দুই বছরের ইমাম মাহদি। ক্যানোলা লাগানো হাতে মায়ের কোলে মেঝেতে বসে শ্বাসকষ্টের নেবুলাইজার নিচ্ছে। ভোলা সদর থেকে আসা তার মা মৌসুমি আকতার বলেন, পনেরো দিন আগে ঠান্ডা-কাঁশি থেকে জ্বর শুরু হয়। পরে ভোলা সদর হাসপাতালে ভর্তি করাই। সেখানে এক সপ্তাহ থাকার পরও কোনো উন্নতি হয়নি।
পরে ঢাকায় নিয়ে আসি। এখনও অবস্থা খুব ভালো না। শ্বাসকষ্টের পাশাপাশি বমি ও পাতলা পায়খানা হচ্ছে। আবার মেঝেতে থাকার কারণে জ্বরও কমছে না। রোগী বেশি থাকায় সিটও পাচ্ছি না। কি যে করি। বাচ্চাকে নিয়ে চরম দুশ্চিন্তায় আছি।
শুধু ইমাম মাহদির মা নন, এমন দুশ্চিন্তায় কপালে ভাঁজ পড়েছে ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালের শিশু ওয়ার্ডে চিকিৎসা নিতে আসা বেশিরভাগ শিশুর মায়েরই। একই অবস্থা স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজ মিটফোর্ড হাসপাতালেও।
শুক্রবার এই দুই হাসপাতালে সরেজমিনে দেখা গেছে, মা-বাবাদের কেউ আসছেন ৬ মাসের শিশুকে নিয়ে, কেউ এসেছেন নবজাতক নিয়ে। দেশের বিভিন্ন প্রান্তের এসব রোগীর বেশিরভাগই ভুগছে ঠান্ডাজনিত নানা রোগে। স্বাভাবিকের চেয়ে কয়েকগুণেরও বেশি রোগী ভর্তি থাকায় বারান্দা ও মেঝেতে চিকিৎসা নিতে হচ্ছে তাদের।
রোগী ও স্বজনদের অভিযোগ, প্রচণ্ড শীতের কারণে চরম সমস্যায় পড়তে হচ্ছে তাদের। কাঙ্ক্ষিত সেবা না পেয়ে এবং বাচ্চাদের করুণ অবস্থা দেখে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠায় দিন কাটছে তাদের।
স্বাস্থ্য অধিদফতরে তথ্য মতে, গত দেড় মাসে শীতজনিত নানা রোগ, শ্বাসতন্ত্রের সংক্রমণ এবং ডায়রিয়া আক্রান্ত হয়ে এখন পর্যন্ত দেশজুড়ে ৩৮ জনের মৃত্যু হয়েছে। আর আক্রান্তের সংখ্যা এক লাখ ছাড়িয়েছে।
স্বাস্থ্য অধিদফতরের হেলথ ইমার্জেন্সি অপারেশন সেন্টার ও কন্ট্রোল রুমের তথ্য অনুযায়ী, চলতি বছরের গত ১ নভেম্বর থেকে ১৯ ডিসেম্বর পর্যন্ত (এআরআই বা অ্যাকিউট রেসপিরেটরি ইনফেকশন) সর্দি-কাঁশি, গলাব্যথা ব্রঙ্কাইটিস, ব্রঙ্কুইলাইটিস ও নিউমোনিয়ায় ৩৭ জনের মৃত্যু হয়েছে এবং আক্রান্ত হয়েছে ৩২ হাজার ৪৩৭ জন। আক্রান্তের শীর্ষে রয়েছে ময়মনসিংহ বিভাগ। আর সারা দেশে ডায়রিয়ায় মৃত্যু একজনের এবং আক্রান্ত হয়েছে ৭৩ হাজারেরও বেশি মানুষ।
বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা বলছেন, শীতের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে নানা রোগব্যাধি।
একইসঙ্গে হাসপাতালগুলোতেচাপ বেড়েছে কয়েকগুণ। কারণ আবহাওয়া পরিবর্তনের সঙ্গে বিভিন্ন ধরনের রোগব্যাধি দেখা দেয়। এসব রোগের মধ্যে রয়েছে সর্দি-কাঁশি, নিউমোনিয়া, ডায়রিয়া, হাঁপানি, টনসিলাটাইসিস, ব্রঙ্কুইলাইটিস, সাইনোসাইটিস, বাত, আর্থ্রাইটিস ও চামড়ার শুষ্কতা। এই সময়ে শিশু ও বয়স্করা চরম ঝুঁকিতে থাকে। তাই এসব রোগ থেকে সুরক্ষায় শীত এড়িয়ে চলতে হবে। আর ঋতু পরিবর্তনের সময় অভিভাবকদের সচেতন হওয়ার পাশাপাশি জ্বর- সর্দিতে আক্রান্তদের ডেঙ্গু পরীক্ষার পরামর্শ দিয়েছেন তারা।
ঢামেকের শিশু ওয়ার্ডে ২০৭, ২০৮ এবং ২১০ এই তিনটি ওয়ার্ড ঘুরে দেখা গেছে, শীত বাড়ায় নিউমোনিয়া ও জ্বরসহ ঠান্ডাজনিত রোগীর সংখ্যা বেশি। হাসপাতালের শয্যার তুলনায় কয়েকগুণ বেশি রোগী ভর্তি রয়েছেন। অনেকেই শয্যা না থাকায় বাধ্য হয়েই মেঝেতে চিকিৎসা নিচ্ছেন। হাসপাতালের মেঝেতে ও বারান্দায় পাটি, কাঁথা-বালিশ বিছিয়ে বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত ও তাদের স্বজনসহ অসংখ্য মানুষ শুয়ে- বসে রয়েছেন।বেশি রোগী থাকায় হিমশিম খাচ্ছেন নার্স ও চিকিৎসকরা।
হাসপাতালের রোগীদের সঙ্গে আলাপচারিতায় উঠে আসে ভোগান্তির নানা চিত্র। তাদের অভিযোগ, হাসপাতালে কাঙ্ক্ষিত সেবা মিলছে না। ২১০ নম্বর ওয়ার্ডে দেখা যায় ১৬টি শয্যার বিপরীতে তিনগুণ বেশি রোগী ভর্তি রয়েছে। এই ওয়ার্ডে কথা হয় আবদুল আলিমের সঙ্গে।
তিনি বলেন, কুমিল্লা থেকে ৫ বছর বয়সি মেয়ে ইসরাত জাহানকে নিয়ে এখানে ৭ ডিসেম্বর থেকে ভর্তি রয়েছি। হাসপাতাল থেকে আগেই জানানো হয়েছিল শয্যা নেই। তাই শ্বাসকষ্ট নিয়ে বাধ্য হয়ে মেঝেতেই আছি। দিনের বেলায় থাকতে পারলেও রাতে ঠান্ডার কারণে খুব কষ্ট হয়, বাচ্চা ঘুমাতে পারে না। তার বাচ্চার অসুখ ভালো হওয়ার বদলে ঠান্ডায় থাকার কারণে আরও বাড়ছে বলেও জানান তিনি।
২০৭ নম্বর ওয়ার্ডেও দেখা গেছে, ১৮টি শয্যার বিপরীতে কয়েকগুণ বেশি রোগী ভর্তি। এক সিটের মধ্যে দুই শিশুকে ভর্তি করে চিকিৎসা নিতে দেখা গেছে। মেঝেতেও পাটি, কাঁথা-বালিশ বিছিয়ে বাচ্চাদের নিয়ে শুয়ে-বসে আছেন অভিভাবকরা। আর রোগী ও স্বজনদের ভিড়ে পা ফেলার জায়গা নেই।
এই রুমে মেঝেতে ১১ মাসের শিশু সিনথিয়াকে নিয়ে আছেন মা মিনারা বেগম। তার বাসা রাজধানীর আলু বাজারে।
তিনি সময়ের আলোকে বলেন, ১২ দিন ধরে এখানে ভর্তি। বাচ্চার অবস্থা খুবই খারাপ। কিছুই খায় না। শুধু কান্নাকাটি করে। প্রচণ্ড শীতের কারণে খিচুনি দিয়ে ওঠে। আবার মেঝেতে থাকার কারণে চরম
সমস্যায় পড়তে হচ্ছে। বাচ্চার এই করুণ অবস্থা দেখছি আর চোখের পানি ফেলছি, কিন্তু কিছুই করতে পারছি না।
২০৮ নম্বর ওয়ার্ডে সাইফুল ইসমলাম নামে এক রোগীর স্বজন অভিযোগ করে বলেন, বারবার সিট চেয়েও পাচ্ছি না। ডাক্তাররা এক সিটে দুজনকে রাখতে বলেছিল। ওখানে খুব সমস্যা হয়। তাই বাধ্য হয়ে মেঝেতে চিকিৎসা নিচ্ছি। এই হাসপাতালে বিভিন্ন পরীক্ষা- নিরীক্ষা থেকে শুরু করে প্রতি পদে পদে ভোগান্তি পোহাতে হয়।
মিটফোর্ড হাসপাতাল ঘুরে দেখা গেছে, নিউমোনিয়া, সর্দি-কাঁশিসহ ডায়রিয়া-বমি, নানা ধরনের ভাইরাসজনিত আক্রান্ত ভর্তিচ্ছু রোগী সিট না পেয়ে হাসপাতালের বারান্দা ও মেঝেতে ঠাসাঠাসি করে চিকিৎসা নিচ্ছেন। ধারণক্ষমতার বেশি রোগী আসায় তাদের চিকিৎসা দিতে হিমশিম খেতে হচ্ছে চিকিৎসকসহ সংশ্লিষ্টদের।
হাসপাতালে দায়িত্বপ্রাপ্ত এক চিকিসৎক বলেন, শীতের প্রকোপ বেড়ে যাওয়ায় হাসপাতালে শীতজনিত রোগে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা বাড়ছে। আর শয্যা ফাঁকা না থাকায় বারান্দায় রোগীদের চিকিৎসা সেবা দেওয়া হচ্ছে। কারণ দিনে শত শত রোগী আসে সবাইকে তো শয্যা দেওয়া সম্ভব নয়।
শীতজনিত রোগের প্রকোপ বৃদ্ধি প্রসঙ্গে ঢামেক হাসপাতালে শিশু বিভাগের চিকিৎসক রুবায়েত ফেরদৌস সময়ের আলোকে বলেন, শীতের কারণে স্বাভাবিক সময়ের চেয়ে রোগীর সংখ্যা অনেক বেশি। বিশেষ করে বহির্বিভাগে রোগীর সংখ্যা কয়েকগুণ বেড়েছে। আমরা যেসব রোগীর অবস্থা খুব ক্রিটিক্যাল তাদেরকেই শুধু ভর্তি করি। এখানে যারা ভর্তি রয়েছেন তাদের বেশির ভাগই সর্দি-জ্বর, ডায়রিয়া ও নিউমোনিয়ার রোগী। এ ছাড়াও অনেকের শ্বাসকষ্ট রয়েছে। আবার অনেকের হাঁপানি, খিচুনি রয়েছে।
ঠান্ডার এই সময়ে বিভিন্ন রোগব্যাধি থেকে বিশেষ করে শিশু ও বয়স্কদের রক্ষা করতে হলে সতর্কতা অবলম্বন করার পরামর্শ দিয়ে তিনি বলেন, গরম পানি পান করাতে হবে। আর অসুস্থ হলে তাজা ফলমূলের রস, শাকসবজি ও পুষ্টিকর খাবার বেশি করে খাওয়াতে হবে।
শীতের বিভিন্ন রোগ-বালাই থেকে সুরক্ষার বিষয়ে ঢামেকের শিশু বিভাগের অধ্যাপক ডা. লুৎফন নেছা সময়ের আলোকে বলেন, শীতের এ সময়ে প্রতি বছরই শীতকালীন বিভিন্ন ধরনের রোগব্যাধিতে মানুষ আক্রান্ত হয়। বিশেষ করে আবহাওয়ার পরিবর্তন, বায়ুদূষণের কারণে শিশু ও বয়স্ক মানুষ বেশি আক্রান্ত হয়ে থাকে। তাই শীতের এ সময়ে শিশু ও বৃদ্ধদের অ্যাজমা, হাঁপানি, ব্রঙ্কুইলাইটিস ও নিউমোনিয়া থেকে বাঁচাতে পর্যাপ্ত গরম কাপড়সহ হাত মোজা, পা মোজা পরিয়ে রাখতে হবে। বাইরে বের হলে পর্যাপ্ত শীতের কাপড় পরতে হবে। আর সর্দি- জ্বর হলে চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া উচিত। চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়া কোনো ধরনের ওষুধ খাওয়া মোটেই উচিত নয়।
সময়ের আলো/আরএস/