শান্তিনগরের টুইন টাওয়ারের বিপরীতে প্রতিদিন দুই ঘণ্টার জন্য বাজার বসে। বাজারে মাছ থেকে শুরু করে তরিতরকারি, ফলমূল সবই পাওয়া যায়। এখানে যারা পণ্য নিয়ে আসেন বিক্রির জন্য তাদের একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ টাকা দিতে হয়। যারা এই টাকা তোলেন তারা একসময় ছিলেন অত্র এলাকার বিশেষ এক রাজনৈতিক দলের স্থানীয় নেতা। কেউ আবার উপনেতা। প্রতিদিন এখানে প্রায় ২৬ হাজার টাকা ওঠে।
ফ্যাসিস্ট আওয়ামী লীগ সরকার বিদায় নেওয়ার পর অনেকে মনে করেছিল, বাঁচলাম চাঁদাবাজির হাত থেকে-শেষতক তারা রক্ষা পাননি। এক দল নতুন মুখ এসেছে। যাদের রাজনৈতিক পরিচয় রয়েছে। এখন অবশ্য চাঁদার পরিমাণ কিছুটা কমেছে বলে সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে।
প্রতি শুক্রবার মতিঝিল আইডিয়াল স্কুলের সামনে সকাল থেকে রাত অবধি ‘হলিডে মার্কেট’ বসে। এখানে এমন পণ্য নেই যে যা সংসারে দৈনন্দিন জীবনে প্রয়োজন হয় না। সকালে যতটা না ভিড় তার চেয়ে বেশি ভিড় হয় বিকালে। অফিস থেকে ঘরমুখি হওয়া চাকরিজীবীরা হুমড়ি খেয়ে পড়েন দরকারি পণ্যটি কিনতে। এখানে দোকানের সংখ্যা প্রায় দুই হাজার। এখানেও আগে চাঁদাবাজি হতো। লাইন ধরে ধরে চাঁদা তোলা হতো। ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের পর পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে অনেকের ধারণা ছিল, এখন থেকে আর চাঁদাবাজি হবে না। কিন্তু কিছু দিন না যেতেই আবার চাঁদাবাজি শুরু হয়েছে বলে জানিয়েছেন দোকানদার আরিফ। এখানে প্রতি সপ্তাহে প্রায় ২ লাখ টাকা চাঁদা ওঠে। কারা নেয় এই চাঁদা? এই প্রশ্নে তিনি আকারে-ইঙ্গিতে জানান, ‘এলাকার বড় ভাইরা এই টাকা নেন।’ দোকানপ্রতি কতটাকা নেন?
তিনি তার নিজের বিষয়টি জানিয়ে বলেন, আমাকে সকাল থেকে রাত অবধি বসার জন্য ৩০০ থেকে ৪০০ টাকা দিতে হয়। প্রতি শুক্রবার এই হলিডে মার্কেট বসে।
প্রতি বুধবার মেরাদিয়া মাঠে বসে হরেকরকম পণ্যের পসরা। এখানে ঘুরেফিরে মুখচেনা বিক্রেতারা তাদের পসরা নিয়ে বসেন। কিন্তু এখানেও চাঁদা দিতে হয়।
তবে একজন বিক্রেতা অকপটে বলেন, ‘যদি চাঁদা না দেই-তা হলে এখানে বসার কোনো সুযোগ পাব না।’ কারা নেয় এই চাঁদার টাকা।
অনুসন্ধানে দেখা গেছে, এলাকার রাজনৈতিক নেতাদের দাপট এখনও দৃশ্যমান। তবে কোনো কোনো সময় কয়েক হাত ঘুরে এই চাঁদা ওঠে। পরিমাণও কম নয়। মেরাদিয়া হাটে দোকানপ্রতি চাঁদা তোলা হয় ২০০ থেকে ৩০০ টাকা।
কারা চাঁদার মূল ভাগিদার? এই অনুসন্ধানেও বেরিয়ে আসে রাজনৈতিক দলের বিভিন্ন নেতার নাম। অবশ্য্য চাঁদাবাজদের চেহারা ও দলের নাম পরিবর্তন হয়েছে।
সেগুনবাগিচায় সকালে দুই ঘণ্টার জন্য কাঁচাবাজার বসে। আর এই দুই ঘণ্টার বাজারেও চাঁদাবাজি হয়। এখানে কারা চাঁদাবাজি করে তা কেউ নির্দিষ্ট করে বলতে চায় না। তবে অতীতে ফ্যাসিস্ট সরকারের বেশ কয়েকজন ছাত্রলীগ-স্বেচ্ছাসেবক লীগ নেতা চাঁদা তুলতেন।
বায়তুল মোকররমে প্রতি শুক্রবার কসমেটিক থেকে শুরু করে জুতা, স্যান্ডেল, গেঞ্জি, ট্রাউজার, ব্রিফকেস ও গরম কাপড়সহ বিভিন্ন ধরনের পণ্য বিক্রি হয়। এখানে চাঁদাবাজি হলেও তুলনামূলকভাবে কম বলে সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে। কারা চাঁদা তোলে?
এই প্রশ্নের উত্তরে একজন শুধু জানালেন, বায়তুল মোকাররমের এই ফুটপাথে একজন লাইনম্যান আছেন। তিনিই টাকা তোলেন। তিনি কোন রাজনৈতিক দলের নেতা? সে প্রশ্নের উত্তর অবশ্য কেউ রাজি নন।
প্রশাসনের কেন্দ্রবিন্দু সচিবালয় হলো-আবদুল গনি রোডের বিপরীতে। সচিবালয়ের পাশের এ হকারদের কাছ থেকেও চাঁদা তোলা হয়। এখানে বেশিরভাগ ফলের দোকান বসে। ভ্যানে করে হকাররা তাদের পণ্য বিক্রি করেন। স্বল্পপুঁজির এ হকাররাও চাঁদা না দিয়ে ব্যবসা করতে পারেন না। কিন্তু কেউ এ বিষয়ে মুখ খুলতে নারাজ।
মতিঝিল আর দিলকুশা এলাকায় হাজার রকম দোকানের পসরা রয়েছে। দুই লাইনে সারি করে বসে থাকেন হকাররা। এদের কাছ থেকে আগে মোটা অঙ্কের চাঁদা আদায় করতেন বেশ কয়েকজন লাইনম্যান। তবে এখন পুরোনো লাইনম্যান বদলে নতুন লাইনম্যান নিযুক্ত হয়েছেন চাঁদা তোলার জন্য।
নাম না প্রকাশ শর্তে একজন খেজুর বিক্রেতা বলেন, মূলত রাজনৈতিক দলের পরিচয়ে এরা চাঁদা উঠায়। একইভাবে বাংলাদেশ ব্যাংকের সীমানা থেকে একেবারে ইত্তেফাকের মোড় পর্যন্ত দুই পাশের দোকানের চাঁদা তোলার দায়িত্ব এখানকার বেশ কয়েকজন দোকানির। তাদেরও দোকান রয়েছে। এর মধ্যে একজনের চায়ের দোকান রয়েছে। আবার কোনো কোনো অফিসের দারোয়ান-পিয়ন চাঁদা তোলে। এরা মূলত স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানের কর্মচারী। আবার অনেকে কর্মচারী ইউনিয়নের নেতা।
নীলক্ষেতের হকারদের কাছ থেকেও ছাত্রনামধারীরা নিয়মিত চাঁদা তোলেন। নীলক্ষেতের কয়েকজন ফুটপাথের দোকানদার বলেন, এখান থেকে অনেক ছাত্রনামধারীও চাঁদা তোলেন। তবে এরা ছাত্র কি না আমরা নিশ্চিত নই। এরা আসে মূলত দল বেঁধে। একসঙ্গে তারা চাঁদা তোলে।
বাবুবাজার সেতুর কাছে গেলে দেখা যাবে সেখানে সারি সারি কার্ভাড ভ্যান, পিকআপ, সিএনজিচালিত অটোরিকশা সিরিয়াল নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। এদের ভাড়া হওয়ার পরপরই তাদের নির্দিষ্ট পরিমাণ টাকা দিতে হয়। তবে এরা এই টাকাকে চাঁদা বলতে নারাজ। এরা বলে, এটা স্ট্যান্ডের ভাড়া।
মিরপুরের মাজার রোডে ট্রাকচালকদের আনাগোনা বেশি। এদের থেকে প্রতিদিন না হলেও দুয়েকদিন পরপরই চাঁদা তোলা হয়। কারা তোলে এই চাঁদা? এই প্রশ্নে এক ট্রাকচালক মাহতাব বলেন, এলাকার মস্তানরা এই চাঁদা তোলে। আর চাঁদা না দিলে লাঠিসোটা নিয়ে হামলা করে।
চাঁদাবাজির ধরন একেক স্থানে একেক ধরনের। যাত্রাবাড়ী, ধোলাইপাড়, কোতোয়ালি, বাদামতলী, সদরঘাট, মোহাম্মদপুরের বসিলা, বাড্ডার সাঁতারকুল, সূত্রাপুরসহ আরও অনেক এলাকায় চাঁদাবাজি করা হয় একেবারে লাঠিসোটা নিয়ে। কারা এরা? এরা সবাই এলাকার মস্তান নামে পরিচিত। এরা কাউকে মানে না।
গভীর রাতে কাঁচামাল নিয়ে গুলিস্তান হয়ে পুরান ঢাকার শ্যাম বাজারের আড়তে যাচ্ছিলেন লিটন বেপারি। পিকআপ ভ্যান চালিয়ে তিনি যখন সুরিটোলা মডেল সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সামনে পৌঁছান তখনই একদল লোক লাঠিসোটা নিয়ে সেই পিকআপের সামনে হাজির। তাকে টাকা দিতেই হবে। তা না হলে পিকআপ ছাড়বে না। বাধ্য হয়ে লিটন বেপারিকে ৫০০ টাকা দিতে হয়।
কারওয়ান বাজারের আড়তদার শাজাহান মিয়া শনিবার সময়ের আলোকে বলেন-প্রতিদিন আমার কাছ থেকে যে পরিমাণ চাঁদা নেওয়া হয় তার থেকে যদি মুক্তি পেতাম তা হলে তরিতরকারির দাম কিছুটা কমিয়ে রাখা যেত। কিন্তু ব্যবসার খাতিরে আমাকে চাঁদার টাকা হিসেবে ধরেই তবে পণ্য বিক্রি করতে হয়।
প্রায় সময়ই সরকারের নীতি নির্ধারকরা বলছেন, চাঁদার জন্য অনেক সময় নিত্যপণ্য বেশি দামে বিক্রি করতে বাধ্য হন ব্যবসায়ীরা। বেশ কিছু দিন আগে ঢাকা চেম্বারের এক অনুষ্ঠানে এক ব্যবসায়ী বলেন, নিত্যপণ্যের ঊর্ধ্বগতির অনেক কারণের অন্যতম হচ্ছে চাঁদাবাজি।
তিনি আরও বলেছেন, ঘাটে ঘাটে চাঁদাবাজির কারণে নিত্যপণ্যের দাম কিছুতেই কমানো সম্ভব হয় না।
এ বিষয়ে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের অতিরিক্ত কমিশনার মো. ইসরাইল হাওলাদার বলেন, চাঁদাবাজদের তালিকা করা হচ্ছে। কোথায় কোথায় হচ্ছে তা এখনও ওভাবে বলা যাবে না। তবে কাঁচাবাজার থেকে শুরু করে এলাকাভিত্তিক সব জায়গায় চাঁদাবাজি হচ্ছে। মোট কথা সব ক্ষেত্রেই যে চাঁদাবাজি যে হচ্ছে তা অনায়াসে বলা যায়।
চাঁদাবাজি আসলে কি? এই শব্দ অনেক আগে থেকেই প্রচলিত। অর্থনীতিবিদদের মতে, চাঁদাবাজি হচ্ছে, জবরদস্তির মাধ্যমে সুবিধা পাওয়ার অভ্যাস। আবার চাঁদাবাজিকে কখনো কখনো ‘প্রটেকশন র্যাকেট’ বলা হয়। আবার চাঁদাবাজিকে ঝাঁকুনিও বলা হয়। বিদেশে চাঁদাবাজিকে একটি সাধারণ আইনের অপরাধ হিসেবে ধরা হয়। যুক্তরাষ্ট্রের ফেডারেল আইনে উল্লেখ আছে, বলপ্রয়োগ কিংবা অস্ত্রের ব্যবহার না করেও চাঁদাবাজি করা যেতে পারে।
সময়ের আলো/আরএস/