‘আমিতো কিছুই দেখতে পারছি না, আমাকে কেউ একটু সাহায্য করবেন?’ এ কথা বলেই জ্ঞান হারিয়ে রাস্তায় পড়ে যাওয়ার পর আর কিছু জানে না বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে পুলিশের গুলিতে দুই চোখ হারানো নবম শ্রেণির ছাত্র হিমেল। বাসস।
হিমেলের স্বপ্ন ছিল লেখাপড়া শেষ করে ভালো একটা চাকরি করে পরিবারের সচ্ছলতা ফিরিয়ে আনার। সেই আশায় বুক বেঁধে প্রবল আগ্রহ নিয়ে লেখাপড়াও চালিয়ে যাচ্ছিল মেধাবী ছাত্র হিমেল (১৭)। পুলিশের ছোড়া অসংখ্য গুলি তার স্বপ্ন ভেঙে চুরমার করে দিয়েছে। দুটি চোখ হারিয়ে অচল অবস্থায় জীবনযাপন করছে এখন সে। বর্তমানে চিকিৎসার খরচ জোগাড় করতে গিয়ে চোখেমুখে যেন অন্ধকার দেখছে তার পরিবার।
গণঅভ্যুত্থানের সেই উত্তাল সময়ে গত ৪ আগস্ট বেলা ৩টার দিকে ছাত্র-জনতার সঙ্গে হিমেলও মির্জাপুর গোড়াই হাইওয়ে থানার সামনে মহাসড়কে অবস্থান নেয়। এই সময় পুলিশ হঠাৎ গুলি ছুড়তে শুরু করে। প্রথমে হিমেলের শরীরে রাবার বুলেট এসে লাগে। এরপরও সে সামনের দিকে এগিয়ে যেতে থাকলে তার পুরো মুখ মাথাসহ শরীরের বিভিন্ন জায়গায় প্রায় দেড় শতাধিক ছররা গুলি লাগে। এ সময় তার ৫টি দাঁতও ভেঙে যায়। জ্ঞান হারিয়ে পিচঢালা রাস্তায় লুটিয়ে পড়ে হিমেল। পরে স্থানীয় লোকজন অ্যাম্বুলেন্সে করে তাকে টাঙ্গাইল জেনারেল হাসপাতালে ভর্তি করে।
পারিবারিক সূত্রে জানা যায়, টাঙ্গাইল শহর থেকে ৪০ কিলোমিটার দূরে গোড়াই ইউনিয়নের লালবাড়ি গ্রামের আফাজদ্দিন ও নাসিমা বেগম দম্পতির ছোট ছেলে হিমেল। বড় ছেলে জনি (২৪) এসএসসি পাস করার পর আর লেখাপড়া করেনি। সংসারে হাল ধরতে বর্তমানে তিনি একটি সুতার মিলে শ্রমিক হিসেবে কাজ করছেন। তার উপার্জিত অর্থে এখন হিমেলদের সংসার চলে।
সম্প্রতি সরেজমিনে হিমেলদের বাড়ি গিয়ে দেখা যায়, বাড়ির সামনে বন্ধুকে সঙ্গে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন তিনি। তাকে সঙ্গে নিয়ে বাড়িতে ঢুকতেই চোখে পড়ল তিন শতাংশ জমির ওপর কাঁচা ২টি দোচালা টিনের ঘরের। সেখানেই এই পরিবারের বসবাস। সাংবাদিক পরিচয় পেয়ে হিমেলের মা নাছিমা বেগম (৪২) ঘর থেকে বেরিয়ে আসেন। এই প্রতিবেদককে একটি চেয়ার এনে বসতে দেন। এরপর বিস্তারিত কথা হয় তাদের সঙ্গে।
সে সময় হিমেলের মা নাছিমা বেগম (৪২) জানান, সেদিন বিকালে প্রথমে হিমেলকে টাঙ্গাইল সদর হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। অবস্থার অবনতি হলে রাতেই তাকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে হিমেলের চোখের অপারেশন করানো হয়। এরপর ডাক্তারদের নিবিড় পর্যবেক্ষণে একমাস চিকিৎসাসেবা দেওয়া হয় হিমেলকে। পরে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের চিকিৎসকগণ তাকে আবার সিএমএইচ হাসপাতালে পাঠান। সেখান থেকে আবার জাতীয় চক্ষু ইনস্টিটিউট হাসপাতালে পাঠানো হয় হিমেলকে।সেখানে এক সপ্তাহ চিকিৎসা নেন তিনি।
চোখের চিকিৎসকগণ পরীক্ষা-নিরীক্ষা করার পর আমাদের জানিয়ে দিয়েছেন, গুলিতে তার দুটি চোখই অন্ধ হয়ে গেছে। তবে বাম চোখে মাঝে মাঝে আলোর ঝলকানি দেখতে পাওয়ায় দেশের বাইরে নিয়ে চিকিৎসা করালে কিছুটা ভালো হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। এতে অনেক টাকার প্রয়োজন। এত অর্থ কোথায় পাবে এই চিন্তায় পরিবারটি এখন দিশাহারা।
ঢাকাতে দীর্ঘদিন চিকিৎসার পর গত ৬ অক্টোবর হিমেলকে নিয়ে বাড়িতে ফিরেছেন তার মা নাসিমা বেগম।
নাসিমা বেগম আরও বলেন, হিমেলের আজ নবম শ্রেণিতে ফাইনাল পরীক্ষা দেওয়ার কথা ছিল। আমার স্বপ্ন নিমেষেই শেষ হয়ে গেল। আগামী বছর এসএসসি পরীক্ষায় হিমেল আর অংশগ্রহণ করতে পারবে না। এ কথা মনে পড়লে চোখের পানি আর ধরে রাখতে পারি না।
ডাক্তার বলেছেন, চোখে বুলেট লাগার কারণে দৃষ্টিশক্তি হারিয়ে ফেলেছে হিমেল। হিমেলের চিকিৎসার জন্য সহায়তা দরকার। আমি দরিদ্র মানুষ, কীভাবে সংসার চালাব আর ছেলের চিকিৎসা খরচ মেটাব। এই নিয়ে দুশ্চিন্তায় আছি। একদিকে হিমেলের চিকিৎসার খরচ, অন্যদিকে সংসার চালাতে গিয়ে হিমশিম খাচ্ছি।
সরকার ও শহিদ স্মৃতি ফাউন্ডেশনের সাধারণ সম্পাদক সারজিস আলমের কাছে তাদের আবেদন হিমেলকে যেন উন্নত চিকিৎসার জন্য দেশের বাইরে নেওয়ার ব্যবস্থা করা হয়।
আর্থিকভাবে কী রকম সাহায্য পেয়েছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়ক সারজিস আলম ১ লাখ টাকা, উপজেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে ২০ হাজার টাকা এবং বিএনপির পক্ষ থেকে ২০ হাজার টাকা অনুদান পেয়েছি। কিন্তু সেই টাকা ফুরিয়ে গেছে। এখন আর চিকিৎসা করাতে পারছি না।
অভাব অনটনের সংসারে হিমেলের চিকিৎসা করাতে না পেরে মানবেতর জীবনযাপন করছে হিমেলের পরিবারটি।
সে দিনের দুঃসহ স্মৃতির কথা উল্লেখ করে দুচোখ হারানো হিমেল বলে, গত ৪ আগস্ট বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের এক কর্মসূচিতে টাঙ্গাইলের মির্জাপুর উপজেলার গোড়াই হাইওয়ে থানার সামনের মহাসড়কে অবস্থান করছিলাম। এ সময় পুলিশ হঠাৎ ছররা গুলি ছুড়তে থাকে। মাথায় ৩৫০টির মতো ছররা গুলি লাগে। গুলি লাগে চোখেও। এই আঘাতেই দৃষ্টিশক্তি হারিয়েছি। শরীরেও অসংখ্য গুলি লেগেছে। হঠাৎ করেই যেন অন্ধকার হয়ে গেছে আমার জীবন। দিন-রাত এখন আমার কাছে সমান। রাতে ঠিকমতো ঘুম হয় না। দিন রাত চুলকানি ও যন্ত্রণায় কাতরাই।
অন্ধ হিমেল বলে, আমার তো কোনো দোষ ছিল না। আমি গরিব পরিবারের সন্তান। পুলিশ অন্যায়ভাবে আমার দিকে গুলি ছুড়েছে। পুলিশের গুলিতে দুটি চোখ হারিয়েছি। আমার ডান চোখ পুরো অন্ধ হয়ে গেছে। তবে বাম চোখে মাঝে মাঝে আলোর ঝলকানি দেয়। ডাক্তার বলেছে দেশের বাইরে গিয়ে চিকিৎসা করাতে পারলে আল্লাহ চাইলে কিছুটা আলো ফিরে আসতে পারে। এ জন্য ১০ থেকে ১৫ লাখ টাকার প্রয়োজন। আমার দরিদ্র পরিবারের পক্ষে এ খরচ বহন করা সম্ভব নয়।
সে আরও জানায়, ঢাকায় চিকিৎসাধীন অবস্থায় জুলাই শহিদ স্মৃতি ফাউন্ডেশন-এর সাধারণ সম্পাদক সারজিস আলমসহ অন্যান্য সমন্বয়কের সঙ্গে কথা হয়েছিল। তারা বলেছিলেন, উন্নত চিকিৎসার জন্য তাকে বিদেশে পাঠানো হবে। তো সেটাও তো হচ্ছে না।
হিমেল বলে, আমার আর কোনো ইচ্ছা নেই, শুধু দৃষ্টিশক্তি ফিরে পেয়ে পৃথিবীর আলো দেখতে চাই।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের টাঙ্গাইলের অন্যতম সমন্বয়ক আল আমিন বলেন, ‘আমরা হিমেলের বিষয়টি জানার পরে আর্থিকভাবে সহযোগিতার ব্যবস্থা করে দিয়েছি। চোখের চিকিৎসার জন্য হিমেলকে দেশের বাইরে পাঠানোর ব্যাপারে কেন্দ্রীয় সমন্বয়ক সারজিস আলমের সঙ্গে আমরা যোগাযোগ চালিয়ে যাচ্ছি।’
তিনি আরও বলেন, ছাত্র-জনতা জীবন দিয়ে স্বৈরাচার সরকারের পতন ঘটিয়েছে। দেশে যেন আর কখনো এরকম ‘ফ্যাসিস্ট’ সরকার না আসে। আমরা চাই দেশের মানুষ নিরাপদ থাক। সবার অধিকার নিশ্চিত হোক। বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার জুলাই গণঅভ্যুত্থানে আহত ও নিহতদের পাশে থাকবেÑএটাই আমার একমাত্র প্রত্যাশা।
গোড়াই উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক শিরিন খাতুন বলেন, হিমেল গোড়াই উচ্চ বিদ্যালয়ে ৯ম শ্রেণিতে পড়াশোনা করত। ছাত্র হিসেবে ছিল অত্যন্ত মেধাবী। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে অংশ নিয়ে দুটি চোখের দৃষ্টিশক্তি হারিয়েছে। হিমেলের চোখের উন্নতর চিকিৎসার জন্য দেশের বাইরে নেওয়া প্রয়োজন। কিন্তু তার দরিদ্র পরিবারের পক্ষে চিকিৎসার ব্যয় বহন করা সম্ভব নয়। সরকার যদি দেশের বাইরে পাঠিয়ে হিমেলকে উন্নত চিকিৎসা প্রদানে সহযোগিতা করে, অন্তত একটি চোখও তার ভালো হয়। তাহলে সে তার বাবা-মার বোঝা হয়ে থাকবে না। নিজে চলে ফিরে খেতে পারবে।
এ ব্যাপারে মির্জাপুর উপজেলা নির্বাহী অফিসার এবিএম আরিফুল ইসলাম বাসসকে বলেন, আমি নতুন যোগদান করেছি। এসে যতটুকু জানতে পেরেছি হিমেলের পরিবারটি খুবই অসহায় ও দরিদ্র।
গণ-অভ্যুত্থানের পর হিমেলের পরিবারকে আর্থিকভাবে কিছু সহযোগিতা দেওয়া হয়েছে। শুধু হিমেল নয়, এ উপজেলায় যারা আহত হয়েছে তাদের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ হচ্ছে আমাদের। সরকারি কোন অনুদান এলে আবারও তাকে সহযোগিতা করা হবে।
টাঙ্গাইলের জেলা প্রশাসক শরীফা হক বলেন, শুধু হিমেল নয়, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে টাঙ্গাইলে যারা গুরুতর আহত অবস্থায় আছে প্রশাসনের পক্ষ থেকে তাদের চিকিৎসাব্যয়ে যতটুকু সম্ভব সাহায্য ও সহযোগিতা করা হয়েছে। ভবিষ্যতেও সব ধরনের সহযোগিতা অব্যাহত থাকবে।
সময়ের আলো/আরএস/