ই-পেপার শুক্রবার ২০ ডিসেম্বর ২০২৪
শুক্রবার ২০ ডিসেম্বর ২০২৪
ই-পেপার

শুক্রবার ২০ ডিসেম্বর ২০২৪

জলে আগুন জ্বালানোর কবি
প্রকাশ: শুক্রবার, ২০ ডিসেম্বর, ২০২৪, ১:৪৪ এএম  (ভিজিট : ১৭৮)
আমাদের ছেড়ে চলে গেছেন দেশবরেণ্য কবি হেলাল হাফিজ। বয়স হয়েছিল ৭৬ বছর। জন্ম ১৯৪৮ সালের ৭ অক্টোবর, নেত্রকোনায়; মৃত্যু ১৩ ডিসেম্বর, ঢাকায়। কবিতাকেই নিয়েছিলেন জীবনের অন্বিষ্ট করে। অকৃতদার এই কবি বোহেমিয়ান জীবনযাপন করতেন। আমার সঙ্গে দেখা হয়েছে কদাচিৎ। তখন কী আন্তরিকভাবে কুশল জানতে চাইতেন, ভালো লাগত।

আমি যখন চট্টগ্রাম থেকে ঢাকা আসি ১৯৭৭ সালে, তখন থেকেই পরিচয়। দীর্ঘকাল বলা চলে। আমরা তাঁর অনুজ সাহিত্যসাথি। সম্পর্ক ছিল বন্ধুর মতন। শেষ দেখা প্রেস ক্লাবে বছরখানেক আগে। বলেছিলেন, ‘শরীর ভালো যায় না’। আমাদের মতো দেশে সত্তর-আশির মাঝামাঝি বয়স যাদের, তাদের সুস্থ বলা কঠিন। আমাদের খাদ্যাভ্যাস, আমাদের খাদ্য-নিরাপত্তা তো আর ইউরোপ আমেরিকা বা জাপানের মতো নয়-যে বিনা রোগে শতবর্ষী হব!  খাদ্যপ্রাপ্তির চেয়েও খাদ্য-নিরাপত্তা এক বড় চ্যালেঞ্জ আমাদের। সে যাক, এর মধ্যেই আমাদের বাস, কবির বাস। কবি যদি বোহেমিয়ান হন, জীবন সম্পর্কে উদাসীন থাকেন-তা হলে শারীরিক ঝুঁকি আরও বেশি থাকে। কথাটা আসল এজন্য যে, খবরে প্রকাশ-কবিকে মৃত অবস্থায় পাওয়া গেছে বাথরুমে, তাই। মৃত্যু তো অনিবার্য সত্য। যারা অনেকের সঙ্গে থাকেন তাদেরও সেরকম মৃত্যু হতেই পারে। যেহেতু কবি একা-কক্ষে থাকতেন-হোটেলে/হোস্টেলে, তাই বিষয়টি অনুরাগীদের, প্রিয়জনদের ব্যথিত করে।  

ষাটের দশকের দ্বিতীয়ার্ধ্বে, রাজনীতির উত্তাল সময়ে কাব্যভুবনে হেলাল হাফিজের আগমন। আমাদের এই অঞ্চলের কবিতার যাত্রা চল্লিশের কবিদের হাতে হলেও পঞ্চাশেই তার উজ্জ্বল বিকাশ। আর বড় ব্যাপ্তি ষাটের দশকে। ষাটের কবিগণ কবিতার এই যাত্রাকে আরও বেগবান করেছে। সময়টা ছিল রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক পুনর্জাগরণের গুরুত্বপূর্ণ সময়। পাকিস্তানের সেনাশাসনের কাল। সঙ্গত কারণেই এই সময়টা রাজনীতি-শাসিত হয়ে পড়েছিল। বাঙালি জাতীয়তাবাদের ও স্বাধিকার আদায়ের প্রশ্নে কবি-চৈতন্য জাতীয় পরিবেশের অনুগামী হয়ে উঠেছিল। একই সঙ্গে আন্তর্জাতিক শিল্পজ্ঞান ও রূপান্তরের ভেতর দিয়ে এই সময়ের কবিতা বিশ্ব কবিতার অনুগামী হয়ে উঠেছিল। সেই কাল-পরিসরে কাব্যসাহিত্যে হেলাল হাফিজের আগমন। তখন অগ্রজ হিসেবে পেয়েছিলেন হাসান হাফিজুর রহমান, শামসুর রাহমান, সৈয়দ শামসুল হক, আল মাহমুদ, ফজল শাহাবুদ্দিন, আলাউদ্দিন আল আজাদ, সাইয়িদ আতীকুল্লাহ্, শহীদ কাদরী, রফিক আজাদ, আবদুল মান্নান সৈয়দ, সিকদার আমিনুল হক, নির্মলেন্দু গুণ, মহাদেব সাহা প্রমুখ উজ্জ্বল কবিদের। আর সময়ের সহযাত্রী হিসেবে পেয়েছিলেন আবুল হাসান, ফরহাদ মজহার, সানাউল হক খান, সায্যাদ কাদির, হুমায়ুন আজাদ, মুহম্মদ নূরুল হুদা, অসীম সাহা, জাহিদুল হক প্রমুখকে। তাঁরা সমবেতভাবে বাংলাদেশের কবিতাকে বাংলা কবিতার নেতৃত্বের জায়গায় নিয়ে গেছেন। সেই পর্বের একজন নন্দিত কণ্ঠ কবি হেলাল হাফিজও। তাঁর ঘোষণা অনুযায়ী তিনি জলে আগুন জ্বালানোর প্রত্যয় নিয়ে মাঠে নেমেছিলেন। 

কবিতায় সচল থাকলেও হেলাল হাফিজ ছিলেন স্বল্পপ্রজ। প্রথম কাব্যগ্রন্থ বেরিয়েছে বেশ দেরিতে ১৯৮৬ সালে। নাম রেখেছিলেন  ‘যে জলে আগুন জ্বলে’। গ্রন্থটি পাঠকের মাঝে চমক সৃষ্টি করেছিল। তাঁর ঘোষণা অনুযায়ী এই কাব্যোচ্চারণ এমন প্রখর যে, সে আগুনের রেখ জলেও নিবে যাওয়ার নয়! কাব্যগ্রন্থটি প্রকাশের পর তাঁর খ্যাতি বিপুলভাবে ছড়িয়ে পড়ে। দীর্ঘকাল পর ২০১২ সালে বের হয় দ্বিতীয় কাব্যগ্রন্থ ‘কবিতা একাত্তর’; এর কয়েক বছর পর ২০১৯ সালে বের হয় তৃতীয় কাব্যগ্রন্থ ‘বেদনাকে বলেছি কেঁদো না’। এই তিনটিই তাঁর সম্বল। কবিতার ইতিহাসে তো আছেই, আমাদের কবিতায়ও এমন বিখ্যাত কবি আছেন যাঁদের কবিতার সংখ্যা বেশি নয়। আমাদের শহীদ কাদরী কিংবা আবুল হাসানের কথা এ প্রসঙ্গে বলা যায়। তাঁদেরও কাব্যগ্রন্থ তিনটি করে। গ্রন্থসংখ্যা কখনো সাহিত্য-বিবেচনায় গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হয়ে ওঠে না-তা বলাই বাহুল্য। খ্যাতিমান সেই নন্দিত কবিদের কাতারে হেলাল হাফিজও একজন।   

হেলাল হাফিজ পাঠকপ্রিয়তা পেয়েছেন প্রথম থেকেই। নেত্রকোনার মাটি হয়তো কাব্যচাষের জন্য বেশ উর্বর। নেত্রকোনা থেকে-আসা কবি নির্মলেন্দু গুণ আগেই সে-স্বাক্ষর রেখেছেন। অসামান্য জনপ্রিয়তা নিয়ে কাব্যভুবন দাপিয়ে বেড়িয়েছেন, এবং এখনো তেমনি আছেন। একই মাটির ফসল তাঁর অনুজ হেলাল হাফিজও পেয়েছেন অসামান্য জনপ্রিয়তা। হেলালের একটি কবিতা ‘নিষিদ্ধ সম্পাদকীয়‘ তরুণদের মুখে মুখে ফেরে এখনও। কবিতাটির দুটি চরণ- 
‘এখন যৌবন যার মিছিলে যাবার তার শ্রেষ্ঠ সময়
এখন যৌবন যার যুদ্ধে যাবার তার শ্রেষ্ঠ সময়।’

প্রবাদতুল্য চরণ দুটিতে জন-আকাক্সক্ষার রূপ প্রতিফলিত হয়েছে। যুবসমাজের আবেগকে সার্থকভাবে ধরতে পেরেছেন কবি। এর আর-একটা দিক হলো শব্দের বিন্যাস ও উচ্চারণের স্বতঃস্ফূর্ততা। চিরকালীন কবিতার ক্ষেত্রে এটি অন্যতম প্রধান শর্ত। কবিতার উচ্চারণে কবি কোনো জটিলতা রাখেননি। সহজ বাক্য দিয়ে প্রক্ষেপণ করেছেন বাণের মতো শলাকা। আরেকটি একটি ছোট কবিতা ‘রাখালের বাঁশি’। 

এই যে উচ্চারণ-তাতে চমক আছে, গভীর মাহাত্ম্য আছে। পুরো পৃথিবীটা যেন জটিল হয়ে উঠেছে, ভারী হয়ে মাথার ওপর নেমে এসেছে। এই জটিল সময় থেকে উত্তরণ চেয়েছেন কবি। কম কথায় অনেক বলার ইঙ্গিত পাওয়া যায় এই কবিতায়ও। অতিকথন কবিতায় কম গ্রাহ্য হয়। কবিকে এ থেকে বেরিয়ে আসতে হয়। আত্মশাসনে একসময় তা হয়ে যায়। হেলাল হাফিজের সেই সচেতনতা ছিল শুরু থেকেই। তাঁর কবিতার পটভূমি-যাপিত জীবন, ফেলে-আসা জীবনস্মৃতি, মাটি ও মানুষ। দেশের প্রতি, মাটি ও মানুষের প্রতি কবির যে-দায় তা ব্যক্ত হয়েছে তাঁর কবিতায়। প্রেমের উচ্চারণেও তিনি সমান পারঙ্গম। আজ তিনি আমাদেরকে ছেড়ে গেছেন বটে, কিন্তু অনুরাগীদের হাতে দিয়ে গেছেন কবিতার অমোঘ চরণগুলো। তাঁর কবিতায় জীবনবাস্তবতা এত প্রখর যে, পাঠককে তা চুম্বকের মতো টেনে রাখতে সক্ষম-এখানেই একজন কবির সফলতা। আমরা বলি-কবির বোধ পাঠকের বোধকে জাগিয়ে দেয়, চেতনাকে শাণিত করে। হেলাল হাফিজ এক্ষেত্রে সফল কবি। 

ব্যক্তি জীবনে হেলাল হাফিজ ছিলেন শান্ত ধীর-স্থির স্বভাবের মানুষ। তবে আড্ডায় আসর-জমানোর গুণ ছিল তাঁর। কবিতার মতোই কম কথার মধ্যে বেশি বলার কৌশল ছিল বরাবরই। প্রবলভাবে তিনি সমাজ ও রাজনীতি সচেতন মানুষ। ভাবুক স্বভাবের অন্তরালে নিজেকে গুটিয়ে রাখতেন। পোষাকে চলায়-বলায়ও এর প্রকাশ লক্ষ্যযোগ্য ছিলো। কিন্তু কবিতা-অন্ত মানুষ যেভাবে নিজের মধ্যে বেড়ে ওঠে, তেমনই। কবিরা সমাজে ও ঘরে অনেকের মধ্যে থেকেও মূলত একা বাস করেন। অনেকটা নিজের মধ্যে নিজকে গুটিয়ে রাখা অর্থাৎ বহুর মধ্যে থেকেও অনেকটা সময় একা, নিজের মধ্যে বাস করা! 
কবিতাকে আমরা সৃষ্টি বলে বিবেচনা করি। এই সৃষ্টি অন্তর্গত চেতনার উদ্ভাস। কবিদের কাছে বক্তব্য প্রকাশের এক শক্তিশালী মাধ্যম ‘কবিতা‘। তবে প্রকাশিত কবিতায় যে-বক্তব্য প্রকাশিত হয় তা বক্তব্যের ইঙ্গিতমাত্র, আগুনের ফুলকিস্বরূপ। হেলাল হাফিজের ‘ফেরিওয়ালা‘ কবিতায় তেমন ইঙ্গিত স্পষ্ট । 
এই কবিতায় সমাজের ক্রমবিলীয়মান সত্তাকে চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছেন কবি। 

সমাজের যখন ক্ষত হয়, তা ধীরে ধীরে একসময় যাপিত সময়কেও সংক্রমিত করে। কবিরা সমাজের পথ-নির্দেশক, যুগের প্রতিনিধি। মঙ্গলাকাংখাই কবির আরাধ্য বস্তু। সমাজের মঙ্গল মানে দেশের মঙ্গল, পৃথিবীর মঙ্গল। কল্যাণ সমাজ প্রতিষ্ঠার জন্য কবিরা একেকজন স্বপ্নদ্রষ্টা। দেশ-কাল-স্থান তাঁদেরকে সীমায়িত করতে পারে না। সমাজের ও জগতের কল্যাণের পথই কবির পথ। কবি হেলাল হাফিজের উচ্চারণ সুন্দর সমাজ-বিনির্মাণের ইঙ্গিতবহ উচ্চারণ-যা সর্বজনীন, চিরকালীন।

সময়ের আলো/আরএস/ 




https://www.shomoyeralo.com/ad/1698385080Google-News-Update.jpg

সর্বশেষ সংবাদ

সর্বাধিক পঠিত


ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক : সৈয়দ শাহনেওয়াজ করিম, আমিন মোহাম্মদ মিডিয়া কমিউনিকেশন লিমিটেড এর পক্ষে প্রকাশক গাজী আহমেদ উল্লাহ। নাসির ট্রেড সেন্টার, ৮৯, বীর উত্তম সি আর দত্ত সড়ক (সোনারগাঁও রোড), বাংলামোটর, ঢাকা।
ফোন : +৮৮-০২-৯৬৩২৩৬৮-৭৪, ফ্যাক্স : +৮৮-০২-৯৬৩২৩৭৫ | ই-মেইল : shomoyeralo@gmail.com
close