ইকোনমিস্টের এবারের ‘বর্ষসেরা দেশ’ খেতাব নিজেদের করে নিয়েছে জুলাই অভ্যুত্থান-পরবর্তী বাংলাদেশ। প্রভাবশালী ওই ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম বলছে, ছাত্রদের নেতৃত্বে স্বৈরাচার হাসিনা সরকার উৎখাত করার কারণেই বাংলাদেশকে এমন স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে।
জুলাই-আগস্ট গণআন্দোলনের অংশীজনেরা বলছেন, এই আন্তর্জাতিক স্বীকৃতিকে তারা জনগণের কাছে ফিরিয়ে দেবেন। আর স্বীকৃতি ধরে রাখতে বাংলাদেশ প্রশ্নে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার বিকল্প দেখছেন না বিশ্লেষকরা। এই স্বীকৃতির ভেতরে সরকারের জন্য শঙ্কার বার্তা রয়েছে বলেও মত তাদের।
দ্য ইকোনমিস্ট বলেছে, আমাদের বিজয়ী বাংলাদেশ, যে দেশ একজন স্বৈরাচারীকে উৎখাত করেছে। গত আগস্টে শিক্ষার্থীদের নেতৃত্বে রাজপথে বিক্ষোভের মুখে ১৫ বছর ধরে সাড়ে ১৭ কোটি মানুষের দেশ শাসন করা শেখ হাসিনাকে ক্ষমতাচ্যুত করা হয়। রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের কারণে বাংলাদেশকে বর্ষসেরার স্বীকৃতি দিয়ে দ্য ইকনোমিস্ট লিখেছে, ‘আমাদের বিজয়ী বাংলাদেশ, তারাও এক স্বৈরশাসককে উৎখাত করেছে। গত আগস্টে ছাত্রদের নেতৃত্বে রাজপথের আন্দোলনে শেখ হাসিনাকে ক্ষমতাচ্যুত করা হয়। তিনি সাড়ে ১৭ কোটি মানুষের দেশটিকে ১৫ বছর ধরে শাসন করেন। দেশের স্বাধীনতার একজন নায়কের কন্যা হাসিনা। একসময় দ্রুত অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির নেতৃত্ব দিয়েছেন। কিন্তু পরে দমন-পীড়ন শুরু করেন, নির্বাচনে জালিয়াতি করেন, বিরোধীদের কারাগারে ভরেন এবং আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে বিক্ষোভকারীদের ওপর গুলি চালানোর নির্দেশ দেন। তার আমলে বিরাট অঙ্কের অর্থ আত্মসাৎ করা হয়েছে।’
ছাত্র-জনতার হাত ধরে এই অর্জন এসেছে বলে মনে করেন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের মুখ্য সংগঠক আবদুল হান্নান মাসউদ। তিনি সময়ের আলোকে বলেন, মানুষ সাহস দেখিয়ে বিপ্লব ঘটিয়েছে। সেই বিপ্লবী সত্তাকে স্বীকৃতি দিয়েছে। আমরা সবাই মিলে ফ্যাসিবাদ পালাতে বাধ্য করেছি বলে এত বড় অর্জন এসেছে। ইকোনমিস্ট তা উল্লেখও করেছে। আমি মনে করি এই অর্জন বিপ্লবের মান বাড়িয়েছে। জুলাই-আগস্টের বিপ্লবকে বিশ্ব স্বীকৃতি দিচ্ছে। নানা কারণে নিঃসন্দেহে এর গুরুত্ব অনেক। এটাকে ধরে রাখতে হলে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার বিকল্প নেই। নতুন বাংলাদেশ বিনির্মাণে ভেদাভেদ ভুলে কাজ করতে হবে। গণতান্ত্রিক, দুর্নীতিমুক্ত ও ভবিষ্যৎ ফ্যাসিবাদমুক্ত বাংলাদেশ গঠনে এই অর্জনকে ধরে রাখতে হবে। ষড়যন্ত্র ও শত্রুপক্ষ নিয়ে সতর্ক থাকতে হবে।
এক যুগের বেশি রক্তক্ষয়ী গৃহযুদ্ধে সিরিয়ায় মৃত্যু হয়েছে ৬ লাখের মতো মানুষের। স্বৈরশাসনের পতনের দাবিতে শুরু হওয়া সেই দীর্ঘ গৃহযুদ্ধের শেষমেশ অবসান ঘটেছে। স্বৈরশাসক বাশার আল-আসাদকে হটিয়ে দেশটির শাসনভার গ্রহণ করেছেন বিদ্রোহীরা। সেই সিরিয়াকেই টপকে চব্বিশের (২০২৪ সাল) বর্ষসেরা দেশের মুকুট বাংলাদেশের। বর্ষসেরা দেশের তালিকাসংবলিত ইকোনমিস্টের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সেরা ধনী, সবচেয়ে সুখী বা নৈতিকভাবে শ্রেষ্ঠ স্থানের অধিকারী এমন সব বিবেচনায় নয়; বরং গত ১২ মাসে সবচেয়ে বেশি উন্নতি করেছে, সেই বিচারে সেরা দেশ নির্বাচন করা হয়েছে।
জাতীয় নাগরিক কমিটির মুখপাত্র সামান্তা শারমিন সময়ের আলোকে বলেন, অতীতে আমাদের গণতান্ত্রিক সব অর্জনকে ছিনিয়ে নেওয়া হয়েছে। এবার তরুণদের জাগরণ ঘটেছে। যাতে কেউ জনগণের অর্জনকে ছিনিয়ে নিতে না পারে। সম্মিলিত অর্জন কেড়ে নিয়ে যাতে কেউ এক ব্যক্তির বাক্সবন্দি করতে না পারে। এই অর্জন আপামর জনগণের। আমরা অর্জনকে জনগণের কাছে ফিরিয়ে দেব। তিনি বলেন, এই স্বীকৃতি ধরে রাখতে হলে বাংলাদেশের প্রশ্নে দলমত নির্বিশেষে ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করতে হবে। আমাদের লড়াই জারি রাখতে হবে। হয়তো সব আকাক্সক্ষা সব দুর্ভোগ পূরণ করা সম্ভব নয়। তবে গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ গঠনে একসঙ্গে পথচলা অব্যাহত রাখতে হবে।
ইকোনমিস্টের প্রতিবেদনে বলা হয়, বাংলাদেশে ক্ষমতার পালাবদলকালে প্রতিহিংসামূলক সহিংসতার ইতিহাস আছে। দেশের প্রধান বিরোধী দল বিএনপি ‘অর্থলোলুপ’। ‘ইসলামি চরমপন্থা’ একটি হুমকি। তবে এখন পর্যন্ত অন্তর্বর্তীকালীন পরিবর্তন আশাব্যঞ্জক। শান্তিতে নোবেলজয়ী অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে একটি অস্থায়ী সরকার গঠিত হয়েছে। এটি ছাত্র, সেনাবাহিনী, ব্যবসায়ী ও নাগরিক সমাজের সমর্থন পেয়েছে। এ সরকার আইনশৃঙ্খলা পুনঃপ্রতিষ্ঠা করেছে ও অর্থনীতিকে স্থিতিশীল করেছে।
জাহাঙ্গীর নগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের অধ্যাপক মোহাম্মদ গোলাম রব্বানী সময়ের আলোকে বলেন, এটা অবশ্যই ছাত্র-জনতার বিপ্লবের স্বীকৃতি। গণঅভ্যুত্থান নিঃসন্দেহে বিশ্বের বড় ঘটনার একটি। ১৫ বছরের অপশাসন থেকে দেশ ও জাতি মুক্তি পেয়েছে। যার ফলে বাকস্বাধীনতা ফিরে এসেছে। আমি মনে করি, আন্তর্জাতিক এই স্বীকৃতি বড় ‘সিগনেচার’ হিসেবে কাজ করবে। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কাছে বাংলাদেশ নিয়ে আগ্রহ তৈরি করবে। তারা বুঝে নেবেন বাংলাদেশ এখন গণতন্ত্রের পথে আছে। স্থিতিশীলতা বজায় রয়েছে।
প্রতিবেদনে আসা চরমপন্থার ঝুঁকির প্রসঙ্গে এই সমাজ বিশ্লেষক বলেন, চরমপন্থা সব দেশেই আছে। হ্যাঁ আমাদের দেশেও এ নিয়ে উদ্বেগ রয়েছে। কিন্তু বাস্তবে তার চেয়ে বেশি বলা হচ্ছে। সবসময় যা বলার চেষ্টা হতো বিশেষ করে ভারত বলত শেখ হাসিনা সরকার না থাকলে জঙ্গিবাদের উত্থান হবে। ইতিহাসের শিক্ষক হিসেবে আমি মনে করি, বাংলাদেশের অধিকাংশ মানুষ ধর্মপ্রাণ, কিন্তু ধর্মান্ধ নয়। কিছু ধর্মান্ধ থাকতে পারে। সেটা সবখানেই আছে। দিনশেষে ধর্মীয় চরমপন্থা জয়ী হবে না।
দ্য ইকোনমিস্ট আরও বলেছে, ‘অন্তর্বর্তী সরকারকে ২০২৫ সালে ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক ঠিক করা দরকার। কবে নির্বাচন হবে তাও নির্ধারণ করতে হবে। আদালতগুলোর নিরপেক্ষভাবে কাজ করা ও বিরোধী দলগুলোর সংগঠিত হওয়ার সময় পাওয়ার বিষয় প্রথমেই নিশ্চিত করতে হবে। এর কোনোটি সহজ হবে না। তবে, একজন অত্যাচারী শাসককে হটানো এবং আরও উদার সরকার গঠনের পথে এগোনোর জন্য বাংলাদেশ আমাদের এ বছরের সেরা দেশ।’
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃবিজ্ঞান বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক রাশেদা রওনক খান সময়ের আলোকে বলেন, ইকোনমিস্ট ইতিবাচক কাজের জন্য অভিনন্দন জানিয়েছে। এখন বহির্বিশ্বের সঙ্গে সম্পর্কটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এই স্বীকৃতির মাধ্যমে সরকার তা কাজে লাগাতে পারে। তবে স্বীকৃতিতে আত্মতুষ্টি হওয়া যাবে না। সচেতনভাবে তা গ্রহণ করতে হবে। কেননা ইকোনমিস্ট তার প্রতিবেদনে চরমপন্থার ইঙ্গিত পেয়েছে। নদীতে যেমন শৈবাল রয়েছে তেমনি ময়লা থাকে। সুতরাং বিষয়টি মাথায় রেখে দেশ পরিচালনা করতে হবে। সরকারের জন্য ওই প্রতিবেদনে গুরুত্বপূর্ণ সতর্কবার্তাও রয়েছে।
রাজনৈতিক বিশ্লেষক অধ্যাপক ড. নুরুল আমিন বেপারী সময়ের আলোকে বলেন, দুনিয়ার সব স্বীকৃতিই ভালো। এই স্বীকৃতি সরকারের জন্য ইতিবাচক। এটা সরকারের স্থিতিশীলতার ক্ষেত্রে বড় ভূমিকা পালন করবে।
সময়ের আলো/আরএস/