নারী নির্যাতনের বহুমাত্রিকতার ভয়াবহতা দিন দিন বেড়েই চলেছে। ঘরে-বাইরে কোথাও নিরাপদ নয় নারী। গত ৯ ডিসেম্বর লক্ষ্মীপুরের কমলনগরে স্থানীয় পাঁচ যুবক গভীর রাতে ঘরে ঢুকে মাকে বেঁধে এক হতদরিদ্র রিকশাচালক পিতার তরুণী মেয়েকে ধর্ষণ করে।
অভিযুক্তের লোকজনের ভয়ভীতিতে দিশাহারা পরিবারে নির্যাতনের শিকার তরুণীর স্বামী বিচারের আশ্বাসে সেনাক্যাম্পে অভিযোগ করেন। কোথাও প্রযুক্তির উৎকর্ষ সাধনের সঙ্গে সঙ্গে সাইবার বুলিং তথা অনলাইনে যৌন হয়রানির শিকার হচ্ছে নারী। সাইবার ক্রাইম অ্যাওয়ারনেস ফাউন্ডেশনের ‘বাংলাদেশের সাইবারপ্রবণতা-২০২১’ শীর্ষক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সাইবার অপরাধে ভুক্তভোগীদের মধ্যে মহামারিতে নারীরা বেশি সাইবার অপরাধের শিকার হচ্ছেন। পুরুষের তুলনায় নারীরা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে হয়রানি ও পর্নোগ্রাফির শিকার বেশি। রাস্তাঘাটে, যানবাহনে, কর্মক্ষেত্রে, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে নারীরা প্রতিনিয়ত যৌন হেনস্থার শিকার হচ্ছেন।
২০১৯ সালের ২ আগস্ট রাতে যশোর থেকে কমিউটার ট্রেনে খুলনায় ফেরার পথে ফুলতলা রেলস্টেশনে নামলে কর্তব্যরত পুলিশ মোবাইল ফোন চুরির অপবাদে এক নারী যাত্রীকে আটক করে। পরে থানার ওসি, দারোগাসহ ৫ পুলিশ মিলে ওই নারীকে গণধর্ষণ চালায়। পরদিন ৫ বোতল ফেনসিডিল দিয়ে তাকে কোর্টে চালান দেওয়া হয়। আদালত গণধর্ষণের ঘটনা শোনার পর নারীর ডাক্তারি পরীক্ষা সম্পন্ন করে গণধর্ষণের প্রমাণিত হয়। আড়ালে-আবডালে নয়, ধর্ষক যখন লোকসমক্ষে নারীর প্রতি চরম নির্মমতা চালায়, তখন বুঝতে হয় এ সমাজে নারী কত অরক্ষিত। বিশেষ করে নিরীহ নারীরা ধর্ষণের শিকার হয়েও সর্বোচ্চ বিচার না পাওয়ায় ধর্ষক বারবার অপকর্মে উৎসাহিত হয়ে ওঠে। মানবাধিকার সংগঠন আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) তথ্য মতে, চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে মার্চ এই তিন মাসে ধর্ষিত হয়েছে ১১৪ জন নারী, ধর্ষণের পরে হত্যা করা হয়েছে ৩ জনকে, পারিবারিকভাবে নির্যাতিতা হয়েছে ১৩৭ জন নারী, যাদের মধ্যে ৬৫ জনকে মেরে ফেলা হয়েছে এবং আত্মহত্যা করেছে ৪৯ জন।
এ ছাড়া ৫৫ জন নারী এবং ২৪ জন পুরুষ যৌন নির্যাতনজনিত প্রতিহিংসার শিকার হয়েছে। শিশু নির্যাতনের শিকার হয়েছে ৩২৫ জন, যাদের মধ্যে ১৩৯ জন খুন হয়েছে। চলতি বছরের প্রথম তিন মাসে ৪ জন যৌন নির্যাতনের প্রতিবাদ করায় তাদের হত্যা করা হয়েছে। সম্প্রতি নোয়াখালীর বেগমগঞ্জে ব্যক্তিগত ছবি হাতিয়ে নিয়ে ব্ল্যাকমেইল করে টাকা আদায় ও শারীরিক সম্পর্ক স্থাপন করতে চাওয়ায় দূর সম্পর্কের এক চাচাতো ভাইয়ের বিরুদ্ধে মামলা করে ৩৫ বছরের গৃহবধূ শাহনাজ আক্তার। মামলার হাজিরা দিতে আদালতে যাওয়ার পথে অটোরিকশা থামিয়ে প্রকাশ্যে ছুরিকাঘাতে তাকে হত্যা করে ৩০ বছর বয়সি অভিযুক্ত সাইফুল।
ধর্ষক হয়ে কেউ জন্মেছে এমন নজির নেই। পরিবেশ-পরিস্থিতির শিকার হয়ে অনেকে ধর্ষকে রূপ নেয়। অশিক্ষা, কুশিক্ষা প্রধানত ধর্ষণের মতো অপকর্মের জন্য দায়ী। এক পর্যবেক্ষণে দেখা গেছে, উঠতি বয়সের কিশোর ও যুবক দ্বারাই নারী বেশি ধর্ষণের শিকার হয়, তবে ধর্ষণের সঙ্গে জড়িত রয়েছে রাজনৈতিক কর্মী, মাদরাসা শিক্ষকসহ বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ। ধর্ষণের মতো এমন পাশবিকতা যে শুধু অশিক্ষিত সমাজের মধ্যেও সীমাবদ্ধ তা কিন্তু নয়। কলেজ, ইউনিভার্সিটির মেয়েরাও সহপাঠী বা প্রেমিকের দ্বারা ধর্ষণের শিকার হচ্ছে। কলেজ, ইউনিভার্সিটি শিক্ষকের বিরুদ্ধে ছাত্রীকে ধর্ষণের প্রমাণ মিলেছে। নিকটাত্মীয় দ্বারা ধর্ষিত হচ্ছে শিশু।
মূল্যবোধহীন এ সমাজে পরিবারের কাছে সদস্যদের দ্বারা ধর্ষিত হওয়ার ঘটনাও বিরল নয়। নগর জীবনের ব্যস্ততার কারণে শিশুকাল থেকে সন্তান উপযুক্ত পারিবারিক শিক্ষা থেকে হচ্ছে বঞ্চিত। মানুষ হিসেবে নিজেকে গড়ে তোলার চেয়ে রাতারাতি বিত্ত-বৈভব গড়ে তোলার একটা অশুভ প্রতিযোগিতায় মেতে ওঠে বর্তমান প্রজন্মের ছেলেমেয়েরা। আজেবাজে পুস্তক পাঠে, ইন্টারনেটে, ভিডিওর অশ্লীল ছবি দেখে খুঁজে নেয় বাইরের এক অচেনা-অজানা অন্ধকার জগৎ।
নিম্নবিত্তের মানুষ তাদের দারিদ্র্যজনিত হতাশায় অনেক সময় অপরাধপ্রবণ হয়ে ধর্ষণের মতো কাজে লিপ্ত হয়। বখে যাওয়া মাদকাসক্ত তরুণ-যুবকরা ভালোমন্দ জ্ঞানশূন্য হয়ে অবলীলায় ধর্ষণে লিপ্ত হতে দ্বিধাবোধ করে না। মানবিক মূল্যবোধের অবক্ষয়, নারীকে মানুষ হিসেবে গ্রহণ করতে না পারার মানসিকতা পুরুষের মাঝে যে মিথ্যে শ্রেষ্ঠত্ববোধের জন্ম দেয় তা থেকে মূলত তাদের ধর্ষণের মতো জঘন্য অপরাধের পথে ঠেলে দেয়।
আমাদের মতো রক্ষণশীল সমাজব্যবস্থায় নারীরা সাধারণত লোকলজ্জা ও সামাজিক মর্যাদাহানির ভয়ে সব ধর্ষণের কথা প্রকাশ করে না। মামলা করে হয়রানি ও সুষ্ঠু বিচার না পাওয়ার হতাশায় ধর্ষণের ঘটনাকে আড়াল করে যায়। মামলা নিতে পুলিশের গড়িমসি এবং মামলার দীর্ঘসূত্রতার কারণেও অনেক ধর্ষণের ঘটনা চাপা পড়ে যায়। বাংলাদেশে ধর্ষণের জন্য যে আইনি বিধান রয়েছে তাতে ধর্ষণের শিকার নারীকে প্রমাণ করতে হয় যে সে ধর্ষণের শিকার হয়েছেন। আলামত সংগ্রহ এবং যেসব পরীক্ষার মধ্য দিয়ে ধর্ষিতাকে যেতে হয় তাও কঠিন। ধর্ষণের ব্যাপারে ধর্ষিকাকে পুলিশের জিজ্ঞাসাবাদও নারীর জন্য পীড়াদায়ক। বিচার প্রক্রিয়ার বাধ্যবাধকতায় নারীকে বিপক্ষের কৌশলীর জেরার মুখে বারবার ধর্ষণকাণ্ডের বিব্রতকর বর্ণনা দেওয়ার অভিজ্ঞতা ধর্ষিতার জন্য আর এক কঠিন শাস্তি যা মৃত্যুদণ্ডের শামিল।
মামলার দীর্ঘসূত্রতা ও বিচারহীনতার সংস্কৃতিও ধর্ষণকে অনেকাংশে উৎসাহিত করে তোলে। অর্থবিত্ত ও সামাজিকভাবে প্রভাবশালীরা বা তাদের মদদপুষ্টরা অনেক ক্ষেত্রে ধর্ষণের মতো ঘৃণিত অপরাধ করার কারণে পুলিশ মামলা নিতে গড়িমসি করে। আবার মামলা নিলেও তদন্ত প্রতিবেদন নিয়ে কখনো টালবাহানা করতে দেখা যায়। কখনো বা অপরাধীদের বাঁচিয়ে প্রতিবেদন দেওয়ার নজির খুঁজে পাওয়া যায়। কিংবা অপরাধী প্রকাশ্যে ঘুরে বেড়ালেও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী কোনো কোনো অসাধু সদস্য তাদের না দেখার ভান করে অপরাধীকে বাঁচিয়ে দেওয়ার অপচেষ্টায় লিপ্ত হন। পুরুষতান্ত্রিক সমাজ কাঠামোর অবহেলা ও উদাসীনতা ধর্ষণের অভিযোগ বরাবর বিচারহীনতায় গিয়ে শেষ হতে দেখা যায়। আর বিচারহীনতার এ ধরনের সংস্কৃতি ধর্ষককে পাপাচারে লিপ্ত হতে উৎসাহিত এবং বেপরোয়া করে তোলে।
ধর্ষণের মতো দুষ্টক্ষতকে সমাজ থেকে বিতাড়িত করতে হলে ধর্ষকের স্বরূপ উন্মোচিত করতে হবে। পত্রপত্রিকায় ধর্ষিতার বদলে ধর্ষকের ছবি ও পরিচয় বিশদভাবে তুলে ধরতে হবে। তরুণদের সুস্থ মন ও মূল্যবোধসম্পন্ন করে গড়ে তুলতে পরিবার-পরিজন ও সামাজিক প্রতিষ্ঠানের ক্রিয়াশীল ভূমিকা রাখতে হবে। তরুণ সমাজকে সঠিক পথে পরিচালিত করতে শিক্ষক এবং শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকে দায়িত্ব নিতে হবে। ধর্ষিতা ও তার পরিবারকে সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ে আইনি সহায়তা দিতে হবে। নারী-পুরুষের স্বীকৃত সমঅধিকার প্রতিষ্ঠাসহ রাস্তাঘাটে, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে, কর্মক্ষেত্রে, সমাজের প্রতিটি স্তরে নারীর নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে।
বাংলাদেশের সংবিধানে নারীর সমান অধিকারের কথা বলা হলেও পারিবারিক আইনে নারী-পুরুষের বিদ্যমান বৈষম্যের কারণে বিভিন্ন ক্ষেত্রে নারী সুবিচার থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। পণ্য বিপণনের বিজ্ঞাপনে নারীর গ্লামার উপস্থাপিত হওয়া কাম্য নয়। শ্রমজীবী নারীর মজুরি বৈষম্য, কর্মক্ষেত্রে বঞ্চনা-লাঞ্ছনার মতো কালো অধ্যায়ের অবসান জরুরি। ধর্ষণ সামাজিকভাবে একটি ঘৃণিত কাজ এবং ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকে এটি পাপ বিধায় দেশের প্রচলিত আইনে ধর্ষণ একটি শাস্তিযোগ্য অপরাধ। বাংলাদেশ দণ্ডবিধির ৩৭৬ ধারা অনুযায়ী ধর্ষণের শাস্তি যাবজ্জীবন কারাদণ্ড কিংবা ১০ বছরের ঊর্ধ্বে কারাদণ্ড বা তদ্রƒপ অর্থদণ্ড। তবে ধর্ষণের শিকার নারী বা শিশুর মৃত্যু হলে বা দলবেঁধে ধর্ষণের শিকারের জন্য রয়েছে সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ড।
নারী ও শিশু নির্যাতন আইন ২০০০-এর ৯ ধারা অনুযায়ী ধর্ষণের শাস্তি যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের আইন সংশোধন করে ‘নারী ও শিশু নির্যাতন দমন (সংশোধন) অধ্যাদেশ, ২০০০’-এর অনুমোদিত আইন মৃত্যুদণ্ডের বিধান কার্যকর হওয়ায় এর যথাযথ প্রয়োগ ধর্ষণসহ শিশু ও নারীর প্রতি সব ধরনের সহিংসতা রোধে কার্যকর ভূমিকা রাখবে। তবে মৃত্যুদণ্ডের মতো কঠোর শাস্তি বাস্তবায়নে বিচারিক প্রক্রিয়া নারীবান্ধব হতে হবে, পাল্টাতে হবে পুরুষতন্ত্রের সমাজমানসের চলমান ধারা। একবিংশ শতাব্দীতে বাংলাদেশের নারীদের বিভিন্ন ক্ষেত্রে অভূতপূর্ব সাফল্য লক্ষ্য করা যাচ্ছে, গত চার দশকে নারী উন্নয়ন ও নারীর ক্ষমতায়নের ক্ষেত্রে যথেষ্ট অগ্রগতি হয়েছে। বিভিন্ন পাবলিক পরীক্ষায় ছাত্রীদের ভালো ফলাফল, নানা পেশায় তাদের অভাবনীয় দক্ষতা অনেক ক্ষেত্রে পুরুষকে ছাড়িয়ে যাচ্ছে। মেধা-মননে, কায়িক শ্রমের কাজে কোথাও নারী সমাজ আর পিছিয়ে নেই।
তারপরও পুরুষতান্ত্রিক সংস্কৃতির ধারায় নিয়ন্ত্রিত এ সমাজ একান্তই পুরুষের সমাজ। যেখানে নারী অধস্তন, সেখানে সে পুরুষের যথেচ্ছ চাহিদা পূরণে বাধ্য। এমন পরিস্থিতির পরিবর্তন ছাড়া ধর্ষণসহ নারীর প্রতি সহিংসতা রোধে বাধা থেকেই যাবে। বিচারিক প্রক্রিয়ার সংস্কার ও নিয়মে আনতে, পরিবর্তন আনতে রাষ্ট্রকে ভূমিকা রাখতে হবে। নারীকে শুধু নারী নয়, একজন মানুষ হিসেবে বিবেচনা করে জেন্ডারভিত্তিক নারীর প্রতি সহিংসতার বিরুদ্ধে সামাজিক প্রতিরোধ গড়ে তুলতে হবে।
ধর্ষণসহ সব নারী নির্যাতন রোধ করে নারীকে মর্যাদার আসনে বসাতে সমাজ ও তারুণ্যের বিজয় সম্ভাবনাকে কাজে লাগাতে হবে। আর তা না হলে তিন মাস ধরে আটকে রেখে ধর্ষণের ফলে চোখ হারানো ময়মনসিংহের নান্দাইলের মাদরাসার অষ্টম শ্রেণির কিশোরী শিক্ষার্থী পাপিয়াদের কর্নিয়া সংযোজন করে দৃষ্টি ফিরিয়ে দেওয়ার আগেই মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়তে হবে।
অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক ও প্রকৌশলী
সময়ের আলো/আরএস/