বিশ্ব ইজতেমার ময়দান এখন ফাঁকা। ইজতেমার দখল নিয়ে মাওলানা জুবায়ের ও মাওলানা সাদ কান্ধলভীর অনুসারীদের মধ্যে সংঘর্ষের ঘটনায় চারজন নিহতের পর সবাইকে ময়দান ছেড়ে দিতে বলা হয়েছিল। পর্যায়ক্রমে তারা ময়দানও ছেড়েছেন। এখন মুসল্লি শূন্য রয়েছে গাজীপুর মহানগরীর বিশ্ব ইজতেমা ময়দান। তবে কিছু সংখ্যক মানুষ ময়দানের ভেতরে শামিয়ানা ও বাঁশের খুঁটি সরানোর কাজ করছেন। বর্তমানে ফাঁকা ইজতেমা ময়দানে নিরাপত্তাবলয় তৈরি করে রেখেছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী।
গত বৃহস্পতিবার ইজতেমা ময়দানে দেখা গেছে, ময়দানের আশপাশে সতর্ক অবস্থানে রয়েছেন পর্যাপ্ত সংখ্যক আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্য। সেনাবাহিনী ও বিজিবি সদস্যরাও দায়িত্ব পালন করছেন। পুলিশ বলছে, বিশ্ব ইজতেমার ময়দান দখলকে কেন্দ্র করে দুই পক্ষের অনুসারীদের সংঘর্ষ ও হতাহতের ঘটনায় এখনও কোনো মামলা হয়নি। এখন পর্যন্ত কোনো পক্ষের কাউকে আটক করাও হয়নি।
বৃহস্পতিবার দুপুর ১২টার দিকে সরেজমিন দেখা যায়, বিশ্ব ইজতেমার ময়দানের প্রধান ফটকের সামনে টঙ্গী কামারপাড়া বন্ধ সড়ক খুলে দিয়েছে সেনাবাহিনী। এর আগে গতকাল দুপুর থেকে জলকামানসহ দাঙ্গা প্রতিরোধের সরকারি সরঞ্জাম সড়কে দৃশ্যমান ছিল। তবে ময়দানের ভেতরে ও বাইরে সেনাবাহিনী, বিজিবি ও পুলিশসহ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা সতর্ক অবস্থানে রয়েছে।
গাজীপুর মহানগর পুলিশের (জিএমপি) উপ-কমিশনার (ডিসি-টঙ্গী বিভাগ) এনএম নাসিরুদ্দিন বলেন, ইজতেমার ময়দান ছাড়তে নির্দেশনা দেওয়ার পর মুসল্লিরা চলে গেছেন। তবে বৃহস্পতিবারও কিছু মানুষ খুঁটি ও শামিয়ানা সরানোর কাজ করেছেন। পরে তারাও চলে যান। মাঠে নিরাপত্তাবলয় তৈরি করে রেখেছেন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা। ইজতেমার ময়দান দখলকে কেন্দ্র করে মাওলানা জুবায়ের অনুসারী ও সাদ অনুসারীদের সংঘর্ষে নিহত ও আহতের ঘটনায় এখনও মামলা হয়নি।
অন্যদিকে গত বুধবার ভোরে টঙ্গীর তুরাগ তীরে অবস্থিত বিশ্ব ইজতেমা মাঠে তাবলিগ জামাতের দুই গ্রুপের মধ্যে সংঘর্ষের ঘটনায় তিনজন নিহত হয়েছেন। থানা পুলিশ ও তাবলিগ জামাতের মুরুব্বি ও জুবায়েরপন্থি-সাদপন্থি দুই পক্ষের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, নিহত আমিনুল হক ওরফে বাচ্চুর নাম কোথাও আমিনুল হক আবার কোথাও বাচ্চু বলে উল্লেখ করা হয়েছে। একটি নামকে খণ্ডিত করে দুটি নাম ভুলে বলায় নিহতের সংখ্যা তিন থেকে চার হয়েছে।
বুধবার স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে অনুষ্ঠিত সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত শুরায়ি নেজামের (জুবায়েরপন্থি) মিডিয়া সমন্বয়কারী হাবিবুল্লাহ রায়হান বলেন, স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা নিহত আমিনুল হক ওরফে বাচ্চুর নাম ভুলে দুবার উচ্চারণ করায় একজনকে দুজন বলা হয়েছে। আসলে আমিনুল হক ও বাচ্চু একই ব্যক্তি, দুই ব্যক্তি নন। ফলে নিহতের সংখ্যা চার হবে না, তিন হবে।
অন্যদিকে টঙ্গী পশ্চিম থানার ওসি ইস্কান্দার হাবিবুর রহমান বলেছেন, আমরা তিনজন নিহত হওযার সংবাদ পেয়েছি। তিনি বলেন, সংঘর্ষের ঘটনায় দুই পক্ষের কেউই এখনও মামলা করতে আসেনি। তবে মাঠ আমাদের নিয়ন্ত্রণে আছে।
তবে নিহত ব্যক্তিরা কোন পন্থী তা দুই পক্ষ দাবি করলেও সরকারিভাবে স্পষ্ট কোনো মন্তব্য পাওয়া যায়নি। নিহতরা হলেন-কিশোরগঞ্জ জেলার পাকুন্দিয়া থানার এগারোসিন্দু গ্রামের মৃত উসমান মিয়ার ছেলে আমিনুল হক উরফে বাচ্চু মিয়া (৭০)। ঢাকার দক্ষিণ খানের বেরাইদ এলাকার আবদুস সামাদের ছেলে বেলাল হোসেন (৬০), আরেকজন হলেন বগুড়া জেলার তাজুল ইসলাম (৭০)।
গাজীপুরের টঙ্গীতে তাবলিগ জামাতের বিশ্ব ইজতেমা ময়দানের দখলকে কেন্দ্র করে বিবদমান দুটি গ্রুপের সংঘর্ষের ঘটনার সার্বিক বিষয়ে নিজ নিজ অবস্থান পরিষ্কার করতে পাল্টাপাল্টি সংবাদ সম্মেলন করেছে উভয় পক্ষ।
সাদপন্থিদের সংবাদ সম্মেলন : বৃহস্পতিবার বিকালে রাজধানীর মিরপুর-১ এ একটি রেস্টুরেন্টে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে অভিযোগ তুলে ধরেন কাকরাইল মসজিদের ইমাম মুফতি আজিমুদ্দীন বলেন, গতকাল তিনজন নিহতের ঘটনায় দুঃখ প্রকাশ করছি। এই সংঘর্ষ এড়ানোর জন্য সাড়ে তিন মাস আমরা চেষ্টা করেছি। বিগত সাড়ে তিন মাস ধরে প্রশাসনের নানা স্তরে গেলেও, যোগাযোগ করেও কোনো সাড়া পাওয়া যায়নি।
দেশের আলেমদের নিরপেক্ষ ভূমিকা রাখার আহ্বান জানিয়ে তিনি বলেন, তাবলিগ জামাতের ক্ষেত্রে দারুল উলুম দেওবন্দ যেমন নিরপেক্ষ ভূমিকা রেখেছে, আপনারাও সেই ভূমিকা পালন করুন। আমরা আরশাদ মাদানিসহ শীর্ষ আলেমদের কাছে পরামর্শ করেছি। কিন্তু তারা (জুবায়েরপন্থিরা) সব উপেক্ষা করে তুরাগ নদীকে রক্তের সাগরে ভাসাতে চেয়েছে। তিনি অভিযোগ করেন, জুবায়েরপন্থিরা পশ্চিম পাড়ে এসে উসকানি দিয়েছে। এই মাঠ যেহেতু সরকারের, সরকারের নিয়ন্ত্রণেই রাখা হোক। প্রশাসনের নিয়ন্ত্রণে রাখলে হত্যাকাণ্ড হতো না। তিনি আরও বলেন, আমরা এখনও প্রশাসনের ওপর আস্থা রাখি। আমরা দেখেছি তারা আন্তরিক। আমরা মনে করি, সরকার এত দুর্বল না যেকোনো উগ্রবাদী জোর করে দাবি মানাবে। আমরা প্রশাসনের মাধ্যমে যাব। তাদের নিয়ন্ত্রণে মাঠ থাকবে। তাবলিগে সৃষ্ট বিভক্তি, মামুনুল হক ও জুবায়েরপন্থিদের নৃশংস হামলা এবং তাবলিগ নিয়ন্ত্রণের ষড়যন্ত্রের বিচার বিভাগীয় তদন্তের দাবি করছি।
জুবায়েরপন্থি বা শুরায়ে নেজামের সংবাদ সম্মেলন : বৃহস্পতিবার দুপুরে রাজধানীর গুলশানের লেকভিউতে জেস্টি কিচেনে সংবাদ সম্মেলন করে জুবায়েরপন্থি বা শুরায়ে নেজাম। তারা ইজতেমা ময়দানে নির্ধারিত সময়েই বিশ্ব ইজতেমা পালন করা হবে বলে ঘোষণা দিয়েছেন। একই সঙ্গে সাদপন্থিরা ইজতেমা করতে চাইলে কঠোরভাবে প্রতিহত করা হবে বলেও হুঁশিয়ারি দেন।
তারা সাদপন্থিদের বাংলাদেশে নিষিদ্ধ ঘোষণারও দাবি জানিয়েছেন। এ সময় হাবিবুল্লাহ রায়হান বলেন, সাদপন্থিদের হামলায় তিনজন নিহত ও শতাধিক আহত হয়েছেন। এই হত্যা ও হত্যাচেষ্টার ঘটনায় মামলা করা হবে। মাওলানা সাদের অনুসারীদের ইজতেমা করার অনুমতি না থাকলেও তারা জোর করে ঢুকে প্রশাসনের আদেশ অমান্য করেছেন। সাদপন্থিরা যদি ইজতেমা মাঠ দখলের চেষ্টা করেন, তা হলে সাধারণ মুসল্লিরা তাদের প্রতিহত করবেন। নির্ধারিত সময়েই বিশ্ব ইজতেমা পালন করা হবে। সাদপন্থিরা ইজতেমা করতে চাইলে কঠোরভাবে প্রতিহত করা হবে ঘোষণা করেন তিনি। তিনি সাদ অনুসারীদের সন্ত্রাসী আখ্যা দিয়ে বাংলাদেশে তাদের নিষিদ্ধ ঘোষণারও দাবি জানান।
স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা : গত বুধবার স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সভাকক্ষে তাবলিগ জামাতের দুই পক্ষ মাওলানা জুবায়েরপন্থি ও সাদপন্থিদের সঙ্গে আলাদা বৈঠক শেষে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) মো. জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী বলেন, বিশ্ব ইজতেমা মাঠে হামলা ও সংঘর্ষে চারজন নিহত হয়েছেন। হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে যারা জড়িত, তাদের ছাড় দেওয়ার কোনো অবকাশ নেই। এ ঘটনায় মামলা হবে। মামলার পর জড়িতদের আইনের আওতায় আনা হবে। অন্যদিকে বৃহস্পতিবার বিকালে গাজীপুরের ডুয়েট ক্যাম্পাসের সামনে বেশ কিছু শিক্ষার্থী সাদপন্থিদের বিচারের দাবিতে মানববন্ধন করেছেন।
কুমিল্লায় জুবায়েরপন্থিদের বিক্ষোভ : কুমিল্লা প্রতিনিধি জানান, তাবলিগ জামাতের ওপর হামলা ও হত্যার ঘটনায় সুষ্ঠু তদন্ত এবং দোষীদের বিচার দাবিতে কুমিল্লায় ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক অবরোধ করে বিক্ষোভ করেছেন জুবায়েরপন্থিরা। বৃহস্পতিবার বেলা ১১টায় আলেখারচর এলাকায় ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে তারা এ বিক্ষোভ সমাবেশ করেন। এর আগে সকাল ৯টা থেকে বিক্ষোভ কর্মসূচি পালন করেন তারা। কুমিল্লার উলামা মাশায়েখ ও তৌহিদী জনতার ব্যানারে এই বিক্ষোভ সমাবেশ ও মিছিল অনুষ্ঠিত হয়। ঘণ্টাব্যাপী চলা এই সমাবেশের কারণে মহাসড়কের দুই পাশে অন্তত ছয় কিলোমিটার যানজট সৃষ্টি হয়। পরে প্রশাসনের উদ্যোগে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনে।
কিশোরগঞ্জে বিক্ষোভ : কিশোরগঞ্জ প্রতিনিধি জানান, বৃহস্পতিবার বেলা ১১টার দিকে কিশোরগঞ্জের হোসেনপুরে বিক্ষোভ মিছিল ও সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়। এ বিক্ষোভ মিছিল ও সমাবেশের আয়োজন করেন ইমাম উলামা ও তৌহিদী জনতা। বিক্ষোভ মিছিল হোসেনপুর নতুন বাজার কেন্দ্রীয় ঈদগাঁ ময়দান থেকে বের হয়ে পৌরসভার বিভিন্ন সড়ক প্রদক্ষিণ করে। সবশেষে হাসপাতাল মোড়ে এক সংক্ষিপ্ত সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়।
ধামরাইয়ে বিক্ষোভ : ধামরাই প্রতিনিধি জানান, ঢাকার ধামরাইয়ে ওলামায়ে কেরামদের আয়োজনে সাদপন্থিদের সন্ত্রাসী হামলার প্রতিবাদে বিক্ষোভ মিছিল করেছেন ওলামায়ে কেরাম ও তাবলিগের সংগঠনের লোকজন। বৃহস্পতিবার বিকালে ধামরাই পৌরশহরের ঢুলিভাটা বাসস্ট্যান্ডে থেকে ঢাকা-আরিচা মহাসড়কে বিক্ষোভ মিছিল অনুষ্ঠিত হয়। বিক্ষোভ মিছিলে বক্তারা বলেন, সন্ত্রাসী সাদপন্থি ও আওয়ামী লীগ নিরীহ মানুষের ওপর হামলা করে মানুষ হত্যা ও আহত করেছে। আমরা এই সন্ত্রাসীদের অতি দ্রুত গ্রেফতারের দাবি জানাই।
ডিএমপি এবং জিএমপির গণবিজ্ঞপ্তি : সংঘর্ষের ঘটনার পর গত বুধবার দুপুরে এক গণবিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে টঙ্গীর তুরাগ তীরে বিশ্ব ইজতেমা ময়দানে জনসাধারণের প্রবেশ নিষিদ্ধ করেছে গাজীপুর মহানগর পুলিশ (জিএমপি)। জিএমপি কমিশনার ড. নাজমুল করিম খান স্বাক্ষরিত ওই গণবিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়, ১৮ ডিসেম্বর দুপুর ২টা থেকে পরবর্তী নির্দেশ না দেওয়া পর্যন্ত বিশ্ব ইজতেমা ময়দানসহ আশপাশের তিন কিলোমিটার এলাকায় জনসাধারণের জমায়েত নিষিদ্ধ করা হলো। এ সময় দুই বা ততোধিক ব্যক্তি একত্রে ঘোরাফেরা, জমায়েত এবং কোনো মিছিল-সমাবেশ করতে পারবে না। গাজীপুর মেট্রোপলিটন পুলিশ আইন ২০১৮-এর ৩০ ও ৩১ ধারায় পুলিশ কমিশনারকে প্রদত্ত ক্ষমতাবলে এই আদেশ দেওয়া হলো।
এতে আরও বলা হয়, নিষেধাজ্ঞার সময় কোনো ধরনের অস্ত্র, ছুরি, লাঠি, বিস্ফোরক দ্রব্য বা এ জাতীয় কোনো পদার্থ বহন করা যাবে না। এ ছাড়া কোনো ধরনের লাউড স্পিকার বা এ জাতীয় কোনো যন্ত্র দিয়ে উচ্চস্বরে শব্দ করতে পারবে না। নির্দেশ অমান্যকারীদের বিরুদ্ধে যথাযথ আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। একই সঙ্গে ঢাকা মহানগর পুলিশ (ডিএমপি) কমিশনার শেখ মো. সাজ্জাত আলী স্বাক্ষরিত এক গণবিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে ১৮ ডিসেম্বর বুধবার দুপুর ২টা থেকে কামারপাড়া, আব্দুল্লাহপুর, উত্তরা সেক্টর-১০ এবং তৎসংলগ্ন তুরাগ নদীর দক্ষিণ পশ্চিম এলাকায় যেকোনো ধরনের সভা-সমাবেশ, মিছিল, শোভাযাত্রা, বিক্ষোভ পরবর্তী নির্দেশ না দেওয়া পর্যন্ত নিষিদ্ধ করা হয়। এরপর থেকে বিশ্ব ইজতেমা ময়দানের নিরাপত্তা পরিস্থিতিতে নিয়ন্ত্রণে রাখতে ৪ প্লাটুন বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি) মোতায়েন করা হয়। একই সঙ্গে সেনাবাহিনীর সদস্যও মোতায়েন করা হয়।
সময়ের আলো/আরএস/