দেশে প্রথম ২০০১ সালে মেহেরপুর জেলায় নিপাহ ভাইরাসের রোগী শনাক্ত হয়। সেই থেকে এখন পর্যন্ত মোট আক্রান্ত হয়েছেন ৩৪৩ জন। এর মধ্যে এবছর আক্রান্ত হয়েছেন ৫ জন। কিন্তু তারা সবাই মারা গেছেন। এর ফলে এবার নিপাহ ভাইরাসে মৃত্যুর হার ১০০ ভাগ। আর গত বছর ১৩ জন নিপাহ ভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছিলেন। তাদের মধ্যে মারা যান ১০ জন। ২০২৩ সালে এই হার ছিল ৭৭ শতাংশ।
এদিকে, মালয়েশিয়া ও সিঙ্গাপুরে প্রথম নিপাহ ভাইরাস শনাক্ত হয়। ওই দুই দেশ মিলিয়ে মোট আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা হলো ২৭৬ জন। এরপর ভারতে ১০৪ জন এবং ফিলিপাইনে ১৫ জন। সেই হিসেবে আক্রান্তের সংখ্যায় শীর্ষে রয়েছে বাংলাদেশ।
বৃহস্পতিবার (১৯ ডিসেম্বর) সকালে সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের (আইইডিসিআর) অডিটোরিয়ামে ‘নিপাহ ভাইরাসের বিস্তার ও ঝুঁকি বিষয়ক মতবিনিময় সভায়’ এ তথ্য জানানো হয়।
সভায় বিশেষজ্ঞরা জানান, দেশে নিপাহ ভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যু ঘটলেও এ নিয়ে সচেতনতা কম। খেজুরের রস একেবারে না খাওয়াটাই যেখানে বাঁচার উপায়, সেখানে রীতিমতো উৎসব করে রস খাওয়ার আয়োজন করছে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান। আর সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রচার’তো আছেই। একে নিপাহ ভাইরাস ছড়ানোর একটি বিপদ হিসেবে দেখছেন তারা।
জানা গেছে, এ বছর আক্রান্তদের ৫ জনের মাঝে পাঁচজন পুরুষ, একজন নারী। এদের মধ্যে দুইজন শিশুও ছিল। মারা যাওয়া পাঁচজনের মধ্যে দুইজন মানিকগঞ্জের বাসিন্দা। অন্য তিনজন মারা গেছেন খুলনা, শরীয়তপুর ও নওগাঁয়।
মতবিনিময় সভায় দেশে নিপাহ ভাইরাসের সার্বিক পরিস্থিতি তুলে ধরেন সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগনিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউট (আইইডিসিআর) পরিচালক অধ্যাপক ডা. তাহমিনা শিরীন।
তিনি বলেন, ২০০১ সাল থেকে এ পর্যন্ত ৩৪৩ নিপাহ ভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছেন। এর মধ্যে ২৫৫ জনের মৃত্যু হয়েছে, যা মোট আক্রান্তের ৭১ শতাংশ। ৮৮ জন বেঁচে থাকলেও বিভিন্ন শারীরিক জটিলতা ভুগছেন। মানুষ থেকে মানুষের মধ্যে আক্রান্তের হার মধ্যে ২৮ শতাংশ। আক্রান্তদের মধ্যে পুরুষ ৬২ শতাংশ ও নারী ৩৮ শতাংশ।
ডা. তাহমিনা শিরীন জানান, শিশু-কিশোরদের মধ্যে নিপাহ ভাইরাসে আক্রান্ত বেশি, যা মোট আক্রান্তের ৪১ দশমিক ৩৯ শতাংশ। যাদের বয়স ১৮ বছরের নিচে। আর ০-৫ বছর বয়সে আক্রান্ত ৩৩ জন, ৫-১৭ বছরের ১০৯ জন, ১৮-৩০ বছরের ৭৯ জন, ৩১-৪০ বছরের ৬০ জন, ৪১-৫০ বছরের ৩৪ জন, ৫১-৬০ বছরের ২০ জন ও ষাটোর্ধ্ব ৮ জন।
ডা. তাহমিনা শিরীন বলেন, ১৯৯৮-৯৯ মালয়েশিয়া থেকে নিপাহ ভাইরাস ছড়িয়ে পড়ে। পরে সিঙ্গাপুরে দেখা দেয়। ২০১৪ সালে ঘোড়া থেকে মানুষে ছড়ায়। বাংলাদেশ ও ভারতে ২০০১ সাল থেকে ভাইরাসটির প্রকোপ দেখা দেয়। খেজুর রসের মাধ্যমে ছড়ায়। এছাড়া মায়ের বুকের দুধ পানে শিশু নিপাহ ভাইরাসে আক্রান্ত হচ্ছে। এছাড়া মানুষ থেকে মানুষের মধ্যে ছড়াচ্ছে।
দেশের ৩৪ জেলায় নিপাহ ভাইরাস ছড়িয়ে পড়েছে জানিয়ে তিনি বলেন, ১২টি টার্শিয়ারি হাসপাতালে নিপাহ ভাইরাসে আক্রান্তদের পর্যবেক্ষণ কেন্দ্র রয়েছে।
এ সময় ভাইরাসটিতে আক্রান্ত রোগীদের প্রাথমিক লক্ষণ হিসেবে বিশেষজ্ঞরা জানান, জ্বর হওয়ার ব্যাপকতা (১০০ ভাগ)। জ্বরের তাপমাত্রা থাকবে ১০১ দশমিক ৩ ডিগ্রি ফারেনহাইট। জ্বরে আক্রান্ত ব্যক্তির খেজুররস খাওয়ার ইতিহাস থাকলে তিনি নিপাহতে সংক্রমিত হয়েছেন বলে ধরে নিতে হবে। এছাড়া ৯০ শতাংশ ক্ষেত্রে লালা বৃদ্ধি, ৮০ শতাংশ ক্ষেত্রে অজ্ঞানতা, ৭৫ শতাংশের দুর্বলতা, ৭০ শতাংশের মাথাব্যথা, ৬০ শতাংশের শ্বাসকষ্ট, ৫৫ শতাংশের বমি, ৫০ শতাংশ কাশি, তন্দ্রা ভাব ও খিঁচুনির সমস্যা। এছাড়া ব্যক্তিত্বের পরিবর্তন হওয়া,পেশি ব্যথা, বিরক্তি, ডায়রিয়া, জয়েন্টে ব্যথা, শক্ত ঘাড় ইত্যাদি লক্ষণ প্রকাশ পায়।
ডা. তাহমিনা শিরীন বলেন, রস খাওয়ার আট দিনের মধ্যে নিপাহ ভাইরাসের লক্ষণ দেখা দিতে পারে। আক্রান্তদের নিউরোলজিক্যাল সমস্যা দেখা দেয়। দীর্ঘদিন এ সমস্যা থাকতে পারে।
অনুষ্ঠানে বলা হয়, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ (ঢাবি) বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে রস উৎসব হচ্ছে। এতে কাঁচা রসের ব্যাপারে মানুষ আকৃষ্ট হচ্ছে। এতে করে নিপাহ ভাইরাসে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি বাড়ছে, যা উদ্বেগের বিষয়।
অনলাইনসহ বিভিন্ন মাধ্যমে খেজুর রস বিক্রি, বিশেষ করে বিদেশে রপ্তানি করার ক্ষেত্রে সতর্ক হওয়ার আহ্বান জানান রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের সংক্রামক ব্যাধি বিভাগের সহযোগী বিজ্ঞানী ডা. সৈয়দ মইনুদ্দিন সাত্তার। তিনি বলেন, কাঁচা রস রপ্তানি করা হলে বিশ্বে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হবে।
আইইডিসিআর’র এই বৈজ্ঞানিক কর্মকতা ডা. সৈয়দ মইনুদ্দিন সাত্তার বলেন, ১৫ মিনিটের মধ্যে নিপাহ ভাইরাস শনাক্ত করা সম্ভব হবে। আগামী বছরের মধ্যে এ প্রযুক্তি দেশের স্বাস্থ্যসেবায় যুক্ত হবে।
এ সময় নিপাহ থেকে বাঁচতে খেজুরের রস খাওয়ার ব্যাপারে সাবধানতা অবলম্বনেরও পরামর্শ দিয়ে তিনি বলেন, কাঁচা রস খাওয়া বন্ধে প্রয়োজনে প্রজ্ঞাপন দেওয়া যেতে পারে। পাশাপাশি এ ব্যাপারে সচেতনতা সৃষ্টিতে ইসলামসহ বিভিন্ন ধর্মীয় নেতাদের এগিয়ে আসার আহ্বান জানান তিনি।
সময়ের আলো/আরআই