গ্রাম বাংলার প্রাকৃতিক সংস্কৃতিতে যতগুলো নিয়ামক আছে, তার মধ্যে জোনাক বা জোনাকির আলো অন্যতম। কিন্তু বর্তমানে অজপল্লী গ্রামে গেলেও সন্ধ্যা থেকে ভোররাত পর্যন্ত ঝোপঝাড়ের ওপর ওড়া সেই জোনাকির আলো তেমন চোখে পড়ে না। অথচ এমন একসময় ছিল যে, সন্ধ্যা নামলে আর কথা নয়; হাজার হাজার জোনাকি দলবেঁধে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা ঘূর্ণায়মান অবস্থায় দীপ্তির দৃষ্টিনন্দন অভূতপূর্ব শিহরণ তুলত। তা ছাড়া জোনাকির আলো দেখে মুগ্ধ হয়নি এমন মানুষ পৃথিবীতে বিরল।
আর এই বাংলায় জোনাকির আলো নিয়ে সাহিত্যে কত যে লেখা হয়েছে, তার ইয়াত্তা নেই। তাই তো বাংলার লেখকদের অসংখ্য গল্প, কবিতা ও উপন্যাসে বিশেষ স্থান পেয়েছে এই জোনাকি। রবি ঠাকুর, কাজী নজরুল ইসলাম, আহসান হাবীব, পুর্ণেন্দু পত্রী, বুদ্ধদেব বসু, জীবননান্দ দাশ, যতীন্দ্র মোহন বাগচী প্রমুখ কবির লেখায় জোনাকি বিশেষভাবে অবস্থান নিয়ে আছে। কিন্তু সেই জোনাকির আলো গ্রাম বাংলায় তেমন চোখে পড়ে না। জোনাকির দুঃখজনকভাবে হারিয়ে যাওয়ার কথা না।
আসলে জোনাক বা জোনাকি কলিওপ্টেরা বর্গের ল্যামপিরিডি পরিবারের আওতাভুক্ত। গ্রীষ্ম এবং নাতিশীতোষ্ণ অঞ্চলে প্রায় দুই হাজার প্রজাতির জোনাকি পরিলক্ষিত হয়ে থাকে। বাংলায় এর ভালো নাম তমোমনি হিসেবে অভিহিত। বস্তুত এটি পাখাওয়ালা গুবরে পোকা বৈ কিছু নয়। সাধারণভাবে জোনাকি পোকা বলা হলেও কথ্য ভাষায় জুনি হিসেবে অধিক পরিচিত।
কারণ, তারা জৈব রাসায়নিক ব্যবস্থায় নিজের শরীর থেকে আলো উৎপন্ন করে। এরা এই আলো দ্বারা যৌন মিলন ঘটানো বা শিকারের উদ্দেশ্যে জ্বেলে থাকে। এদিকে আশ্চর্যের বিষয় হলো যে, এরা কোনো আল্ট্রাভায়োলেট বা ইনফ্রারেড তরঙ্গ ছাড়াই নীলাভ আলো উৎপন্ন করে থাকে। আর এই আলোর রং হলুদ, সবুজ বা ফিকে লালও হতে পারে। এদের আলোর তরঙ্গ দৈর্ঘ্য হলো ৫১০ থেকে ৬৭০ ন্যানোমিটার।
মূলত যেখানে ভেজা-কাঠ আছে, এমন এলাকা বা ডোবা জাতীয় অঞ্চলে এদের সমারোহ দেখা যায়। কারণ এদের লার্ভাদের বেঁচে থাকার জন্য এসব জায়গায় অনেক খাদ্য পাওয়া যায়। মূলত এদের স্যাঁতসেঁতে ভিজে জায়গা খুব প্রিয়। এরা সূর্যের আলো তেমন সহ্য করতে পারে না। তাই এরা দিনের বেলায় অন্ধকারে লুকিয়ে থাকতে পছন্দ করে। দিনে এরা গাছের বাকল বা কোনো ফাঁকফোকরের মধ্য কিংবা অন্ধকারাচ্ছন্ন স্থানে থাকে।
শুধু জোনাকি নয় এদের ছানা বা কীটগুলো থেকেও আলো নির্গত হয়। আর এগুলোকে গ্লোওয়ার্ম বলা হয়। আমেরিকায় অবশ্য এই গ্লোওয়ার্মকে ফেনগোডিডে বলা হয়। জোনাকির প্রায় প্রজাতিরই নারী-পুরুষ উভয় উড়তে পারলেও কিছু প্রজাতির স্ত্রীরা উড়তে পারে না। যেভাবেই বলি না কেন, জোনাকি এক প্রকারের পতঙ্গ। এই পতঙ্গের তলপেটে স্বয়ংপ্রভ নীলাভ-সবুজ দ্যুতি থাকে, যা রাতের অন্ধকারে তারার মতো মিটমিটিপূর্বক দৃষ্টি আকর্ষণ করে। সমবেতভাবে একই ছন্দে এরা মিটমিটি করতে পারে। আসলে এরা একটানা আলো জ¦ালায় না; একবার জ¦লে এবং কয়েকবার নেভে। বস্তুত এই দ্যুতি আসে লুসিফারিন-অক্সিজেন এবং এটিপির সংমিশ্রণের লুসিফারেজ দ্বারা অনুঘটিত জারণ থেকে।
শুধু জোনাকি নয়, আরও কিছু পোকামাকড় আলো ছড়ায়। পোকামাকড়ের এই আলোকিত বৈশিষ্ট্যকে বায়োলুমিনেসেন্স বা জৈব আলোকধারা বলে অভিহিত। ইতিমধ্যে বিজ্ঞানীরা গবেষণার আওতায় জোনাকির জিনোম ডিকোড করেছেন। আর গবেষণার প্রাক্কালে জোনাকির হালকা অঙ্গের গঠন, সক্রিয়করণ ও অবস্থানের জন্য দুটি জিনের খোঁজ পান বিজ্ঞানীরা। এলাবিডি-বি এবং এলইউএনসি-৪ নামের দুটি জিনের কারণেই নাকি জোনাকি আলো ছড়ায় বলে উদঘটিত হয়েছে। এদিকে জোনাকির দেহে থাকে লুসিফেরিন নামক এনজাইম বা উৎসেচক।
এই এনজাইম অবশ্য এদের দেহে আপনা হতেই তৈরি হয়ে থাকে। যখনই লুসিফেরিন বাইরের বাতাসে অক্সিজেনের সংস্পর্শে আসে, তখনই তা লুসিফেরাস নামক এনজাইমের উপস্থিতিতে জারিত হয় এবং আর এই জারণ বিক্রিয়ার কারণেই নির্গত হয় শক্তি। আর সে শক্তির বহিঃপ্রকাশ ঘটে হালকা নীল আলোর মাধ্যমে। তা ছাড়া লুসিফেরিন আবার ফসফরাসের একটি যৌগ। সেই দিক থেকে দিনের বেলাতেও ওদের দেহ থেকে শক্তি নির্গত হয়। কিন্তু সূর্যের তীব্র আলোতে তা আদৌ চোখে ধরা পড়ে না।
সবচেয়ে আশ্চর্যের বিষয় হলো, জোনাকির সবুজাভ আলোর একটি বৈশিষ্ট্য হলো যে, এতে তাপ নেই। এদের দেহ থেকে নিঃসৃত আলো একেবারেই শীতল। আর এতটাই শীতল যে এই আলোর মধ্যে দিনের পর দিন যদি একটি থার্মোমিটার রাখা হয়, তা হলে পারদ এতটুকু প্রসারিত হবে না। বিজ্ঞানীরা আজ পর্যন্ত যত রকম আলো আবিষ্কার করেছেন, তার মধ্যে একমাত্র ফসফরাসের জারণ ব্যতীত অন্য কোনো উপায়ে সৃষ্ট আলো আদৌ শীতল নয়।
সব ক্ষেত্রেই সামান্য হলেও তাপ উৎপন্ন হতে দেখা যায়। তাই তাপবিহীন আলো যেন কল্পনা করাটাই অলৌকিক। সেদিক থেকে জোনাকিদের বলা যেতেই পারে প্রকৃতির এক বিচিত্র ও আজব সৃষ্টি। মূলত এদের শীতল নীল আলোর যেন এক মোহময় ও রহস্যময় জাদুকরি ক্ষমতা রয়েছে। আরেকটি বৈশিষ্ট্য হলো যে, আলোর মাধ্যমে এক জোনাকি অন্য জোনাকিকে সংকেত পাঠানোর কাজ করে থাকে। শুধু স্ত্রী জোনাকির সঙ্গে মিলনের সময় তারা যে এই সংকেত পাঠায় তা নয়। শত্রুদের বিভ্রান্ত করতে বা নিজেদের এলাকাকে সুরক্ষিত রাখতে এরা আলো জ্বলা-নেভার কাজটি অত্যন্ত সুচতুরভাবে করে থাকে।
জোনাকির আলো কেবল দৃষ্টিনন্দন নয়। এটি উপকারীও বটে। এদের শরীরে লুসিফেরাস ও লুসিফেরিন নামক দুই ধরনের রাসায়নিক পদার্থ আছে, যা এটিপি নামক উচ্চশক্তির যৌগ উৎপাদন করে। যদি জোনাকির শরীরের এই দুই রাসায়নিক পদার্থ কোনো প্রাণীর রোগাক্রান্ত কোষে প্রয়োগ করা হয়; তবে তা কোষের পরিবর্তন শনাক্ত করতে সক্ষম হয়। ফলে ক্যানসারের মতো অনেক মরণব্যাধি রোগের চিকিৎসা ও গবেষণায় জোনাকির গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা প্রণিধানযোগ্য। এ ছাড়াও খাদ্য নিরাপত্তা পরীক্ষা এবং ফরেনসিক পরীক্ষায় লুসিফেরাস নামক রাসায়নিক পদার্থের ব্যবহারে যথেষ্ট সাফল্য পাওয়া গেছে।
দুঃখজনক হলেও সত্য যে, দৃষ্টিনন্দন এই উপকারী জীব জোনাকি ধীরে ধীরে বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে। এভাবে চলতে থাকলে হয়তো এই জোনাকি কেবল বইয়ের পাতায় বা জাদুঘরে দেখা যাবে। অবশ্য এর পেছনে কারণ হলো ক্রমাগত পরিবেশ দূষণ; বিশেষ করে আলোদূষণ ও শব্দদূষণ; পরিবেশের তাপমাত্রা বৃদ্ধি পাওয়া; জোনাকির আবাসস্থল কমে যাওয়া ইত্যাদি কারণে পৃথিবীজুড়ে জোনাকির সংখ্যা হ্রাস পাচ্ছে বলে বিজ্ঞানীরা মনে করেন।
তা ছাড়া রাতের ঝলমলে আলো জোনাকির মতো অনেক নিশাচর কীট-পতঙ্গের পক্ষে টিকে থাকা মুশকিল। আরেক সূক্ষ্ম কারণ হলো বিজ্ঞানীরা নানা পরীক্ষা-নিরীক্ষার জন্য জোনাকি পোকা ব্যবহার করছেন। এসব মিলে জোনাকির সংখ্যা দিন দিন কমে যাচ্ছে। এদিকে জোনাকিরা সাধারণত তাদের পছন্দের জায়গা থেকে নড়তে চায় না। এমন সব জায়গা নষ্ট হয়ে গেলে তাদের বাঁচার এবং প্রজননের ক্ষমতাও হ্রাস পেতে থাকে।
জীবজগতের প্রতি জীবই কোনো বা কোনোভাবে প্রকৃতির ভারসাম্য রক্ষা করতে পরোক্ষ ও প্রত্যক্ষভাবে ভূমিকা রাখে। আর এই জোনাকি তার ব্যতিক্রম নয়। তা ছাড়া সাহিত্যের পাতায় বিভিন্নভাবে স্থান নিয়ে আমাদের মনের খোরাকের ক্ষেত্রে অনবদ্য ভূমিকা রাখছে। তাই এই দৃষ্টিনন্দন
জীব তথা জোনাকি পোকা এ বিশ্বে টিকিয়ে রাখতে মনুষ্যকূলের নিজেদের স্বার্থে সক্রিয় ভূমিকা পালন করা অপরিহার্য বলে মনে করি।
সাবেক শিক্ষক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
সময়ের আলো/আরএস/