ই-পেপার শুক্রবার ২০ ডিসেম্বর ২০২৪
শুক্রবার ২০ ডিসেম্বর ২০২৪
ই-পেপার

শুক্রবার ২০ ডিসেম্বর ২০২৪

রেটিনার নোনা জলে তোমার সাঁতার
প্রকাশ: শুক্রবার, ২০ ডিসেম্বর, ২০২৪, ১২:৫৯ এএম  (ভিজিট : ৮২)
হতে চেয়েছিলেন ডাক্তার হয়ে গেলেন কবি, আসলে এমনটা না। তিনি মনে-প্রাণে ছিলেন কবি কিন্তু পেশা হিসেবে নিতে চেয়েছিলেন চিকিৎসাবিদ্যাকে। অবশেষে ভালোবাসা এবং তার নেশাই প্রাধান্য পেল। জীবন চালানোর জন্য পেশা হিসেবে ডাক্তারি পড়ার ইচ্ছায় বিজ্ঞান বিভাগ নিয়ে উচ্চ মাধ্যমিক পাস করলেও আজীবন লালিত নেশাকেই শেষ পর্যন্ত বেছে নেন।

বাবা খোরশেদ আলী তালুকদারের কারণে কবিতার যে নেশা মননে প্রবেশ করেছিল তাকেই তিনি জীবনসঙ্গী করে নিলেন। ডাক্তার হওয়ার চিন্তা বাদ দিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগে ভর্তি হলেন। সময়টা তখন অগ্নিময়। দেশ তখন অধিকারের আন্দোলনে দোল খাচ্ছে। তিনি বিপ্লব থেকে দূরে থাকবেন কীভাবে।

‘নিষিদ্ধ সম্পাদকীয়’ শিরোনামে তার কলমে উঠে এলো মুক্তি এবং যুদ্ধের প্রেরণার কবিতা। হ্যাঁ প্রেম আর দ্রোহের কবি হিসেবে খ্যাত কবি হেলাল হাফিজ এভাবেই শুরু করেছিলেন। উনিশশ ঊনসত্তরের গণচেতনায় যখন বাঙালি ছাত্র-জনতা ফুঁসে উঠছে, তখনই কবি তৎকালীন ইকবাল হলের ২১৬ নম্বর কক্ষে ১৯৬৯ সালের ১ ফেব্রুয়ারি রচনা করলেন ঐতিহাসিক কবিতা ‘নিষিদ্ধ সম্পাদকীয়’। তিনি তার এই কবিতা বেশ কয়েকটি সংবাদপত্রে ছাপানোর চেষ্টায় ব্যর্থ হলেন। তখনই আহমদ ছফা এবং কবি হুমায়ুন কবির লেখক শিবিরের সদস্যদের সহায়তায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দেয়ালে দেয়ালে উক্ত দুই লাইন দেয়ালে লিখে পুরো বিশ্ববিদ্যালয়ে তথা সারা দেশে কবিতাটিকে আন্দোলনের শ্রেষ্ঠ সেøাগানে পরিণত করলেন। এখন পর্যন্ত কবি হেলাল হাফিজের লেখা কবিতার এই দুই লাইন এ দেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে ব্যবহৃত সব চেয়ে বহুল উচ্চারিত স্লোগান।

কবি হেলাল হাফিজ নেত্রকোনার বড়তলী গ্রামে ৭ নভেম্বর ১৯৪৮ সালে জন্মগ্রহণ করেন। তার তিন বছর বয়সে তিনি মাকে হারান। কম বয়সের কারণে তখন তার অনুভূতিতে তেমন সাড়া পড়েনি। কিন্তু ক্রমেই বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে মাকে হারানোর উপলব্ধি নাড়া দিতে থাকে। বাবা দ্বিতীয় বিবাহ করলে তা কবির হৃদয় গভীর রেখাপাত করে। কিছুটা অবহেলা এবং মায়ের প্রতি ভালোবাসা তাকে বাবার দ্বিতীয় বিবাহ প্রসঙ্গে তার মুখোমুখি করে। তিনি কবিতার মাধ্যমেই তার বাবার কাছে জানতে চেয়েছিলেন যে ‘কেমন ভালোবাসা ছিল আমার মায়ের সঙ্গে যে মার মৃত্যুর পর স্কুলশিক্ষক পিতা খোরশেদ আলী তালুকদার আবার বিবাহ করলেন।’ পুত্রের জিজ্ঞাসায় পিতা কবিতার মাধ্যমেই এভাবে জবাব দিয়েছিলেন, ‘রেটিনার নোনা জলে তোমার সাঁতার / পিতৃদত্ত সে মহান উত্তরাধিকার।’

ছাত্রজীবনে কবি নির্মলেন্দু গুণ এবং কবি আবুল হাসান ছিলেন তার প্রিয় সহচর। তারই হলের কক্ষে এই ত্রয়ীর অনেক রাত একসঙ্গে কেটেছে। লেখালেখি শুরুর এত অধিক সময় পরে তার প্রথম বই প্রকাশের কারণ প্রসঙ্গে তার বক্তব্য ছিল, ‘দেখতাম প্রতি বছর বইমেলায় অনেক কবিতার বই বের হয়। কিন্তু মেলা শেষ হওয়ার পরের দিন থেকে সেই বইয়ের আর কোনো খবর থাকে না। তখন থেকেই আমার ভেতরে জেদ কাজ করল যে এমনটা হবে কেন। এমন বই হতে হবে যেন সে বই প্রকাশিত হওয়ার পর তা পাঠক হৃদয় স্থান করে নেয়।’ অদ্যাবধি তার এই বইয়ের ৩৩টি প্রকাশনা হয়ে গেছে। যদিও যে জলে আগুন জ্বলের পর তার আরও দুটো বই প্রকাশ হয়েছে।

যথাক্রমে প্রথম বই প্রকাশের ২৬ বছর পর ২০১২ সালে প্রকাশিত হয়ে তার দ্বিতীয় কবিতা গ্রন্থ ‘কবিতা একাত্তর’ এবং দ্বিতীয় বই প্রকাশের ৬ বছর পর ২০১৯ সালে প্রকাশিত হয় তার তৃতীয় কাব্যগ্রন্থ ‘বেদনাকে বলেছি কেঁদোনা।’ এতেই বোঝা যায় তার সৃষ্টিতে তিনি কতটা সতর্ক ছিলেন।

তার জীবনে দুজন মানুষের প্রচণ্ড প্রভাব ছিল। প্রথমজন ছিলেন তার পিতা এবং দ্বিতীয়জন ছিলেন সবিতা সেন। সবিতা সেনের মাঝে তিনি দুটো সত্তা খুঁজে পেয়েছিলেন। প্রথমত সবিতা মিস্ট্রেসের মাঝে তিনি তার মাকে আবিষ্কার করেছিলেন এবং পরবর্তীতে তারই মাঝে তিনি তার প্রেমকেও খুঁজে পেয়েছিলেন।

তার কবিতায় দুর্বোধ্যতা স্থান পেত না। তার কবিতার ভাষা ছিল সহজ এবং প্রাঞ্জল। তার সহজ এবং প্রাঞ্জল ভাষায়ই তিনি কবিতা প্রেমিকদের হৃদয়ে স্থান করে নিয়েছেন। কষ্ট এবং বেদনাকে তিনি এতটাই পুঁজি করেছিলেন যে তিনি কষ্টের রং দিয়ে আঁকলেন তার ‘ফেরীঅলা’ কবিতা।

রাজনীতি সচেতন কিন্তু বোহেমিয়ান চরিত্রের হেলাল হাফিজকে প্রেমিকা হেলেনের হঠাৎ বিয়ের ঘোষণা ভেতরে তাকে মুষড়ে দিলেও বাইরে তিনি ছিলেন অবিচল পাহাড়ের মতো। তিনি অত্যন্ত আত্মাভিমানী এবং আত্মসম্মানী একাকী একজন মানুষ এবং কবি ছিলেন। তিনি লিখলেন, ‘ইচ্ছে ছিল তোমাকে সম্রাজ্ঞী করে সাম্রাজ্য বাড়াব’। বিশ্ব রাজনীতি এবং মোড়লিপনার বিরুদ্ধেও জেগেছিল তার কলম। ১৯৮০ সালে যখন বিশ্বময় চলছে সম্রাজ্যবাদী শাসন তিনি হয়ে উঠলেন প্রতিবাদী।

‘অশ্লীল সভ্যতা’ শিরোনামে মাত্র দুই লাইন কবিতা দিয়ে তিনি ছুড়লেন ঘৃণার মারণাস্ত্র, যা এ রকম ‘নিউট্রন বোমা বোঝ / মানুষ বোঝোনা!’ জীবনে কখনো তিনি কারও বোঝা হতে চাননি। তার জীবন কেটেছে প্রেস ক্লাবে এবং তার উল্টোদিকে কর্ণফুলী হোটেলের ২০২ নং কক্ষে, শাহবাগের সুপার হোস্টেলে। এখানেই তিনি জীবনের শেষ দিনটি কাটিয়েছেন। এমনটা নয় যে তাকে কেউ এড়িয়ে গেছেন। তিনি তার অগ্রজের বাসায় অনেক দিন কাটিয়েছেন। মহামারির সময়ও তিনি তার অগ্রজের বাসায় ছিলেন। তার অনুজ নেহালও তাকে নিজের কাছে রাখতে চেয়েছিলেন। কিন্তু তার আত্মসম্মান বোধ এবং অন্যকে বিব্রত না করার বোধ থেকে তিনি কারও কাছেই স্থায়ী হননি। ২০২৪-এর ১৩ ডিসেম্বর তিনি মহাপ্রয়াণে পাড়ি দিলেন।

সময়ের আলো/আরএস/ 




https://www.shomoyeralo.com/ad/1698385080Google-News-Update.jpg

সর্বশেষ সংবাদ

সর্বাধিক পঠিত


ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক : সৈয়দ শাহনেওয়াজ করিম, আমিন মোহাম্মদ মিডিয়া কমিউনিকেশন লিমিটেড এর পক্ষে প্রকাশক গাজী আহমেদ উল্লাহ। নাসির ট্রেড সেন্টার, ৮৯, বীর উত্তম সি আর দত্ত সড়ক (সোনারগাঁও রোড), বাংলামোটর, ঢাকা।
ফোন : +৮৮-০২-৯৬৩২৩৬৮-৭৪, ফ্যাক্স : +৮৮-০২-৯৬৩২৩৭৫ | ই-মেইল : shomoyeralo@gmail.com
close