২০২৪ সালের জুলাই গণঅভ্যুত্থান দেশের ইতিহাসের কিংবদন্তিতুল্য আখ্যান। দেড় হাজারের অধিক নিহত এবং ৩০ হাজারের অধিক আহত ছাত্র-জনতার রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের মধ্য দিয়ে দেশে সৃজিত হয়েছে নতুনইতিহাস। যুগান্তকারী এই ইতিহাস বিনির্মাণে অংশ নিয়েছে জাতি-ধর্ম-শ্রেণি-পেশা নির্বিশেষে সর্বস্তরের মানুষের সঙ্গে আলেম-উলামা এবং মাদরাসা শিক্ষার্থীরাও। জুলাই-আগস্ট বিপ্লবে আলেম সমাজের অংশগ্রহণ এবং বিপ্লবী ভূমিকা নিয়ে বিশেষ আয়োজন সাজিয়েছেন আরিফ খান সাদ
বৈষম্যের বিরুদ্ধে আলেমদের অবস্থান
জুলাই গণঅভ্যুত্থানের সূচনা হয় সরকারি চাকরিতে বৈষম্য দূর করে কোটা সংস্কারের দাবিতে। দেশের সর্বস্তরের মানুষ এ দাবির সঙ্গে একাত্মতা ঘোষণা করে। ইসলামও সব ধরনের বৈষম্যের বিরুদ্ধে এবং যৌক্তিক সংস্কারের পক্ষে। একই সঙ্গে সব ধরনের জুলুম ও বিশৃঙ্খলার বিপক্ষে। ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে যেমন আলেম সমাজের অভিভাবক মুহাম্মদুল্লাহ হাফেজ্জি হুজুর ঘোষণা করেছিলেন, ‘এই যুদ্ধ জালেমের বিরুদ্ধে মজলুমের সংগ্রাম’, তেমনি ২০২৪ সালের ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানেও রাজপথে রক্তের স্রোত প্রবাহিত করে দেশের আলেম সমাজ এবং মাদরাসা শিক্ষার্থীরা। দেশের আলেম সমাজ ২০১৩ সালে শাপলা চত্বরে যেভাবে রক্ত দিয়েছেন, শতাধিক শহিদ হয়েছেন; তেমনি ২৪-এর গণঅভ্যুত্থানেও শতাধিক আলেম ও মাদরাসা শিক্ষার্থী শহিদ হয়েছেন, অঙ্গ হারিয়েছেন, বৈষম্যের বিরুদ্ধে জুমার খুতবা দেওয়ায় চাকরি হারিয়েছেন। খ্যাতিমান আলেম ও বক্তা মুফতি আরিফ বিন হাবিব, মুফতি শামসুদ্দোহা আশরাফি, মুফতি সাইফুল ইসলামের মতো খতিবদের চাকরিচ্যুত করা হয়েছে আন্দোলনের পক্ষে বক্তব্য দেওয়ায়। এ ছাড়া সারা দেশে অসংখ্য আলেম শারীরিকভাবে নিগৃহীত হয়েছেন। তবু তারা জুমার বয়ানে তুলে ধরেছেন ফেরাউনের জালেমের দাস্তান এবং সেনাবাহিনীসহ সাগরে ডুবে মৃত্যুবরণের করুণ পরিণতির শিক্ষা। ২৪-এর আন্দোলন ছিল যুগপৎ রাজপথে এবং অনলাইনে। আলেম সমাজ যেভাবে রাজপথ রক্তে রঙিন করেছেন, তেমনি বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের পক্ষে ফেসবুক প্রোফাইল পিকচারও লাল করে সংহতি প্রকাশ করেন; যেখানে পতিত সরকারের পক্ষ কালো রং প্রকাশের নির্দেশ দেওয়া হয়।
যাত্রাবাড়ীতে আলেমদের সংহতি সমাবেশ
জুলাই-আগস্ট আন্দোলনে রাজধানীর যাত্রাবাড়ী এলাকা ছিল পুরোদস্তুর রণক্ষেত্র। সর্বস্তরের ছাত্র-জনতার সঙ্গে রাজপথে নেমে এসেছিল আলেম সমাজও। যাত্রাবাড়ী বড় মাদরাসার শিক্ষক মাওলানা রিদওয়ান হাসান আহ্বান করেন সংহতি সমাবেশ। ৩ আগস্ট সকালে কাজলা পেট্রোল পাম্পের সামনে ‘সাধারণ আলেম সমাজ’ ব্যানারে দেশের পরিচিত আলেমদের নিয়ে সংহতি সমাবেশ করেন এবং বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সর্বাত্মক সংহতি প্রকাশ করেন। সেখানে জালেমের রক্তচক্ষুর সামনে বুক চিতিয়ে দাঁড়িয়ে যান আলেম ও গবেষক মাওলানা মূসা আল-হাফিজ, মাওলানা আবদুল্লাহ আল-মাসউদ, মাওলানা উসামা সিরাজ, মাওলানা তানজিল আরেফিন আদনান, মাওলানা আশরাফ মাহদিসহ অনেক আলেম। সেখানে অবস্থান কর্মসূচি শেষে মিছিল বের করা হয়। মিছিলটি কাজলা থেকে কুতুবখালী খাল পার হয়ে আরো সামনে গিয়ে শেষ হয়। মিছিল শেষে মোনাজাত করা এবং পরবর্তী কর্মসূচি ঘোষণা করা হয়। মাওলানা রিদওয়ান হাসান সময়ের আলোকে বলেন, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের পক্ষ থেকে যখন ‘মার্চ টু ঢাকা’ কর্মসূচি ঘোষণা করা হয়, তখন তাদের পক্ষ থেকেও সংহতি জানিয়ে ঘোষণা করা হয় ‘গাশত কর্মসূচি’। ইংরেজি মার্চ শব্দের ফারসি প্রতিশব্দ হচ্ছে ‘গাশত’। এভাবে যাত্রাবাড়ীর আলেম সমাজ মিশে যান জুলাই বিপ্লবের অংশ হয়ে।
জুলাই শহিদ মাদরাসা বোর্ডের কর্মকর্তা
জুলাই আন্দোলনে কওমি মাদরাসা শিক্ষা বোর্ডের (বেফাক) কর্মকর্তা মাওলানা শিহাব উদ্দীন ঘাতকের বুলেটের প্রাণ হারান। ১৯ জুলাই জুমার নামাজ পড়িয়ে নিজের বাসার ৬ তলার ওপরের বারান্দায় দাঁড়িয়েছেন। হঠাৎ একটি ঘাতক বুলেট ছুটে এসে মাথার একপাশ দিয়ে ঢুকে আরেক পাশ দিয়ে বের হয়ে যায়। মুহূর্তেই মৃত্যুর কোলে ঢোলে পড়েন এই প্রতিভাবান উদীয়মান আলেম। ২০১৬-১৭ শিক্ষাবর্ষে তিনি ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের সাইনবোর্ডের জামিয়াতুল ইবরাহিম মাদরাসা থেকে দাওরায়ে হাদিস শেষ করেছিলেন। গ্রামের বাড়ি ভোলা জেলার লালমোহন থানায়। পড়াশোনা শেষ করে কওমি মাদরাসা শিক্ষাবোর্ড বেফাক অফিসের দায়িত্বশীল কর্মকর্তা ছিলেন; পাশাপাশি একটি মসজিদে খতিব হিসেবে দায়িত্ব পালন করছিলেন। তার আগে তজুমদ্দিন মারকাজ মাদরাসার সিনিয়র শিক্ষক ছিলেন। যাত্রাবাড়ীতে বসবাসকারী আরেকজন আলেম রোকন রাইয়ান জানান, তাদের আশারা বিল্ডার্সের পাশের ভবনের একজন তরুণ আলেম দুপুরের খাবারের পর একটু রাস্তায় হাঁটতে বের হয়েছিলেন সেদিন, আশপাশে অনেক মানুষ রাজপথে ছিল, হঠাৎ একটা বুলেট ছুটে এসে বুকে ঢুকে পিঠ দিয়ে বের হয়ে যায়। গুলিটি করা হয় ওপর থেকে, বুকের ওপরের দিক দিয়ে ঢুকে পিঠের নিচ দিয়ে বের হয়ে যায়। সামান্য টুঁ শব্দটি করার সুযোগ পাননি। মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন আরেকজন তরুণ আলেম।
বারিধারা মাদরাসার স্মরণীয় খেদমত
রাজধানী বারিধারায় অবস্থিত ‘জামিয়া মাদানিয়া বারিধারা’ জুলাই বিপ্লবে সর্বাত্মকভাবে আন্দোনকারীদের পাশে দাঁড়িয়েছিল। ছাত্রছাত্রীদের জন্য খুলে দিয়েছিল মাদরাসার সব দরজা। এমনকি নারী শিক্ষার্থীদের জন্যও অবারিত ছিল টয়লেট এবং জরুরি প্রয়োজন পূরণের সুযোগ। বারিধারা মাদরাসার উচ্চতর আরবি ভাষা ও সাহিত্য বিভাগের শিক্ষক মুফতি গোলাম রাজ্জাক কাসেমী সময়ের আলোকে বলেন, ১৫ জুলাই থেকে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের পক্ষ থেকে ঘোষিত ‘বাংলা ব্লকেড’ কর্মসূচিতে সারা দেশ যখন উত্তপ্ত হয়ে ওঠে, তখন মাদরাসা-সংলগ্ন নতুনবাজার মহাসড়ক ব্লক করে অবস্থান নেয় ইউনাইটেড ইন্টারন্যাশনাল ভার্সিটির শিক্ষার্থীরা। সে সময় আন্দোলনরত শিক্ষার্থীরা যখন তীব্র তাপদাহ ও কাঠফাটা রোদে পিপাসায় হাপিত্যেশ করছিল, তখন বারিধারা মাদরাসার প্রিন্সিপাল মুফতি মনির হোসাইন কাসেমী জরুরি ভিত্তিতে মাদরাসার ছাত্রদের ডেকে ভলান্টিয়ারের কাজে নিয়োজিত করেন এবং আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের পানি, শরবত, স্যালাইন ইত্যাদি পানীয় খাবার সরবরাহ করার নির্দেশ দেন। পাশাপাশি তিনি এটাও বলে দেন, তাদের বিশ্রাম ও ওজু-ইস্তিঞ্জার ব্যাপারে নির্দ্বিধায় মাদরাসায় আসতে বলবে। তাদের জন্য মাদরাসা গেট সর্বদা উন্মুক্ত। মাদরাসার সিনিয়র মুহাদ্দিস মাওলানা জাকির ছাত্রদের বললেন, ‘আনলিমিটেড পানি, শরবত, বিস্কুট, স্যালাইনের ব্যবস্থা করো। টাকা আমরা দেব।’ বারিধারার স্বেচ্ছাসেবী (প্রায় ৫০ জন) ছাত্রদের ভাষ্য মতে, সেদিন আমরা আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের মাঝে কত হাজার লিটার শরবত আর কতশত বিস্কুট বিতরণ করেছিলাম সংখ্যাটা বলতে পারব না। এক কথায় বেহিসাব। ৫ আগস্টের পর বারিধারার শত শত তালিবুল ইলম রাস্তাঘাট পরিষ্কার ও ট্রাফিক পুলিশের ভূমিকা পালন করে। প্রায় প্রতিদিন ট্রাফিকে থাকা বৈষম্যবিরেধী ছাত্র আন্দোলনের শিক্ষার্থীদের মাঝে অসংখ্য বিরিয়ানির প্যাকেট বিতরণ করা হয়েছে বারিধারা মাদরাসার পক্ষ থেকে। মুহতামিম সাহেব স্বয়ং এর মান নিয়ন্ত্রণ করছেন। সংখ্যা নির্দিষ্ট করে বললে ১১ আগস্ট ৩০০ প্যাকেট গরুর বিরিয়ানি বিতরণ করা হয়। ১২ তারিখ প্রায় ১৫০ জন স্বেচ্ছাসেবী বৈষম্যবিরোধী ছাত্রদের মাদরাসার মেহমানখানায় এনে ভাত-তরকারি ও গোশত দিয়ে মেহমানদারি করা হয়েছে। এ ছাড়া মাদরাসার ভাইস প্রিন্সিপাল মাওলানা মাসউদ সাহেবের ব্যক্তিগত প্রচেষ্টায় শতাধিক ছাত্রকে শিঙাড়া, জুস ইত্যাদি খাওয়ানো হয়। প্রতিনিয়ত ট্রাফিকের দায়িত্বপালনরত অসংখ্য শিক্ষার্থীকে বিনামূল্যে খাবার বিতরণসহ তাদের বিশ্রাম, ওজু ও ইস্তিঞ্জার জন্য মাদরাসার গেট উন্মুক্ত ছিল সর্বদা।
মাদরাসা শিক্ষার্থীদের বিপ্লবী গ্রাফিতি
জুলাই বিপ্লবে রাজধানী ঢাকাসহ সারা দেশে বিপুল সাড়া জাগায় গ্রাফিতি বা দেয়ালচিত্র। শহরের দেয়ালে দেয়ালে শোভিত হয় মাদরাসা শিক্ষার্থীদের আঁকা আরবি-বাংলা বর্ণের এবং বিভিন্ন দৃশ্য সংবলিত নান্দনিক গ্রাফিতি। দেশি-বিদেশি গণমাধ্যমেও আলোচিত হয়। ‘স্বাধীনতার সূর্যোদয়’ নামের একটি ক্যালিগ্রাফি পুরো দেশের মানুষের দৃষ্টি আকর্ষণ করে। দেশের প্রথম সারির অনেক গণমাধ্যমে বিশেষ ফিচার প্রতিবেদন ছাপা হয়। অসংখ্য মানুষ সেটা তাদের ফেসবুক প্রোফাইল পিকচার হিসেবেও ব্যবহার করে। গ্রাফিতিটি আঁকেন মাওলানা উসাইদ মুহাম্মদ। তিনি ঢাকার লালবাগ জামিয়া কুরআনিয়া মাদরাসা থেকে দাওরায়ে হাদিস শেষ করেছেন। উসাইদ মুহাম্মদ বলেন, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে যখন শেখ হাসিনা পদত্যাগ করে দেশ ছাড়েন তখন থেকে নতুনভাবে দেশ স্বাধীনতা পায়।
তারপর তার একাডেমির সদস্যদের নিয়ে ঢাকা শহিদ মিনারে যান ক্যালিগ্রাফি করতে। কিন্তু সেখানে চারুকলার কয়েকজন ছাত্র ও শিক্ষক মিলে শহিদ মিনার প্রাঙ্গণে ক্যালিগ্রাফি করতে দেননি এবং অপমান করে চলে যেতে বলেন। তখন তাদের এই ৫০ জনের দলটি ক্যালিগ্রাফি করার জন্য পুরো দেশে ছড়িয়ে পড়ে। উসাইদ ও তার একাডেমির একজন সদস্য জুনায়েদ আহমেদ ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় গিয়ে জেলা শহরের দক্ষিণ মৌড়াইলস্থ পাবলিক লাইব্রেরির পশ্চিম পাশের মিশন হাসপাতালে একটি পুরোনো দেয়ালে ছবিটি অঙ্কন করেন। উসাইদ বলেন, ‘স্বাধীনতার সূর্যোদয়’ যে শিরোনাম দেওয়া হয়েছে তার কারণ স্বাধীনতার সূর্যোদয় আমরা তখন সদ্যই পেয়েছি। সূর্যের আলো তখনও আমাদের ওপর পুরোপুরি আসেনি। অঙ্কনে কিছুটা সূর্যোদয় করা হয়েছে, কিছু উদয় করা হয়নি। তা ছাড়া অঙ্কনের ভেতর যে ভাঙা দেয়ালটি রয়েছে সেটি হচ্ছে কিছু দিন পূর্বে যে আমাদের ওপর যে জরাজীর্ণ অবস্থা গেছে এবং একটি অশৃঙ্খল পরিবেশ তৈরি হয়েছিল তার প্রতিফলন। আর সেই জরাজীর্ণ অবস্থা থেকে সূর্য উদয় হচ্ছে বিষয়টি বোঝানো হয়েছে। তা ছাড়া কিছুটা সবুজ-শ্যামল ঘনঘটা দেওয়া হয়েছে। তিনি আরও বলেন, ৯ আগস্ট শুক্রবার বাদ আসর থেকে ‘স্বাধীনতার সূর্যোদয়’ চিত্রাঙ্কনটির কাজ শুরু হয়। রাত ৩টা অবধি কাজ চলে। শনিবার দুপুর ২টা নাগাদ অঙ্কনটির কাজ শেষ হয়। এতে পুরো জেলার চিত্রটি তুলে ধরা হয়। ব্রাহ্মণবাড়িয়ার ঐতিহাসিক যে বিষয়গুলো রয়েছে যেমন-জামিয়া ইসলামিয়া ইউনুসিয়া মাদরাসা, ব্যাপ্টিস্ট চার্চ, তিতাস গ্যাস ক্ষেত্রকে চিত্রাঙ্কনটিতে তুলে ধরা হয়েছে। এই অঙ্কনটিতে কোনো বৈষম্য রাখা হয়নি। যেকোনো ধর্ম বা গোত্রের লোকজন চিত্রটির সামনে এসে ছবি তুলতে পারবে। শহিদ মিনারে হাফেজ শহিদের জানাজা অতিসম্প্রতি ২৪-এর শহিদি মিছিলে শামিল হলেন ১২ বছর বয়সি মাদরাসা শিক্ষার্থী আরাফাত। পবিত্র কুরআনের নাজেরা শেষ করে তিন পারা মুখস্থ করা আরাফাত রাজধানী উত্তরার জামিয়া রওজাতুল উলুম মাদরাসার ইবতেদায়ি আউয়ালের শিক্ষার্থী ছিল। ৫ আগস্ট সোমবার ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থান-পরবর্তী বিজয় মিছিলে অংশ নিয়ে পুলিশের গুলিতে গুরুতর আহত হন। ঘাতকের বুলেট আরাফাতের বাম পাঁজর দিয়ে ঢুকে ডান পাঁজর দিয়ে বের হয়ে যায়। গুলি লাগার কারণে তার পাঁজরের হাড় ছিদ্র হয়ে যায়, কোমরের অংশে মেরুদণ্ড চূর্ণ হয়ে যায়, কিডনি ডেমেজ হয়ে যায় এবং মাথায় প্রচুর রক্তক্ষরণ হয়। উত্তরা আধুনিক হাসপাতাল এবং কুর্মিটোলা সামরিক হাসপাতাল থেকে ফেরত পাঠানোর পর সিএমএইচে ভর্তি করা হলেও তিন মাস চিকিৎসাধীন থেকে ২২ ডিসেম্বর ইন্তেকাল করে। উন্নত চিকিৎসার জন্য ২৪ ডিসেম্বর বিদেশ নেওয়ার পরিকল্পনা ছিল, কিন্তু তার আগেই শহিদ হয়। আরাফাত বরিশাল জেলার মেহেন্দিগঞ্জ থানার বাসিন্দা শহিদুল ইসলামের ছেলে। তার পিতা পেশায় একজন রিকশাচালক। ২৩ ডিসেম্বর সোমবার কেন্দ্রীয় শহিদ মিনারে আরাফাতের নামাজের জানাজা অনুষ্ঠিত হয়। জানাজার ইমামতি করেন আরাফাতের ভাই হাসান আলী। জানাজায় অংশগ্রহণ করেন অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টা নাহিদ ইসলাম, আরাফাতের বাবা শহীদুল ইসলাম, স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের বিশেষ সহকারী অধ্যাপক মো. সায়েদুর রহমান, প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের অন্যতম সমন্বয়ক সারজিস আলম, দৈনিক আমার দেশ পত্রিকার সম্পাদক মাহমুদুর রহমান, বিভাগীয় সম্পাদক মাওলানা শরীফ মুহাম্মদ এবং বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার বিশিষ্ট ব্যক্তিত্ববর্গ।
মন্দির পাহারায় মাদরাসাছাত্ররা
ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানের সুযোগ নিয়ে পতিত সরকারের কতিপয় দুষ্কৃতকারীরা সংখ্যালঘুদের ওপর ধ্বংসযজ্ঞ শুরু করে দেয়। দেশের বিভিন্ন জায়গায় সনাতন ধর্মাবলম্বীদের মন্দিরে হামলার খবর ছড়িয়ে পড়লে মাদরাসার ছাত্ররা দেশের বিভিন্ন মন্দির প্রাঙ্গণে অবস্থান নিয়ে পাহারা দেন। এবাভে বিশ্ববাসীর সামনে সাম্য ও সম্প্রীতির এক বিরল দৃষ্টান্ত সৃষ্টি করেন আলেম-উলামা এবং মাদরাসার শিক্ষার্থীরা। মন্দিরে পাহারারত মোস্তাক আহমেদ নামের এক মাদরাসা শিক্ষার্থী বলেন, ‘আমরা কোনো ধর্মীয় স্থাপনায় আঘাত চাই না, শান্তি চাই। কওমি মাদরাসার ছাত্ররা সুনামগঞ্জের সব মন্দিরের নিরাপত্তা দিচ্ছে, যাতে কোনো অপ্রীতিকর ঘটনা না ঘটে।’ নিখিল চন্দ্র নামে হিন্দু সম্প্রদায়ের একজন বলেন, ‘মুসলিম ভাইয়েরা আমাদের মন্দির পাহারা দিচ্ছে সারা রাত। আমরা সবাই মিলেমিশে থাকতে চাই। কোনো ধর্মীয় সংঘাত চাই না।’ মাদরাসা ছাত্রদের মন্দির পাহারার আন্তরিকতায় আপ্লুত হয়ে পড়েন সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের লোকজন। বাংলাদেশ হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদের সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট রানা দাশগুপ্ত মুগ্ধ হয়ে গণমাধ্যমকে বলেন, ‘দেশের বিভিন্ন জায়গায় স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় ও মাদরাসার শিক্ষার্থীরা মন্দির ও হিন্দু সংখ্যালঘুদের ঘর পাহারা দিচ্ছে। বিষয়টাকে আমরা ইতিবাচকভাবে দেখছি। আমাদের বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের শিক্ষার্থীদের প্রতি অনুরোধ, নতুন সরকার আসা পর্যন্ত সংখ্যালঘু এলাকা, প্রতিষ্ঠান ও মানুষকে তারা নিরাপত্তা দিক। আমরা দেশে মন্দির বা উপাসনালয়ে হামলার তথ্য সংগ্রহ করার চেষ্টা করছি।’ এ ছাড়া ধর্ম মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা ড. আ ফ ম খালিদ হোসেন বিভিন্ন মন্দিরে উপস্থিত হয়ে নিরাপত্তার ঘোষণা দেন। বিভিন্ন জাতীয় গণমাধ্যমে প্রকাশিত খবর অনুযায়ী কিশোরগঞ্জ, গাজীপুর, কুমিল্লা, নোয়াখালী, লক্ষ্মীপুর, সুনামগঞ্জ, শরীয়তপুর, টাঙ্গাইল, ভোলা, ঢাকাসহ দেশের একাধিক স্থানের মন্দির ও উপাসনালয়ের নিরাপত্তা নিশ্চিত করেন মাদরাসাছাত্ররা।
ইসলামি লেখক ফোরামের জুলাই কবিতা প্রতিযোগিতা
জুলাই বিপ্লবের স্মরণে ‘বাংলাদেশ ইসলামি লেখক ফোরাম’ আয়োজন করে জুলাই কবিতা প্রতিযোগিতা। ২০ ডিসেম্বর শুক্রবার বেলা ৩টায় রাজধানীর বাংলামোটরে বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের মিলনায়তনে এটি অনুষ্ঠিত হয়। এতে জুলাই বিপ্লব নিয়ে রচিত কবিতা পাঠ করেন ২০-এর অধিক আলেম কবি। ইসলামি লেখক ফোরামের সভাপতি কবি মুনীরুল ইসলামের সভাপতিত্বে, সাধারণ সম্পাদক মুফতি আমিন ইকবালের সঞ্চালনায় এবং দেশবরেণ্য আলেম লেখকদের উপস্থিতিতে বিজয়ী কবিদের হাতে পুরস্কার তুলে দেওয়া হয়। জুলাই বিপ্লবের স্বরচিত কবিতা পাঠ প্রতিযোগিতায় প্রথম পুরস্কার লাভ করেন মাহফুজ ইকরাম, দ্বিতীয় স্থান লাভ করেন আনিস আরমান এবং তৃতীয় স্থান লাভ করেন নাঈমুর রহমান।
ইসলামি বইমেলায় জুলাই বিপ্লবের প্রতিফলন
৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে ক্ষমতার পালাবদলে ইসলামি মেলাতেও লাগে পরিবর্তনের ছোঁয়া। মূল ধারার ইসলামিক প্রকাশকরা বায়তুল মোকাররমের বইমেলায় অনেকটাই অবহেলিত ছিলেন। দুর্নীতিপরায়ণ সরকারের আমলে নানা অনিয়ম ও দুর্নীতির বেড়াজালে জড়ানো ছিল বইমেলার পরিবেশ। এ বছর রবিউল আওয়াল মাসে প্রকাশকদের দীর্ঘ আন্দোলন ও চাপে বর্ধিত ও অন্তর্ভুক্তিমূলক ইসলামিক বইমেলা হয়। এবার মেলায় যুক্ত হয় অনেক নতুন আয়োজন-যা ছিল প্রকাশক, লেখক, পাঠক ও ধর্মপ্রাণ মানুষের দীর্ঘদিনের প্রত্যাশা। প্রকাশকদের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে বায়তুল মোকাররম জাতীয় মসজিদের পূর্ব চত্বরে অনুষ্ঠিত হয় বর্ণাঢ্য বইমেলা। বইমেলায় স্টলের সংখ্যা ও আকার বর্ধিত করার পাশাপাশি নকশায় আনা হয় নান্দনিকতা। মূল চত্বরে আঁকা হয় জুলাই বিপ্লবের থিম ডিজাইন। মেলায় নতুন করে যুক্ত হয় কর্নার, শিশু কর্নার, নারীদের বিশেষ ব্যবস্থা, ঘোষণা মঞ্চ তথ্যকেন্দ্র এবং নানা আয়োজন। এ ছাড়া মাসব্যাপী ইসলামি বইমেলাকে প্রাণবন্ত করে তুলতে নিয়মিত সিরাত, ফিলিস্তিন, জুলাই অভ্যুত্থানসহ নানা বিষয়ে আলোচনা এবং জ্ঞানভিত্তিক কর্মশালার আয়োজন করা হয়। ২২ অক্টোবর মঙ্গলবার বায়তুল মোকাররম জাতীয় মসজিদের পূর্ব সাহানে ইসলামি বইমেলা ২০২৪-এর উদ্বোধন করেন ধর্ম উপদেষ্টা ড. আ ফ ম খালিদ হোসেন।
আস-সুন্নাহ ফাউন্ডেশনের চিকিৎসা সহায়তা
জুলাই বিপ্লবে হতাহতদের চিকিৎসাসেবায় এগিয়ে আসেন আস-সুন্নাহ ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান শায়খ আহমাদুল্লাহ। ২০ আগস্ট মঙ্গলবার দুপুরে রাজধানীর শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে আহত রোগীদের শারীরিক অবস্থার খোঁজখবর ও তাদের আর্থিক সহায়তা প্রদান করেন তিনি। সে সময় তার সঙ্গে ছিলেন অন্তর্বর্তী সরকারের ধর্ম উপদেষ্টা ড. আ ফ ম খালিদ হোসেন, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের অন্যতম সমন্বয়ক সারজিস আলম প্রমুখ। শায়খ আহমাদুল্লাহ আহত রোগীদের শারীরিক অবস্থার খোঁজখবর নেওয়া শেষে সাংবাদিকদের জানান, আস-সুন্নাহ ট্রাস্ট বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে আহত রোগীদের চিকিৎসা সহায়তায় এ পর্যন্ত ৫
কোটি টাকা আর্থিক সহায়তা প্রদান করেছে। এ ফাউন্ডেশন পরবর্তীতে আরও ৫ কোটি টাকা আর্থিক সহায়তা প্রদান করবে।
তিনি বলেন, আহত রোগীদের যে ভয়াবহ অবস্থা তা সরাসরি এসে কেউ না দেখলে কল্পনাও করতে পারবে না। মুমূর্ষু অবস্থায় তারা রয়েছে। তাই আমরা আমাদের অন্যান্য প্রজেক্টের ব্যয়কে সংকুচিত করে তাদের পাশে দাঁড়াচ্ছি।
বায়তুল মোকাররমের খতিবের অভিমত
পতিত সরকারের আমলে দেশের সর্বত্রই বৈষম্যের বীজ বপন করে দেওয়া হয়েছিল। এমনকি আল্লাহর ঘর পবিত্র মসজিদ পর্যন্ত রেহায় পায়নি। সেখানেও কোনো ইনসাফ বজায় রাখা হয়নি। আওয়ামী লীগের দলীয় মদদপুষ্ট খতিবকে সাধারণ মুসল্লিরা ঘৃণাভরে প্রত্যাখ্যান করার পর খতিব হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয় বরেণ্য আলেম, গবেষক ও হাদিসবিশারদ মুফতি আবদুল মালেক সাহবকে।
জাতীয় মসজিদের মিম্বরে বসার পর থেকে প্রতি জুমায় তিনি দেশের মুসলিম সমাজের কণ্ঠস্বর হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন এবং সবার প্রশংসা কুড়াচ্ছেন। ১৫ নভেম্বর ২০২৪ শুক্রবার তিনি জাতীয় মসজিদের মিম্বর থেকে ঘোষণা করেন, ‘বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে শহিদদের রক্তের মর্যাদা রক্ষা করা আবশ্যক। তাদের রক্তের প্রতি অমর্যাদা, অবহেলা বা অবিচার করা জায়েজ নেই।
বৈষম্য দূরীকরণের নামে নতুন বৈষম্য তৈরি করা অথবা বৈষম্য শব্দের অসৎ ব্যবহার করা শহিদদের রক্তের প্রতি অবিচারের নামান্তর। আমাদের সরকার, সব রাজনৈতিক দল এবং মুসলিম-হিন্দুসহ দেশের সব নাগরিক যদি বিপ্লবে শহিদদের রক্তের প্রতি শ্রদ্ধাশীল থেকে বিপ্লবের শুকরিয়া আদায় না করে, তা
হলে আল্লাহর গজব আবার হয়তো এই দেশের ওপর চেপে বসবে।’
আলেমের কলমে জুলাই বিপ্লবের ইতিহাস
তিন মাসের কম সময়ের মধ্যে প্রামাণ্য ইতিহাস তুলে ধরেছেন আলেম লেখক ও গবেষক মাওলানা আবদুল্লাহ আল মাসউদ। বইটির নাম ‘২৪-এর গণঅভ্যুত্থান : স্মৃতিচারণ ও ইতিহাস’। ২২৪ পৃষ্ঠার বইটিতে তুলে ধরা হয়েছে ২৪-এর আন্দোলনের আদ্যোপান্ত এবং আলেম সমাজের সংগ্রামের দলিল। লেখক নিজেও ছিলেন রাজপথে প্রত্যক্ষভাবে সম্পৃক্ত এবং যাত্রাবাড়ীর ‘সাধারণ আলেম সমাজ’ কমিটির সদস্য। বিপ্লবোত্তর পরিবর্তিত দেশে বায়তুল মোকাররম ইসলামি বইমেলায় অক্টোবর মাসে প্রকাশিত হয় বইটি।
বইটি প্রকাশ করে বাংলাবাজারের রাহনুমা প্রকাশনী। লেখক একজন আলেম হওয়ায় তার বইয়ের
পাতায় পাতায় উঠে এসেছে জুলুমের বিরুদ্ধে ইসলামের দৃষ্টিভঙ্গি। বইটিতে ফুটে উঠেছে বৈষম্যমুক্ত বাংলাদেশ বিনির্মাণে আলেমদের অধিকার আদায়ের সংগ্রাম, জালেমের বিরুদ্ধে মজলুমের লড়াই, স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে দেশের মানুষের ক্ষোভ, সর্বস্তরের দেশপ্রেমিক মানুষের অবদান, দেশের শত্রুদের অত্যাচারের নির্মম চিত্র, গণহত্যার ভয়াবহ বর্ণনা, আন্দোলনকারীদের একের পর এক সাহসী কর্মসূচি, ছাত্রদের ওপর আওয়ামী বাহিনীর নির্মম অত্যাচার, কারফিউ, অবরুদ্ধ ঢাকা নগরীর চিত্র, শহিদদের আত্মত্যাগ, সমাজের সব শ্রেণির মানুষের ঐক্য এবং অসাধু মানুষদের স্বার্থপরতার চিত্র।
লেখক এতে আরও তুলে ধরেছেন চব্বিশের অভ্যুত্থানে দেশপ্রেমিক আলেম সমাজের অবদান এবং চব্বিশের অভ্যুত্থানের অন্যতম সংগঠক ‘সাধারণ আলেম সমাজ’-এর সংহতি সমাবেশের ইতিবৃত্ত। সর্বোপরি এটি একজন আলেমের কলমে রচিত সময়ের জীবন্ত ইতিহাস।
সময়ের আলো/আরএস/