তি ডিজিটাইলাজেশনের সুফল আমরা পাচ্ছি না।
সচিবালয়ে নিরাপত্তার কোনো ব্যত্যয় ছিল কি না, প্রশ্নের জবাবে সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান বলেন, এ প্রশ্নটা আমাদেরও। সচিবালয়ের নিজস্ব নিরাপত্তা ব্যবস্থা আছে। সেই নিরাপত্তা ব্যবস্থা কি আদৌ ফেল করেছে? এটি কি কোনো মনুষ্যসৃষ্ট বিপর্যয় নাকি অন্য কোনো বিপর্যয়? এগুলোর উত্তর পাওয়ার জন্য আমাদের তদন্ত কমিটির প্রতিবেদনের অপেক্ষা করতে হবে। সব সম্ভাবনা মাথায় রেখে সরকার তদন্ত কমিটি করেছে। সরকারের পক্ষ থেকে ধারণা করা আলোচনা করা ঠিক হবে না।
রাতে সচিবালয়ের ৭ নম্বর ভবনের ওপরের দিকের একটি ফ্লোরের এপাশ-ওপাশে আগুন জ্বলতে দেখা যাওয়া নিয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে অনেকেই সন্দেহ প্রকাশ করেন। এ বিষয়ে ফায়ার সার্ভিসের ডিজি ব্রিগেডিয়ার জেনারেল জাহেদ কামাল ব্যাখ্যা দিয়ে বলেন, ‘যেভাবে আগুন ছড়িয়েছে সেটি ইন্টেরিয়র ডেকোরেশনের কারণে হতে পারে। এক জায়গায় আগুন ধরলে বিদ্যুৎ লাইনের মাধ্যমে সব জায়গা ছড়িয়ে পড়ে। বৈদ্যুতিক শর্টসার্কিট থেকে এ রকম ঘটতে পারে। তবে তদন্ত শেষ না করে নিশ্চিত কিছু বলা যাবে না।’
বৃহস্পতিবার সকালে ঘটনাস্থল পরিদর্শনের পর স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) মো. জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী। তিনি সাংবাদিকদের বলেন, ‘আগুনটা ছয় তলায় লেগেছে এবং সাত, আট ওপরের দিকে গেছে। নিচে আর আসতে পারেনি।’ অগ্নিকাণ্ডটি কোনো ষড়যন্ত্র কিংবা নাশকতা কি না? জানতে চাইলে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা বলেন, ‘এটি তদন্তের আগে আমি তো বলতে পারব না। তদন্তের পরে আপনাদের জানাব। সচিবালয়ের মতো এত সুরক্ষিত একটা জায়গায় কীভাবে আগুন লাগে-এ বিষয়ে তিনি বলেন, ‘অ্যাক্সিডেন্ট তো সব জায়গায় হতে পারে। এ জন্য তো অ্যাক্সিডেন্ট বলে। সচিবালয়ের ভেতরেও হতে পারে বলেই তো সচিবালয়ের ভেতরে ফায়ার সার্ভিসের গাড়ি রাখা হয়।’ স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা বলেন, এ ঘটনায় আমাদের একজন ফায়ার ফাইটার নিহত হয়েছেন। তিনি সড়ক দুর্ঘটনায় মারা গেছেন। একটা পাইপ নিয়ে সচিবালয়ের দিকে আসছিলেন। রাস্তা পার হচ্ছিলেন, এ সময় একটা ট্রাক তাকে ধাক্কা দেয়। তাকে হাসপাতালে নেওয়ার পথে মারা যান। এ ছাড়াও আরও দুই-তিনজন সামান্য আহত হয়েছেন। তারা সবাই সুস্থ আছেন। স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরীও অগ্নিকাণ্ডের কারণ জানতে তদন্ত পর্যন্ত অপেক্ষা করার কথা বলেন।
বুধবার গভীর রাতে সচিবালয়ের ৭ নম্বর ভবনে লাগা আগুন নেভাতে ফায়ার সার্ভিসের পাশাপাশি নৌবাহিনীর একটি দলও অংশ নেয়। বৃহস্পতিবার দুপুরে সচিবালয় থেকে বেরিয়ে এসে অগ্নি নির্বাপণে অংশ নেওয়া নৌবাহিনীর সিনিয়র চিফ পেটি অফিসার মো. আমিনুল ইসলাম সাংবাদিকদের জানান, সচিবালয়ের ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ড ‘পরিকল্পিত’ বলে ধারণা করছি। তিনি বলেন, ‘শর্টসার্কিট থেকে নয়, এটা পরিকল্পিতভাবে হয়তো আগুন লাগিয়ে দিয়েছে। আমাদের নৌবাহিনীর টিম এখানে কাজ করছে। শর্টসার্কিট থেকে নয়। মনে হলো, পরিকল্পিতভাবে লেগেছে। শর্টসার্কিট হলে একটা জায়গা থেকে সূত্রপাত হয়। এক জায়গা থেকে নয়, এটা হয়েছে কয়েকটা জায়গা থেকে।’ ভবনের ভেতরের পরিস্থিতি প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘ভেতরের সব নথিপত্র পুড়ে গেছে। যেখানে যেখানে আগুন গেছে সব জায়গায় পুড়ে গেছে।’
ফায়ার সার্ভিসের তথ্য অনুযায়ী, তারা আগুন লাগার খবর পায় বুধবার রাত ১টা ৫২ মিনিটে। রাত ১টা ৫৪ মিনিটে ঘটনাস্থলে পৌঁছান ফায়ার সার্ভিসের সদস্যরা। আগুন নিয়ন্ত্রণে প্রথমে ফায়ার সার্ভিসের আটটি ইউনিট কাজ করে। পরে ইউনিটের সংখ্যা বাড়ানো হয়। সবশেষ ফায়ার সার্ভিসের ১৯টি ইউনিট আগুন নিয়ন্ত্রণে কাজ করে। বৃহস্পতিবার সকাল ৮টা ৫ মিনিটে আগুন নিয়ন্ত্রণে আসে। দুপুর পৌনে ১২টায় আগুন পুরোপুরি নিভিয়ে ফেলেন ফায়ার সার্ভিসের সদস্যরা।
আগুনের শিকার দশ তলা ওই ভবনেই অর্থ মন্ত্রণালয়, অর্থ বিভাগ ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ; সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয়, সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগ; শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়; স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয়, স্থানীয় সরকার বিভাগ; পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় বিভাগ; ডাক, টেলিযোগাযোগ ও তথ্যপ্রযুক্তি মন্ত্রণালয়, ডাক ও টেলিযোগাযোগ বিভাগ; যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয়ের দফতর রয়েছে। ফায়ার সার্ভিস জানিয়েছে, ৬, ৭, ৮, ৯ এই চারটি তলা আগুনে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এর মধ্যে অষ্টম ও নবম তলায় ক্ষতি হয়েছে বেশি, সেখানকার অধিকাংশ নথি পুড়ে গেছে। স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের একজন কর্মচারী বলেন, তাদের ভবনের অনেকখানি পুড়ে গেছে আগুনে। ভেতরে বিদ্যুৎ নেই। পোড়া গন্ধ ভাসছে। দাফতরিক কার্যক্রম বন্ধ। তারা বেশ কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে বেরিয়ে এসেছেন। নৌ-পরিবহন মন্ত্রণালয়ের এক কর্মচারী জানান, তাদের ভবনে আগুন না লাগলেও পুরো ভবন আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর নিয়ন্ত্রণে। তারা অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে বেরিয়ে এসেছেন। ভেতরে বিদ্যুৎও নেই।
সচিবালয়ে প্রবেশের পাঁচটি প্রবেশমুখেই পুলিশসহ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা সতর্ক অবস্থায় রয়েছেন। ভেতরে কেউ ঢুকলেই করতে হয়েছে জবাবদিহি। আর অগ্নিকাণ্ডে ক্ষতিগ্রস্ত ৭ নম্বর ভবনে কাউকে প্রবেশ করতে দেওয়া হয়নি। সচিবালয়ে গভীর রাতে লাগা আগুন ১০ ঘণ্টা পর নেভানো গেলেও কয়েকটি ভবনে বিদ্যুৎ সংযোগ বিচ্ছিন্ন ছিল। বৃহস্পতিবার বিকাল পর্যন্ত বিদ্যুৎসংযোগ সচল না হওয়ায় বিঘ্নিত হয় প্রশাসনের এ প্রাণকেন্দ্রের দাফতরিক কাজ।
বুধবার ছিল বড় দিনের ছুটি। আর বৃহস্পতিবার সপ্তাহের শেষ কর্মদিবস। অফিসসূচি অনুযায়ী সকালেই সচিবালয়ে হাজির হন বিভিন্ন দফতরের কর্মচারীরা। কিন্তু কেবল একটি গেট খোলা থাকায় প্রচণ্ড ভিড় লেগে যায়। সেই ভিড় পেরিয়ে কর্মচারীরা ভেতরে ঢুকলেও দাফতরিক কার্যক্রম না হওয়ায় অনেকেই আবার বেরিয়ে পড়েন। তবে যেসব ভবনে বিদ্যুৎসংযোগ ছিল, সেখানে কার্যক্রম চলার কথা জানিয়েছেন কর্মকর্তারা। স্বাভাবিক সময়ে ১, ২, ৩ ও ৫ নম্বর গেট খোলা থাকলেও এদিন কেবল ৫ নম্বর গেট খোলা রাখা হয়। সেখান সবাইকে প্রবেশ করতে দেওয়া হয় পরিচয়পত্র দেখে। পরে ওই গেট দিয়েই অনেকে বেরিয়ে আসেন। তবে সকাল থেকেই কোনো সাংবাদিককে ভেতরে প্রবেশ করতে দেওয়া হয়নি।
সচিবালয়ে আগুনের ঘটনার তদন্ত হবে : সেনাবাহিনী
সেনা সদর দফতরের কর্নেল-স্টাফ কর্নেল ইন্তেখাব হায়দার খান বলেছেন, সচিবালয়ে আগুনের ঘটনার তদন্ত হবে। তদন্ত হলে আগুন লাগার কারণ জানা যাবে। সেখানে সেনাবাহিনী ফায়ার সার্ভিসের কর্মীদের সার্বিক সহযোগিতা করে যাচ্ছে। তিনি বলেন, দেশের গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা কিংবা কেপিআইয়ে হামলা ও নাশকতা প্রতিরোধ এবং নিরাপত্তা বিষয়ে অন্যান্য আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সঙ্গে কাজ করে যাচ্ছে সেনাবাহিনী। অন্যান্য আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সঙ্গে এ বিষয়ে নিয়মিত পর্যালোচনা করা হয়। বৃহস্পতিবার ইন এইড টু সিভিল পাওয়ারের আওতায় মোতায়েন করা সেনাবাহিনীর কার্যক্রম সম্পর্কিত প্রেস ব্রিফিংয়ে তিনি এসব কথা বলেন।
সরকারের গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা তথা সচিবালয়ে নাশকতা কিংবা আগুনের ঘটনা প্রসঙ্গে জানতে চাইলে সেনাবাহিনীর এই কর্মকর্তা সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে বলেন, ঘটনাটি মাত্র ঘটেছে। বিস্তারিত তথ্য এখনও আমরা পাইনি। তবে গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনার নিরাপত্তায় সেনাবাহিনী কাজ করছে।
শ্রম মন্ত্রণালয়ের ক্ষয়ক্ষতি নিরূপণে দুই কমিটি
শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) ড. এম সাখাওয়াত হোসেন ঘটনাস্থল পরিদর্শন করে তার অধীন মন্ত্রণালয়ের ক্ষয়ক্ষতি নিরূপণে ২টি কমিটি গঠনের নির্দেশনা দেন। পরে মন্ত্রণালয়ের নথিপত্র ও গুরুত্বপূর্ণ রেকর্ডসমূহের ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ নির্ধারণ ও তালিকা প্রস্তুত করা এবং ভবিষ্যতে যেকোনো দুর্ঘটনার ফলে উদ্ভূত ক্ষয়ক্ষতি রোধকল্পে করণীয় বিষয়ে সুপারিশ দেওয়ার জন্য প্রশাসন অধিশাখার যুগ্মসচিব বেগম মোর্শেদা আক্তারকে আহ্বায়ক করে ৫ সদস্যবিশিষ্ট কমিটি গঠন করা হয়। কমিটিতে সদস্য হিসেবে আছেন শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের উপসচিব মুহাম্মদ আশরাফ হোসেন, সিনিয়র সহকারী সচিব পূরবী গোলদার, সহকারী সচিব মো. মোস্তাফিজুর রহমান এবং সদস্য সচিব হিসেবে আছেন সিনিয়র সহকারী সচিব মোহাম্মদ মাসুম।
এ ছাড়াও মন্ত্রণালয়ের সম্পদের ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ নিরূপণের জন্য প্রশাসন অধিশাখার যুগ্মসচিব মো. আবদুছ সামাদ আল আজাদকে আহ্বায়ক করে অপর একটি কমিটি গঠন করা হয়েছে। গঠিত এ কমিটিতে সদস্য হিসেবে আছেন উপসচিব মোহাম্মদ সাইদুর রহমান, সিস্টেম এনালিস্ট সুকান্ত বসাক, সহকারী মেইনটেন্যান্স ইঞ্জিনিয়ার এ এস এম মেহরাব হোসেন। সদস্য সচিব হিসেবে আছেন উপসচিব মো. কামাল হোসেন। দুই কমিটিকে আগামী ৭ কর্মদিবসের মধ্যে প্রতিবেদন দাখিল করতে বলা হয়েছে।
ফায়ার ফাইটার নয়ন নিহতের ঘটনায় মামলা
সচিবালয়ের ভয়াবহ আগুন নিয়ন্ত্রণের কাজ করতে গিয়ে ট্রাকের চাপায় নিহত হন ফায়ার ফাইটার সোয়ানুর জামান নয়ন। এই ঘটনায় শাহবাগ থানায় বাহিনীটির পক্ষ থেকে সড়ক পরিবহন আইনে মামলা করা হয়েছে। মামলার বাদী হয়েছেন ফায়ার সার্ভিসের সদর দফতরে কর্মরত রুহুল আমিন মোল্লা। মামলায় আসামি করা হয়েছে ট্রাকচালক মো. বেল্লাল হোসেন ওরফে সুমন (৩৬) ও তার সহকারী ফরহাদ হোসেনকে (২০)। প্রত্যক্ষদর্শী জানান, নয়নকে চাপা দিয়ে ট্রাকটি দ্রুতগতিতে পালিয়ে কিছুদূর চলে গেলে উপস্থিত শিক্ষার্থী ও জনতা ব্যারিকেড দিয়ে ট্রাকটি আটকান। পরে চালক ও সহকারীকে আটক করে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনাস্থলে উপস্থিত আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে তুলে দিলে তাদের হেফাজতে নেয় শাহবাগ থানা পুলিশ। বৃহস্পতিবার মামলার পরে তাদের গ্রেফতার দেখানো হয়। এর আগে ঢাকা মেডিকেল পুলিশ ফাঁড়ির ইনচার্জ পরিদর্শক মো. ফারুক বলেন, রাত ৩টা ৪০ মিনিটে ফায়ার সার্ভিস কর্মী নয়নকে হাসপাতালের জরুরি বিভাগে নেওয়া হলে চিকিৎসক মৃত ঘোষণা করেন।
মামলার অভিযোগে বলা হয়, বুধবার রাত ২টার দিকে ফায়ার সার্ভিসের কেন্দ্রীয় নিয়ন্ত্রণ কক্ষ থেকে সচিবালয়ের ৭ নম্বর ভবনে আগুন লাগার তথ্য পেয়ে ঘটনাস্থলে আসেন বাদী রুহুল আমিন। আগুন ছড়িয়ে পড়লে তিনি ফায়ার সার্ভিসের কেন্দ্রীয় নিয়ন্ত্রণ কক্ষে সাহায্য চান। এর প্রেক্ষিতে সচিবালয়ের আগুন নিয়ন্ত্রণে তেজগাঁও ফায়ার স্টেশনের স্পেশাল টিম আসে। এই টিমের টিম লিডার ছিলেন মো. হুমায়ুন কবির। তার নেতৃত্বে মিনিবাস গাড়ি ও স্পেশাল টিমের আটজন ফায়ার ফাইটারসহ সচিবালয়ে আগুন নিয়ন্ত্রণে আসেন। তাদের অপারেশনাল কাজ চলার সময়ে ফায়ার ফাইটার সোয়ানুর জামান নয়ন, ডেলিভারি হোজ নিয়ে সচিবালয়ের মেইন গেটের সামনে রাস্তা পারাপার হওয়ার সময় গুলিস্থান জিরো পয়েন্ট থেকে কারওয়ান বাজারগামী একটি ট্রাক দ্রুত ও বেপরোয়া গতিতে ফায়ার ফাইটার নয়নকে চাপা দিলে তার মাথাসহ শরীরের বিভিন্ন স্থানে গুরুতর রক্তাক্ত আঘাতপ্রাপ্ত হয়। তাৎক্ষণিক বাদীসহ সহকর্মীরা উপস্থিত লোকজনের সহায়তায় নয়নকে উদ্ধার করে চিকিৎসার জন্য ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে গেলে জরুরি বিভাগের কর্তব্যরত চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন। এই ঘটনায় উপস্থিত ছাত্র-জনতা ঘাতক ট্রাকের চালক বেলাল ও হেলপার ফরহাদকে ট্রাকসহ আটক করে ডিউটিরত থানা পুলিশের হাতে তুলে দেয়।
মামলার বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন শাহবাগ থানার ওসি মোহাম্মদ খালিদ মনসুর। দৈনিক সময়ের আলোকে তিনি বলেন, ফায়ার ফাইটার নয়নের মৃত্যুর ঘটনায় মামলা হয়েছে। আসামি দুজনকে আদালতে পাঠানো হয়েছে। ঘাতক ট্রাক জব্দ আছে।
এদিকে ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স অধিদফতরের মিডিয়া সেলের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা তালহা বিন জসিম জানান, ‘সচিবালয়ের অগ্নিদুর্ঘটনায় ফায়ার সার্ভিসের তেজগাঁও ফায়ার স্টেশনের ফায়ারফাইটার মো. সোহানুর জামান নয়ন অগ্নিনির্বাপণে নিয়োজিত থাকা অবস্থায় সচিবালয়ের দক্ষিণ পাশের রাস্তায় দ্রুতগামী একটি ট্রাকের ধাক্কায় গুরুতর আহত হন। সাথে সাথে তাকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালে নেওয়ার পর কর্তব্যরত চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন। এ বিষয়ে শাহবাগ থানায় সড়ক পরিবহন আইনে একটি মামলা (নং ৩২) দায়ের করা হয়। এ ছাড়াও আগুনে ফায়ার সার্ভিসের আরও ৪ সদস্য আহত হন।’
সময়ের আলো/আরএস/