সাপ্তাহিক ছুটিতে জনসমুদ্রে পরিণত হয়েছে বিশ্বের একমাত্র দীর্ঘতম সমুদ্র শহর কক্সবাজার। পর্যটকদের অনেকেই হোটেলে রুম না পেয়ে লাগেজ ও ব্যাগ নিয়ে আস্তানা গেড়েছেন বালিয়াড়িতে। শহরের পাঁচ শতাধিক হোটেল-মোটেলের কোথাও কোনো খালি কক্ষ নেই।
শুক্রবার সকাল থেকে সৈকতের বিভিন্ন পয়েন্ট ঘুরে দেখা গেছে, বালিয়াড়িতে ভিড় করেছে অসংখ্য পর্যটক। বালিয়াড়ির সামনে নীল জলরাশিতেও মানুষের ভিড়। সবাই মেতেছেন বাঁধভাঙা আনন্দ-উল্লাসে। সৈকতে ১০ কিলোমিটার এলাকাজুড়ে রয়েছে শুধু মানুষ আর মানুষ।
অন্যদিকে কক্সবাজারের সচেতন মহল দাবি করেছে কিছু অসাধু ব্যবসায়ী কৃত্রিম সংকট তৈরি করে হোটেলভাড়া দ্বিগুণ করেছে। প্রশাসনের অভিযান না থাকায় গলাকাটা বাণিজ্য করার সুযোগ পেয়েছে বলে অভিযোগ তোলা হয়েছে ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে।
মহান বিজয় দিবসের ছুটিকে কেন্দ্র করে গত সোমবার থেকে এমন পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে। দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে ছুটে আসা পর্যটকরা সাগরের নীল জলরাশি আর বিস্তৃত বালিয়াড়ির সৈকতে ঘুরছেন পরিবারের সদস্যদের নিয়ে। সৈকতে বসানো কিটকটের কোনোটিই খালি নেই। ঘুরতে আসা পর্যটকদের কেউ ঘোড়ায়, কেউ বিচ বাইকে, কেউ বিস্তৃত সৈকতে ঘোরাঘুরি করে, আবার কেউ সাগরজলে জেটস্কিতে চড়ে আনন্দ করছেন। যান্ত্রিক জীবনের অবসাদ দূর করতেই তারা এ সাগর পাড়ে ছুটে এসেছেন।
সংশ্লিষ্ট সূত্র বলছে, থার্টিফার্স্ট নাইট পর্যন্ত শতভাগ রুম অগ্রিম বুকিং করা হয়েছে। আগামী ১০ দিনে সৈকতে অন্তত ১৫ থেকে ২০ লাখ পর্যটকের সমাগম ঘটবে বলে মালিকরা মনে করছেন।
সৈকতে স্নানরত পর্যটকদের নিরাপত্তায় দায়িত্ব পালনকারী সি সেইফ লাইফ গার্ডের সহকারী ইনচার্জ মোহাম্মদ শুক্কুর জানান, গত রোববার থেকে কক্সবাজারে বাড়তে থাকে পর্যটকদের আগমন। হাজার হাজার পর্যটকের পদভারে মুখরিত সৈকতের বিস্তৃত এলাকা। এ বিপুল সংখ্যক পর্যটককে নিরাপত্তা দিতে হিমশিম খেতে হচ্ছে নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যদের।
কক্সবাজার আবাসিক হোটেল-মোটেল গেস্ট হাউস মালিক সমিতির সভাপতি আবুল কাসেম সিকদার জানান, কক্সবাজারের সাড়ে ৫ শতাধিক আবাসিক হোটেলে শতভাগ বুকিং রয়েছে। সে হিসেবে কক্সবাজারে গড়ে দুই লাখের অধিক পর্যটক অবস্থান করছেন। যা জানুয়ারির প্রথম সপ্তাহ পর্যন্ত থাকবে।
তিনি জানান, পর্যটকদের সেবা নিশ্চিত করতে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। বিশেষ করে যেন কোনো পর্যটকের কাছ থেকে অতিরিক্ত ভাড়া আদায় করে হয়রানি করা না হয় তার জন্য নির্দেশনা রয়েছে। তারপরও কিছু কিছু ক্ষেত্রে অতিরিক্ত ভাড়া আদায়ের অভিযোগ রয়েছে পর্যটকদের।
শফিক জামী নামের এক পর্যটক বলেন, ভোরে পরিবারের সাত সদস্য নিয়ে কক্সবাজারে ভ্রমণে এসেছি। এখন পর্যন্ত রুম পাইনি। কটেজে দুটি রুম পেয়েছি-সেটি মানসম্মত না। উল্টো প্রতি রাত ১০ হাজার টাকা করে চাচ্ছে। এখন সৈকতে পা ভিজিয়ে চলে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছি।
শরীফ সৈকত নামে আরেক পর্যটক বলেন, বাস থেকে নেমে এখনও রুম পাইনি। রুম খুঁজছি। কিন্তু এখনও সৈকতে পা রাখার সুযোগ হয়নি।
ঢাকার মিরপুর থেকে আসা আজমী ফারুক নামে এক স্কুল শিক্ষক জানান, বিজয় দিবসের ছুটিতে সপরিবারে কক্সবাজার ভ্রমণে এসেছেন। মেরিন ড্রাইভ, দরিয়ানগর, হিমছড়ি, পাথুরে সৈকত ইনানী-পাটুয়ারটেক ঘুরেছেন। প্রকৃতি উপভোগে ক্ষণিকের জন্য ভুলে গেছেন যান্ত্রিক জীবনের কোলাহল।
সাবেক বন কর্মকর্তা শাহী আলম জানান, তাদের কয়েক বন্ধু মিলে সপরিবারে কক্সবাজার ভ্রমণে এসেছেন। তারা দুদিন কক্সবাজার থেকে সেন্টমার্টিন ভ্রমণে যাবেন। সাগর ভ্রমণে এসে বারবার মুগ্ধ হন তারা। সন্তানদের পরীক্ষা শেষে সমুদ্র ভ্রমণে আসবেন-এমন পূর্ব পরিকল্পনা ছিল যশোরের ব্যবসায়ী নিশাত রহমানের। তিনি এক সপ্তাহ পর্যন্ত কক্সবাজার ভ্রমণে থাকতে চান।
তিনি বলেন, সমুদ্রসৈকত ছাড়া মেরিন ড্রাইভ হয়ে টেকনাফ সমুদ্রসৈকত পর্যন্ত যাব।
সি ক্রুজ অপারেটর ওনার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের সাধারণ সম্পাদক হোসাইন ইসলাম বাহাদুর জানান, ১ ডিসেম্বর থেকে কক্সবাজার শহর থেকে সেন্টমার্টিন দ্বীপে পর্যটকবাহী জাহাজ চলাচল শুরু হয়েছে। ইতিমধ্যে ৮টি জাহাজ চলাচলের জন্য অনুমতি পেয়েছে। কিন্তু সরকারি সিদ্ধান্ত মতে ২ হাজারের বেশি পর্যটক নেওয়া যায় না। ফলে কখনো ৩টি কখনো ২টি জাহাজ দ্বীপে যাচ্ছে। বিজয় দিবস ঘিরে পর্যটকের চাপ রয়েছে। ফলে তাদের হিমশিম খেতে হচ্ছে। অনেক পর্যটক ইচ্ছা থাকার পরও দ্বীপ ভ্রমণে যেতে পারছেন না।
তিনি বলেন, এসব বিবেচনা করে সেন্টমার্টিনে পর্যটকের সংখ্যা বাড়ানো উচিত ছিল। ট্যুরিস্ট পুলিশের কক্সবাজার জোনের জ্যেষ্ঠ সহকারী পুলিশ সুপার আবুল কালাম সময়ের আলোকে বলেন, তিন স্তরের নিরাপত্তা বলয়ে পুলিশ সদস্যরা পর্যটকদের নিরাপত্তার পাশাপাশি হয়রানি রোধে কাজ করছেন। বিভিন্ন পয়েন্টে অভিযোগ বক্স স্থাপন করা হয়েছে। অভিযোগ এলে দ্রুত ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে।
তিনি জানান, ট্যুরিস্ট পুলিশের পক্ষে ইনানি ও পাটুয়ারটেকের সৈকত, সেন্টমার্টিন ও হিমছড়ি ঝর্ণাসহ অন্যান্য স্পটেও দায়িত্ব পালন করে নিরাপত্তা নিশ্চিত করা হচ্ছে।
কক্সবাজার পুলিশ সুপার মো. রহমত উল্লাহ বলেন, আগত পর্যটকদের নিরাপত্তায় কাজ করছেন ট্যুরিস্ট পুলিশের সদস্যরা। পাশাপাশি সাদা পোশাকের গোয়েন্দা নজরদারিও বহাল রাখা হয়েছে।
কক্সবাজার পর্যটক সেলের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট তানভীর হোসাইন বলেন, হেল্প ডেস্ক চালু রয়েছে। কোনো পর্যটক হয়রানি হলে অভিযোগ পেলে আমরা ব্যবস্থা নিচ্ছি।
জেলা প্রশাসক মুহাম্মদ সালাহ উদ্দিন সময়ের আলোকে বলেন, সব ধরনের নিরাপত্তা জোরদার করা হয়েছে। আগত পর্যটকদের হয়রানির অভিযোগ পেলে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
সময়ের আলো/আরএস/