অর্থনৈতিকভাবে বাংলাদেশ মেডিকেল ট্যুরিজমের শিকারে পরিণত হয়েছে। আশি ও নব্বইয়ের দশকে বাংলাদেশের কিছুসংখ্যক অভিজাত শ্রেণির লোক চিকিৎসার জন্য বাইরে যেত। কিন্তু বর্তমানে চিকিৎসার জন্য বাইরে যাওয়া জোয়ারে পরিণত হয়েছে। তাতে করে মেডিকেল ট্যুরিজমের মাধ্যমে বাংলাদেশ প্রতি বছর বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার হারাচ্ছে, যার বেশিরভাগই ভারতের দ্রুত-বর্ধনশীল স্বাস্থ্যখাতকে শক্তিশালী করছে বলে জানিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা।
তারা বলছেন, দেশে ২০২৩ সালে ৪ লাখ ৪৯ হাজার ৫৭০ জন বাংলাদেশি স্বাস্থ্যসেবার জন্য বিদেশ ভ্রমণ করেছেন। যা আগের বছরের তুলনায় ৪৮ শতাংশ বেশি। আর এবার ৫১ দশমিক ৫ শতাংশ পর্যটক ভারতে গিয়েছেন চিকিৎসা নিতে। এটা নিছক পরিসংখ্যান নয়; বরং এটি আমাদের স্বাস্থ্যসেবা খাত নাগরিকদের চাহিদার সঙ্গে কতটুকু তাল মিলাতে পারছে তার ইঙ্গিত দেয়। এ অবস্থায় দেশের স্বাস্থ্যখাতের সংস্কার, অবকাঠামো উন্নয়ন ও প্রযুক্তিতে বিনোয়োগের মাধ্যমে বাংলাদেশকে মেডিকেল হাব হিসেবে গড়ে তুলার দাবি জানিয়েছেন তারা।
শনিবার (২১ ডিসেম্বর) রাজধানীর সিরডাপ অডিটোরিয়ামে বাংলাদেশ প্রাইভেট মেডিকেল কলেজ অ্যাসোসিয়েশন (বিপিএমসিএ) আয়োজিত ‘চিকিৎসা সেবায় বিদেশমুখীতা : আমাদের উত্তরণের উপায়’ শীর্ষক গোলটেবিল বৈঠকে তারা এসব কথা বলেন।
সভায় মূল প্রতিবেদন উপস্থাপনা করেন আইসিডিডিআরবির বিজ্ঞানী ডা. আহমেদ এহসানুর রহমান। তিনি বলেন, বাংলাশে থেকে বিশ্বে চিকিৎসা নিতে যাওয়া ৩২২ পর্যটকের সমীক্ষায় জানা যায়, ৫১ দশমিক ৫ শতাংশ গিয়েছেন ভারতে, ২০ শতাংশ সিঙ্গাপুর, ২০ শতাংশ থাইল্যান্ডে ও অন্যান্য দেশে ১০ শতাংশ। এদের মধ্যে ৫২ দশমিক ৫ শতাংশ বিদেশ যান শুধু মাত্র সাধারণ স্বাস্থ্য পরীক্ষা-নিরীক্ষার জন্য। এছাড়া সার্জারির জন্য ২৭ দশমিক ৬ শতাংশ, ক্যান্সার/ টিউমার চিকিৎসায় ৬ দশমিক ৫ শতাংশ। দাঁতের চিকিৎসার জন্য ২ দশমিক ২ শতাংশ। এসব ব্যক্তিদের ১০ দশমিক ৬ শতাংশ চিকিৎসার জন্য গিয়ে বিভিন্ন ধরনের প্রসাধণী ক্রয় করেন।
১১৯৬ পর্যটকের ওপর করা আরেক সমীক্ষায় দেখা গেছে, সবচেয়ে বেশি বিশ্বে চিকিৎসার জন্য যাচ্ছেন হার্টের সমস্যা নিয়ে। যা মোট পর্যটকের ১২ দশমিক ২০ শতাংশ, চোখের চিকিৎসার জন্য ১০ দশমিক ৫৩ শতাংশ, কিডনির সমস্যা নিয়ে ৮ শতাংশ, বিভিন্ন ধরনের ক্যান্সার নিয়ে ৭ দশমিক ৫২ শতাংশ, ৭ দশমিক ৫২ শতাংশ ফ্র্যাকচার, ৬ দশমিক ৯৩ হাড়ের সমস্যা, ৬ দশমিক ৪৩ শতাংশ পেটের সমস্যা। এছাড়া লিভার, কিডনি, ডায়াবেটিস, গাইনি সমস্যা নিয়েও রোগী বিদেশে যাচ্ছেন।
১২৭৮ পর্যটকের ওপর করা আরেক সমীক্ষায় দেখা গেছে, ৪৮৬ জন বা ৩৮ শতাংশ পর্যটকের দেশের বাইরে থাকার সময়কাল গড়ে এক সপ্তাহ। ৩৫ শতাংশ দুই সপ্তাহ। এক মাস থাকেন ৮ শতাংশ, দুই মাস ৫ শতাংশ, তিন মাস ৩ শতাংশ ও ছয় মাস অবস্থান করেন ২ শতাংশ পর্যটক।
১১৮১ পর্যটকের ওপর আরেকটি সমীক্ষায় দেখা গেছে, ২৫ শতাংশ বা প্রতি চারজন পর্যটকের একজনের পেশায় ব্যবসায়ী। এরপর ১২ দশমিক ৫৩ শতাংশ বেসরকারি চাকরিজীবী, ১২ শতাংশ দিনমুজুর, ৯ দশমিক ৪৮ শতাংশ সরকারি চারকীজীবী, ৭ দশমক ৫৩ শতাংশ শিক্ষক। এছাড়া এ তালিকায় সাংবাদিক, চিকিৎসক, পুলিশ, ছাত্রও রয়েছেন।
অনুষ্ঠানে স্বাস্থ্য শিক্ষা অধিদফতরে মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. নাজমুল হোসেন বলেন, চিকিৎসার জন্য বিদেশমুখীতার কারণ হলো আস্থাহীনতা। এর সাথে কিছু ক্ষেত্রে অদক্ষতাও দায়ী। এছাড়া আমাদের ব্যবহার ও অযত্নের কারণে রোগীরা বিদেশি ছুটে। তবে আমরাও (রোগীরা) অধ্যাপক ও খ্যাতিমান ডাক্তার ছাড়া চিকিৎসক দেখাই না, এমনকি আশা করি ১৫ মিনিট ধরে রোগী দেখবে।
তিনি বলেন, স্বাস্থ্যখাতে বেসরকারি বিনিময় কম। বর্তমানে চিকিৎসায় যে সংকট তৈরি হয়েছে এটি উত্তরণে বেসরকারি বিনিয়োগ বাড়াতে হবে। প্রতিবেশি দেশ চিকিৎসা বন্ধ করেছে, এটাকে সুযোগ হিসেবে নিয়ে চিকিৎসা সক্ষমতা বাড়াতে হবে।
জাতীয় প্রেস ক্লাবের সভাপতি হাসান হাফিজ বলেন, ভারত ভিসা বন্ধ করে আমাদের উপকার করেছে। আমাদের সক্ষমতা বাড়তে সহযোগিতা করেছে। সরকারের উচিত স্বাস্থ্যসেবা অবকাঠামো খাতে উল্লেখযোগ্য বিনিয়োগ করা, সর্বাধুনিক টেকনোলজি সমৃদ্ধ করে বিশেষায়িত স্বাস্থ্যকেন্দ্রগুলোর উন্নয়নে অগ্রাধিকার দেওয়া।
স্বাস্থ্য শিক্ষা ও পরিবার কল্যাণ বিভাগের সচিব ডা. মো. সারোয়ার বারী বলেন, রোগীদের বিদেশগামীতার কারণে প্রতি বছর ৪ থেকে ৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলার দেশের বাইরে যাচ্ছে। চিকিৎসায় বিদেশমুখীতা কমাতে দেশে রোগ শনাক্তে খরচ কমিয়ে আনতে হবে। এছাড়া দেশে বিশেষায়িত সেবা বাড়াতে আগামী জুনের মধ্যে বাংলাদেশ সুপার স্পেশালাইজড হাসপাতালটি পুরোদমে চালু করা হবে।
অনুষ্ঠানে বক্তারা বলেন, মেডিকেল ট্যুরিজম বা চিকিৎসা পর্যটন বা বিদেশে গিয়ে চিকিৎসাসেবা নেওয়া একটি দেশের স্বাস্থ্যখাতের সেক্টরের ব্যর্থতা প্রকাশ করে। মেডিকেল ট্যুরিজম যদিও প্রাচীন গ্রীসের নিরাময় মন্দির এবং রোমান সাম্রাজ্যের খনিজসমৃদ্ধ পানিতে গোসল থেকে শুরু হয়েছে। আজ চিকিৎসা পর্যটন হলো একটি ১০০ বিলিয়ন ডলারের বৈশ্বিক ব্যবসা। যা অর্থনীতিকে পুনর্র্নিমাণ করে এবং স্বাস্থ্যসেবাকে নতুন করে সংজ্ঞায়িত করে। ভারত, থাইল্যান্ড, তুরস্ক এবং সিঙ্গাপুরের মতো দেশগুলো পাওয়ার হাউস হিসাবে আবির্ভূত হয়েছে, যা পশ্চিমা খরচের ভগ্নাংশে অত্যাধুনিক চিকিৎসা প্রদান করে।
বাংলাদেশ পরিস্থিতি তুলে ধরে তারা বলেন, মেডিকেল ট্যুরিজম কেবল অন্য একটি দেশে সেবা নেওয়া নয়, এটি একটি দেশের স্বাস্থ্যসেবা ব্যবস্থার সক্ষমতা এবং দুর্বলতার প্রতিফলন। ধনী ব্যক্তিরা হয়তো সিঙ্গাপুরের চকচকে হাসপাতাল বা থাইল্যান্ডের মেডিকেল স্পা-এ যেতে পারেন, কিন্তু সিংহভাগ ভারতেই যায়। অর্ধেকেরও বেশি বাংলাদেশি চিকিৎসা পর্যটকরা ভারতীয় হাসপাতালে যান, তাদের সান্নিধ্য, সামর্থ্য এবং শ্রেষ্ঠত্বের খ্যাতির কারণে।এই চিকিৎসার জন্য বিদেশে গমনের অর্থনৈতিক প্রভাব যতটা তীব্র, ততটাই উদ্বেগের।
গোলটেবিল বৈঠকে বক্তারা আন্তর্জাতিক বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে সহযোগিতা বৃদ্ধি করে অঙ্গ প্রতিস্থাপন, ক্যান্সার চিকিৎসা ও উন্নত সার্জারির মতো উচ্চমূল্যের চিকিৎসায় আর্থিক সহায়তা প্রদানের জন্য সরকারকে আহ্বান জানান।
অনুষ্ঠানে বক্তব্য রাখেন বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যান্ড ডেন্টাল কাউন্সিলের অধ্যাপক ডা. মো. জাফরুল্লাহ চৌধুরী, বিপিএমসিএ সাধারণ সম্পাদক অধ্যাপক ডা. মো. মোয়াজ্জেম হোসেন, অধ্যাপক ডা. মো. হুমায়ুন কবির তালুকদার প্রমুখ।
সময়ের আলো/এম