ই-পেপার বৃহস্পতিবার ১৯ ডিসেম্বর ২০২৪
বৃহস্পতিবার ১৯ ডিসেম্বর ২০২৪
ই-পেপার

বৃহস্পতিবার ১৯ ডিসেম্বর ২০২৪

তাবলিগে কেন সংঘাত
দুই পক্ষের অনড় অবস্থানে নিরসন হচ্ছে না দ্বন্দ্ব
প্রকাশ: বৃহস্পতিবার, ১৯ ডিসেম্বর, ২০২৪, ১:৫৯ এএম  (ভিজিট : ৯০)
টঙ্গীর তুরাগতীরে বিশ্ব ইজতেমা ময়দান দখলকে কেন্দ্র করে কাকরাইল মারকাজের মাওলানা জুবায়ের ও দিল্লির মাওলানা সাদ কান্ধলভির অনুসারীদের মধ্যে আবারও সংঘর্ষের ঘটনা ঘটল। এতে অন্তত চারজন নিহত ও বেশ কয়েকজন আহত হয়েছেন।

বুধবারের এই সংঘর্ষের ঘটনায় দুই পক্ষই একে অপরকে দায়ী করছে। যদিও এমন ঘটনা নতুন নয়। তাবলিগের জুবায়ের ও সাদপন্থিদের মধ্যে এর আগেও এমন রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। প্রতিবার ইজতেমা এলেই এমন ঘটনা ঘটছে। সরকারের তরফ থেকে চেষ্টা করা হলেও স্থায়ী সমাধান হচ্ছে না। এক টেবিলে বসানো যাচ্ছে না দুই পক্ষকে। 

সাদপন্থিদের দাবি, এক টেবিলে বসতে দিচ্ছে না তৃতীয় পক্ষ। জবাবে জুবায়েরপন্থিদের দাবি, আলেচনায় না বসে সংঘর্ষের পথ বেছে নিয়েছে সাদপন্থিরা। সমাধান না হওয়ার পেছনে ইসলামি চিন্তাবিদরা শক্তিশালী উদ্যোগ না থাকা ও সরকারের মধ্যপন্থা ভূমিকাকে দায়ী করছেন।

এ প্রসঙ্গে মাওলানা সাদের অনুসারী তাবলিগের সাথি মুয়ায বিন নূর সময়ের আলোকে বলেন, তাবলিগে তৃতীয় পক্ষ ঢুকে গেছে। দুপক্ষ এক টেবিলে বসলে সমাধান হয়ে যাবে। কিন্তু তৃতীয় পক্ষ বসতে দিচ্ছে না। এখানে তৃতীয় পক্ষ হলো হেফাজতে ইসলাম ও কিছু ইসলামি রাজনীতিবিদ ও বক্তা।জুবায়েরপন্থিরাও এত উগ্র নয়। তাদের কিছু বক্তা উসকে দিচ্ছেন।

তিনি বলেন, আমরা টানা ৭ বছর তাবলিগের মাঠসহ বিভিন্ন বিষয় নিয়ে বঞ্চিত হচ্ছি। মন্ত্রণালয় থেকে দাওয়াত দেওয়া হলেও ৪ নভেম্বরের বৈঠকে জুবায়েরপন্থিরা আসেননি। এবারের ঘটনায় সরকারের পক্ষ থেকে আমাদের কিছু জানানো হয়নি। ১৪৪ ধারা মেনে চলেছি। আমরা শীর্ষ মুরুব্বিদের সঙ্গে আলোচনা করে পরবর্তী সিদ্ধান্ত নেব।

জুবায়ের অনুসারী ও হেফাজত নেতা ফজলুল হক কাসেমি সময়ের আলোকে বলেন, সরকার আমাদের কিছু দাবি মেনে নিয়েছে। আমরা টঙ্গী অভিমুখে লং মার্চ কর্মসূচি প্রত্যাহার করেছি। সাদপন্থিরা ভুল পথে আছে। তাদের আলোচনায় বসায় আহ্বান জানাচ্ছি। কিন্তু তারা বসছেন না। গত বছরও তারা হামলা করেছেন। এবার ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়ক ও উপদেষ্টারা চেষ্টা করেছেন কিন্তু তারা কথা রাখেননি। সাদপন্থিদের লালন করছেন অন্যরা। যারা দেশকে অস্থিতিশীল করতে চায় তারাই উসকানি দিচ্ছেন। তৃতীয় পক্ষ বসতে দিচ্ছেন না, সাদপন্থিদের এমন অভিযোগের জবাবে তিনি বলেন, এগুলো অমূলক কথা। আমরা এখনও এক টেবিলে বসার আহ্বান জানাচ্ছি। তারা সাদের অন্ধকারের পথ ছেড়ে আলোর পথে আসুক।  

মাওলানা সাদের বিরোধিতার পেছনে যুক্তি তুলে ধরে জুবায়ের অনুসারী ও হেফাজতের নায়েবে আমির মুহিউদ্দিন রাব্বানী সময়ের আলোকে বলেন, জনগণ সাদপন্থিদের পক্ষে নেই। তাবলিগের নাম নিয়ে তারা সাধারণ মানুষকে ঈমানহারা করছেন। সাদ সাহেব নিজে হাদিস-কুরআন পরিপন্থী বক্তব্য দিচ্ছেন। তার বিভিন্ন বক্তব্যে মহানবী (সা.) সম্পর্কে বিষোদগার করা হয়েছে। সাদপন্থিরা ভ্রান্ত আকিদায় বিশ্বাসী। তিনি এলে দেশে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হবে। আলেম-ওলামাদের সঙ্গে গণ্ডগোল বাধবে। দেশে অস্থিতিশীল পরিস্থিতি তৈরি হতে পারে। 

আর সাদপন্থিদের সমন্বয়ক তৌহিদুল হক সোহেল সময়ের আলোকে বলেন, আমরা ঐক্যের জন্য আহ্বান জানিয়েছি। আমরা বসতে চেয়েছি, তারা রাজি হননি। আমরা উসকানি দিচ্ছি না। তাদের ইজতেমা তারা করবেন, আমাদের আপত্তি নেই। কিন্তু তারা যেসব কথা বলছেন, তা অযৌক্তিক। প্রমাণ করতে পারবেন না মাওলানা সাদ কুরআন-হাদিসের বাইরে কিছু বলেছেন। আমরা সরকারের কাছে সমাধান চাই।  

এ প্রসঙ্গে ইসলামি চিন্তাবিদ অধ্যাপক মোখতার আহমাদ মনে করেন, ইসলামে এটি খুবই দুঃখজনক ঘটনা। ক্ষুদ্র ইস্যুতেই বিভাজন তৈরি হয়ে যাচ্ছে। প্রাণহানির ঘটনা ঘটছে। এখানে দুই পক্ষই দ্বীনি কাজ করছেন। উভয় পক্ষকে ছাড় দিয়ে এক টেবিলে আলোচনায় বসতে হবে। আলেম-ওলামদের কথা শোনা উচিত। সময়ের আলোকে তিনি বলেন, বাংলাদেশ ছাড়া অন্য কোথাও এসব নিয়ে দ্বন্দ্ব সামনে আসছে না। কারোরই ভাষা ইতিবাচক নয়। এখানে সবার উদারতার অভাব আছে, শক্তিশালী কোনো উদ্যোগ নেই। সরকার ধর্মীয় ইস্যুতে সেফ জোনে থাকতে চায় বলে মনে হচ্ছে।

মানারাত ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভাসির্টির ভারপ্রাপ্ত উপাচার্য অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ আবদুর রব বলেন, ইসলাম শান্তির ধর্ম। এখানে শান্তির জন্য কাজ করতে হবে। প্রতিহিংসা-জিঘাংসা  পরিহার করতে হবে। সবাইকে আইনশৃঙ্খলা মেনে চলতে হবে। মানবতার স্ফূরণ ঘটাতে না পারলে এসব ঘটনার পুনরাবৃত্তি হবে। তিনি বলেন, তাবলিগের উভয় পক্ষকেই সরকারের কথা শুনতে হবে। সরকারকে নিরপেক্ষ জায়গা থেকে দায়িত্ব পালন করতে হবে এবং যথাযথ আইন প্রতিষ্ঠা করতে হবে।

এ ঘটনায় গতকাল স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টাসহ ৫ উপদেষ্টা ও বাহিনী প্রধানদের সঙ্গে আলাদা বৈঠক করেন জুবায়ের ও সাদপন্থিরা। সবাই প্রাণহানির ঘটনাকে দুঃখজনক মনে করছেন। টঙ্গীর ইজতেমা মাঠ ত্যাগ করেছেন তাদের মুসল্লিরা। সবার কাছে প্রশ্ন ছিল, সমাধান কোথায়? এর জবাব সব পক্ষই এড়িয়ে গেছেন।

তাবলিগের দুই পক্ষের মধ্যে সংঘর্ষে হতাহতের ঘটনায় গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন ইসলামি আন্দোলন বাংলাদেশের সিনিয়র নায়েবে আমির মুফতি সৈয়দ মুহাম্মাদ ফয়জুল করীম শায়খে চরমোনাই। বিবৃতিতে তিনি বলেন, মাওলানা সাদের কিছু বক্তব্যকে কেন্দ্র করে তাবলিগ জামায়াতে দুটি ধারা তৈরি হয়েছে। যা দুঃখজনক হলেও একে কেন্দ্র করে দুই পক্ষ সংঘাতে জড়িয়ে পড়া উদ্বেগজনক এবং মুসলিম উম্মাহর জন্য খারাপ দৃষ্টান্ত। বিশেষ করে ২০২৫-এর ইজতেমাকে কেন্দ্র করে যে ঘটনা ঘটছে তা কল্পনাতীত। ইসলামের দাওয়াতি মেজাজ, তাবলিগের ইতিহাস, চরিত্র বিবেচনায় এমন হানাহানি ও মৃত্যুর কথা চিন্তাও করা যায় না।

বিরোধ যেখান থেকে শুরু
তাবলিগ জামাতের দুই পক্ষ দিল্লির মাওলানা সাদ কান্ধলভি এবং বাংলাদেশের কাকরাইল মারকাজের মাওলানা জুবায়ের আহমদের অনুসারীদের বিরোধের শুরু ২০১৯ সালে। আগে একমঞ্চ থেকে একবারই বিশ্ব ইজতেমা হলেও মতভেদের কারণে দুই পক্ষ বিশ্ব ইজতেমা দুইবারে করার সিদ্ধান্ত নেয়। মাঝে কোভিড মহামারির কারণে ইজতেমা দুই বছর বন্ধ থাকে। ২০২২ সাল থেকে ফের ইজতেমা হচ্ছে দুই পর্বের আয়োজনে। সেই ধারাবাহিকতা ধরে রেখে এবারও টঙ্গীর তুরাগতীরে দুই পর্বে হবে তাবলিগ জামাতের সবচেয়ে বড় জমায়েত বিশ্ব ইজতেমা। আগামী বছর প্রথম পর্বে ৩১ জানুয়ারি থেকে ২ ফেব্রুয়ারি ইজতেমায় অংশ নেবেন ‘জুবায়েরপন্থিরা’ এবং দ্বিতীয় পর্বে ৭ থেকে ৯ ফেব্রুয়ারি অংশ নেবেন ‘সাদপন্থিরা’। গত ১৭ নভেম্বর এমন সিদ্ধান্তের কথা জানিয়েছে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়।

প্রথম পর্বের আয়োজকরা তাদের আয়োজন শেষে ঢাকার বিভাগীয় কমিশনারের নেতৃত্বে গঠিত বিশ্ব ইজতেমার মাঠ প্রস্তুতি সংক্রান্ত কমিটিকে ৪ ফেব্রুয়ারি বেলা ৩টার মধ্যে ইজতেমার মাঠ বুঝিয়ে দেবেন। দ্বিতীয় পর্বের আয়োজনকারীরা একই দিন বিকালে কমিটির কাছ থেকে ইজতেমার মাঠ বুঝে নেবেন। দ্বিতীয় পর্বের ইজতেমা শেষে ১১ ফেব্রুয়ারি দুপুরে তারা কমিটির কাছে মাঠ হস্তান্তর করবেন। তবে সম্প্রতি তাবলিগ জামাতের দুই পক্ষের পাল্টাপাল্টি বক্তব্যের জেরে তাদের মধ্যে চলমান বিবাদ নতুন রূপ পায়।

গত ৫ নভেম্বর সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে ‘ওলামা-মাশায়েখদের ইসলামি মহাসম্মেলন’ থেকে সাদপন্থিদের নিষিদ্ধ করাসহ ৯ দফা দাবি জানান জুবায়েরপন্থিরা, যারা নিজেদের ‘শূরায়ে নিজাম’ পরিচয় দিয়ে থাকেন। এরপর ১২ নভেম্বর কাকরাইল মসজিদ ও টঙ্গীর বিশ্ব ইজতেমার মাঠে সাদপন্থিদের প্রবেশের সুযোগ দিলে ২৪ ঘণ্টার মধ্যে ঢাকা অচলের হুঁশিয়ারি দেন জুবায়েরপন্থিরা। এমন উত্তেজনার মধ্যেই দুই পক্ষের ‘সমঝোতার ভিত্তিতে’ গত ১৫ নভেম্বর ঢাকার কাকরাইল মসজিদে সাদপন্থিদের ব্যাপক জমায়েত দেখা যায়।

এর আগে ২০১৮ সালেও টঙ্গীতে জোড় ইজতেমাকে কেন্দ্র করে দুই পক্ষের সংঘর্ষে সত্তর বছর বয়সি এক বৃদ্ধ নিহত হন, আহত হন দুই শতাধিক।

সময়ের আলো/আরএস/ 




https://www.shomoyeralo.com/ad/1698385080Google-News-Update.jpg

সর্বশেষ সংবাদ

সর্বাধিক পঠিত


ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক : সৈয়দ শাহনেওয়াজ করিম, আমিন মোহাম্মদ মিডিয়া কমিউনিকেশন লিমিটেড এর পক্ষে প্রকাশক গাজী আহমেদ উল্লাহ। নাসির ট্রেড সেন্টার, ৮৯, বীর উত্তম সি আর দত্ত সড়ক (সোনারগাঁও রোড), বাংলামোটর, ঢাকা।
ফোন : +৮৮-০২-৯৬৩২৩৬৮-৭৪, ফ্যাক্স : +৮৮-০২-৯৬৩২৩৭৫ | ই-মেইল : shomoyeralo@gmail.com
close