রাজধানীর নিউ মার্কেট এলাকার ফুটপাথে প্রায় চার বছর ধরে ব্যবসা করছেন আরিফুল ইসলাম। দীর্ঘ সময় রাস্তার পাশে অবস্থান করায় তিনি আগের মতো কানে শোনেন না। ভুগছেন হৃদরোগেও। তিনি সময়ের আলোকে বলেন, কেউ আমার সঙ্গে কথা বলতে চাইলে জোরে বলতে হয়।
চিকিৎসক জানিয়েছেন, শব্দদূষণের কারণে এমনটা হয়েছে। এ বিষয়ে কথা হয় রাজধানীর কলাবাগন এলাকায় দায়িত্বরত এক ট্রাফিক পুলিশের সঙ্গেও। তিনি নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, আমি আগে কানে ঠিকমতো শুনতে পেলেও বর্তমান পেশায় আসার পর কম শুনতে পাই। অনেক চিকিৎসকের পরামর্শ নিয়েও সমস্যা যাচ্ছে না। কারণ আমাদের সবসময় উচ্চ শব্দের মধ্যে থাকতে হয়।
অতিসম্প্রতি বায়ুমণ্ডলীয় দূষণ অধ্যয়ন কেন্দ্রের (ক্যাপস) এক প্রতিবেদনের তথ্য অনুসারে, শব্দদূষণের ফলে অধিকাংশ ট্রাফিক সদস্য কানে কম শোনেন।
তবে ঢাকার অধিকাংশ মানুষের শ্রবণ পরিস্থিতি একই। শব্দদূষণ যেমন বিরক্তিকর তেমনি বিরূপ প্রভাব ফেলছে জনস্বাস্থ্যে। ঢাকা শহরের অধিকাংশ এলাকায় শব্দ গ্রহণযোগ্য মাত্রার চেয়ে বেশি। ক্যাপসের তথ্যমতে, বর্তমানে ২৪ ঘণ্টার মধ্যে গড়ে ১৪ ঘণ্টা শব্দদূষণ থাকে। তীব্রতা আগের চেয়ে অনেকটাই বৃদ্ধি পেয়েছে। কিছু কিছু এলাকায় ‘হর্ন বাজানো নিষেধ’ লেখা থাকলেও তেমন কার্যকর নেই। হাইড্রোলিক হর্নের আমদানি নিষিদ্ধে আইন থাকলেও তার কোনো বাস্তবায়ন নেই।
শব্দদূষণে নারী, শিশুসহ সব বয়সের মানুষই ক্ষতিগ্রস্ত হয়। পাঁচ থেকে সাত বছর কেউ মাত্রার চেয়ে বেশি শব্দদূষণের ভেতরে থাকলে তার স্বাভাবিক শ্রবণশক্তি কমে যায় এবং তার ঘুমের সমস্যা হয়। ঘুমের সাধারণ ধরন নষ্ট হয়ে গেলে তা শরীরের সব স্থানে প্রভাব ফেলে। সবচেয়ে বেশি সমস্যা হলো তিনি মানসিক অবসাদগ্রস্ত হয়ে পড়েন। শিশুদের পড়াশোনায় মনোযোগ কমার প্রধান কারণও এটি। এসব শব্দদূষণের প্রধান উৎস যানবাহন। কারণ যানবাহন থেকে প্রায় ৬০ থেকে ৭০ শতাংশ শব্দদূষণ হয়ে থাকে। এরপরই নির্মাণকাজের মাধ্যমে শব্দদূষণ হয়। রাজনৈতিক অনুষ্ঠান, ধর্মীয় উৎসবে মাইক ব্যবহারের ফলে শব্দদূষণ হয়। শিল্পকারখানার মাধ্যমে ব্যাপক শব্দদূষণ হয়ে থাকে।
চলতি বছরের ১ অক্টোবর হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর এলাকা থেকে দেড় কিলোমিটার উত্তর ও দেড় কিলোমিটার দক্ষিণ পর্যন্ত নীরব এলাকা ঘোষণা করে সরকার। এসব এলাকাকে নীরব ঘোষণা করলেও শব্দ কাক্সিক্ষত মাত্রায় ছিল না। এলাকাজুড়েই ছিল মাত্রাতিরিক্ত শব্দদূষণ। নীরব এলাকা ঘোষণার পূর্বের পাঁচ দিন, ঘোষণার পরের পাঁচ দিন এবং ঘোষণা কার্যকর হওয়ার পরের পাঁচ দিন বিমানবন্দর এলাকায় বিজ্ঞানভিত্তিক পদ্ধতিতে শব্দদূষণের উপাত্ত সংগ্রহ করে বায়ুমণ্ডলীয় দূষণ অধ্যয়ন কেন্দ্র (ক্যাপস)। বিমানবন্দরের আশপাশের চারটি স্থানকে নির্বাচিত করে ১৫ দিনে দৈনিক ১৩ ঘণ্টা করে প্রায় পাঁচ হাজার উপাত্ত সংগ্রহ করা হয়।
সম্প্রতি ক্যাপসের গবেষণায় দেখা যায়, নীরব এলাকা কার্যকরের পূর্বের পাঁচ দিনের গড় শব্দমাত্রা ছিল ৮৭ দশমিক ৮১ ডেসিবল। কার্যকরের শুরুর পাঁচ দিন এটি কমে ৮৬ দশমিক ৪৯ ডেসিবল হয়, অর্থাৎ ১ দশমিক ৩৩ ডেসিবল বা এক দশমিক ৫১ শতাংশ শব্দদূষণ হ্রাস পায়। দুই মাস পর শব্দমাত্রা কার্যকরের ঘোষিত এলাকায় ৫ দিনের গড় শব্দমাত্রা ছিল ৮৭ দশমিক ৩ ডেসিবেল। নীরব এলাকা ঘোষণার পর প্রথম ৫ দিনে শব্দের মাত্রা এক দশমিক পাঁচ শতাংশ কমলেও দুই মাস পর এটি পূর্বের তুলনায় মাত্র শূন্য দশমিক ৫৮ শতাংশ হ্রাস পায়। সামগ্রিকভাবে কার্যকরের পরে শুরু দিকে শব্দদূষণ হ্রাস পেলেও দ্বিতীয় পর্যায়ে শুরু তুলনায় প্রায় এক শতাংশ শব্দদূষণ বৃদ্ধি পায়।
শব্দদূষণের কারণে বধির হওয়াসহ নানা সমস্যার সম্মুখীন হতে হয়। বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার তথ্য অনুযায়ী, শব্দদূষণের কারণে প্রতি এক হাজারজনের মধ্যে একজন জীবনের কোনো না কোনো সময় বধির হয়ে যেতে পারে। এ ছাড়া একই কারণে প্রতি এক হাজারে একজন বধির হয়ে জন্ম নিচ্ছে। শব্দদূষণ থেকে বধিরতা ছাড়াও ৩০টি কঠিন রোগের কারণ ১২ রকমের পরিবেশ দূষণ। এর মধ্যে শব্দদূষণ অন্যতম। শব্দদূষণের কারণে রক্তচাপ বৃদ্ধি, হৃদস্পন্দনে পরিবর্তন, হৃৎপিণ্ডে ও মস্তিস্কে অক্সিজেন কমে যেতে পারে। এ জন্য শ্বাসকষ্ট, মাথাঘোরা, বমি বমিভাব, বমি হওয়া, দিক ভুলে যাওয়া, দেহের নিয়ন্ত্রণ হারানো, মানসিক ক্ষতিসহ বিভিন্ন ধরনের অসুস্থতা তৈরি করে।
বাংলাদেশ পরিবেশ সংরক্ষণ আইন ১৯৯৫-এর শব্দদূষণ (নিয়ন্ত্রণ) বিধিমালা, ২০০৬-এ উল্লেখ করা হয়েছে, রাজধানীতে শব্দের গ্রহণযোগ্যতা এলাকাভেদে রাতে সর্বোচ্চ মাত্রা ৪০ ডেসিবেল আর দিনে ৫০। আবাসিক এলাকায় রাতে ৪৫ ও দিনে সর্বোচ্চ ৫৫ ডেসিবেল শব্দ করা যাবে। এ ছাড়া মিশ্র এলাকায় দিনে ৬০ ও রাতে ৫০ ডিসিবেল, বাণিজ্যিক এলাকায় দিনে ৭০ ও রাতে ৬০ ডেসিবেল এবং শিল্প এলাকায় দিনে ৭৫ ও রাতে ৭০ ডেসিবেল পর্যন্ত শব্দ করা যাবে। কেউ আইন অমান্য করলে প্রথমবার অপরাধের জন্য এক মাস কারাদণ্ড বা অনধিক পাঁচ হাজার টাকা অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ড এবং পরবর্তী অপরাধের জন্য ছয় মাস কারাদণ্ড বা অনধিক ১০ হাজার টাকা অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হওয়ার বিধান রয়েছে, কিন্তু বাস্তবে এ আইনের তেমন প্রয়োগ দেখা যায় না।
ডব্লিউএইচও নির্দেশিকা অনুযায়ী, আবাসিক এলাকায় শব্দের আদর্শ মান দিনে ৫৫ এবং রাতে ৪০ ডেসিবেলের মধ্যে থাকা জরুরি। কারণ অতিরিক্ত শব্দ হৃদরোগ, উচ্চ রক্তচাপ এবং মানসিক স্বাস্থ্যের ক্ষতি করে। এ ছাড়াও ওএসএইচএ এবং এএনএসআই অনুযায়ী, একজন সাধারণ সাধারণ মানুষ তার কর্মক্ষেত্রে আট ঘণ্টায় সর্বোচ্চ শব্দমাত্রা ৮৫ ডেসিবেল গ্রহণ করতে পারে। যদি শব্দের মাত্রা এর চেয়েও বেশি হয় তা হলে সুরক্ষামূলক ব্যবস্থা অপরিহার্য। শব্দদূষণ শিশুদের মানসিক বিকাশ বাধাগ্রস্ত করে, বয়স্কদের শ্রবণশক্তি হ্রাস করে এবং পরিবেশ ও বন্যপ্রাণীর ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলে।
চিকিৎসক ও বিশেষজ্ঞরা জানান, এভাবে শব্দদূষণ বাড়তে থাকলে আগামী পাঁচ বছরে ঢাকায় শ্রবণ সমস্যাগ্রস্ত রোগীর সংখ্যা কয়েকগুণ হবে। একটি শহরে শব্দের সর্বোচ্চ মাত্রা ৬০ ডেসিবেল থাকা প্রয়োজন, অথচ ঢাকার অধিকাংশ স্থানে গড় মাত্রা ১০০ ডেসিবেল। শব্দদূষণের ফলে গর্ভবতী মায়েদের বেশি ক্ষতি হয়। কানের সমস্যা হতে পারে, উচ্চ রক্তচাপ ও হার্টবিট বেড়ে যেতে পারে। মা যখন উচ্চ রক্তচাপ, মানসিক অস্থিরতায় ভোগে, ঘুম ঠিকমতো না হলে এর প্রভাব গর্ভস্থ সন্তানের ওপরও পড়ে। এতে শিশুর স্নায়বিক বিকাশ বাধাগ্রস্ত হতে পারে, ওজন কমে যেতে পারে; এমনকি সময়ের আগেই প্রিম্যাচুর শিশুর জন্ম হতে পারে। এ জন্য গর্ভবতী মায়েদের ৮৫ ডেসিবেলের অধিক শব্দের স্থানে না যাওয়ার পরামর্শ দেওয়া হয়।
রাজধানীর শব্দের মানমাত্রা পরিবেশ অধিদফতরের নির্ধারিত মাত্রার চেয়ে অনেক বেশি জানিয়ে বায়ুমণ্ডলীয় দূষণ অধ্যয়ন কেন্দ্রের (ক্যাপস) চেয়ারম্যান ও পরিবেশবিদ অধ্যাপক ড. আহমদ কামরুজ্জমান মজুমদার সময়ের আলোকে বলেন, চার বছর আগে ঢাকার গুরুত্বপূর্ণ এলাকাগুলোতে ২৪ ঘণ্টার মধ্যে ১০ ঘণ্টায় ৭০ ডেসিবেলের বেশি শব্দের মাত্রা পাওয়া যেত। তবে সাম্প্রতিক সময়ে একই স্থানে ১২ ঘণ্টার বেশি সময় ধরে ৭০ ডেসিবেলের বেশি ধারণ করা হয়েছে। অর্থাৎ একই মাত্রায় দুই ঘণ্টা সময় বেড়ে গেছে। এসব এলাকায় ১১০ ডেসিবেল পর্যন্ত লক্ষ করা গেছে। বিশেষ করে ট্রাফিক এলাকায় বেশি দেখা গেছে। তবে ঢাকার ব্যস্ততম জায়গাগুলোতে সবসময় শব্দের মাত্রা বেশি থাকলেও ইদানীং মেট্রোরেল ও এলিভেটেড এক্সেপ্রেস ওয়ের নিচের এলাকার শব্দদূষণ বেড়েছে।
তিনি আরও বলেন, শব্দ দূষণের প্রধান কারণগুলোর মধ্যে গাড়ির হর্ন, নির্মাণকাজ, রাজনৈতিক ও সামাজিক অনুষ্ঠানে মাইক বা মিউজিক বাজানো অন্যতম। এর ফলে সমাজের সর্বস্তরের মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। বিশেষ করে শিশু, বৃদ্ধ, অসুস্থ ব্যক্তিরা বিভিন্নভাবে ক্ষতির সম্মুখীন হয়। শিক্ষার্থীদের পড়াশোনায় মনোযোগ কমে যাওয়ার অন্যতম কারণ শব্দদূষণ। আইন যথাযথ প্রয়োগ করতে পারলে অনেকটাই কমে আসত শব্দদূষণ। নীরব ঘোষিত এলাকাগুলোতেও গড়ে ৭০ থেকে ৮৫ ডেসিবেল পর্যন্ত শব্দ মাত্রা থাকে। অথচ সেখানে শব্দ মাত্রা থাকার কথা ছিল ৪০ থেকে ৫০ ডেসিবেল। নীরব এলাকা ঘোষণা করলেও মানুষকে জানাতে সক্ষম হয়নি কর্তৃপক্ষ। যদি শব্দদূষণকে ট্রাফিক আইনে সংযুক্ত করা হয় হলে ভালোভাবে তদারক করা যাবে। এ ছাড়া পুলিশকে জরিমানা ও দেখভালের দায়িত্ব দেওয়া হলে কাজটা সহজ হয়ে যাবে। তবে এর জন্য সাধারণ মানুষকে সবচেয়ে বেশি সচেতন হতে হবে।
সময়ের আলো/আরএস/