সংবিধানের যে পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বিলোপ করা হয়েছিল, তার কিছু অংশ বাতিল করেছেন হাইকোর্ট। এর ফলে দলীয় সরকারের অধীনে সংসদ নির্বাচনের বিধান বাতিল হয়ে গেল। তার জায়গায় ফিরল নির্বাচনকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা।
গতকাল মঙ্গলবার বিচারপতি ফারাহ মাহবুব ও বিচারপতি দেবাশীষ রায় চৌধুরীর সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট বেঞ্চ এ রায় দেন। শুধু রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা দখল এবং ক্ষমতায় টিকে থাকার জন্য আওয়ামী লীগ সভানেত্রী পলাতক ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনা তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা নিয়ে যে নির্লজ্জ প্রহসনের আশ্রয় নিয়েছিলেন তা আধুনিক বিশ্বের রাজনৈতিক ইতিহাসের একটি বিরল ঘটনা এবং এর ইতিহাসও বেশ দীর্ঘ।
আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনা নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবি প্রথমবারের মতো সামনে নিয়ে আসেন ১৯৯৩ সালের শেষদিকে। নব্বইয়ের গণআন্দোলনে সামরিক স্বৈরাচারী এরশাদের পতন এবং পঞ্চম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের পরাজয়ের পটভূমিতে এ পরাজয়ের গ্লানি এবং ভবিষ্যতে ক্ষমতায় যাওয়ার বাসনাকে ধারণ করে তিনি এ দাবি উত্থাপন করেন। পরবর্তীকালে আওয়ামী লীগ, জাতীয় পার্টি ও জামায়াতে ইসলামী এ দাবিতে আন্দোলন শুরু করে। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অভিন্ন রূপরেখা ঘোষণা করে। বিএনপি চেয়ারপারসন, তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়া বিরোধী দলগুলোর এ দাবিকে নানাভাবে সমালোচনা করলেও তিনি বরাবরই সাংবিধানিক প্রক্রিয়ার মধ্যে সব সমস্যার সমাধান সম্ভব বলে আশা প্রকাশ করেন। একই সঙ্গে তিনি বিরোধী দলগুলোকে সংসদে এসে সাংবিধানিক কাঠামোর মধ্যে আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে সমস্যা সমাধানের আহ্বান জানান। অন্যদিকে বাম গণতান্ত্রিক ফ্রন্ট নেতা ও ওয়ার্কার্স পার্টির তৎকালীন সাধারণ সম্পাদক রাশেদ খান মেনন এমপি জামায়াতে ইসলামী, জাতীয় পার্টি ও আওয়ামী লীগের দেওয়া তত্ত্বাবধায়ক ফর্মুলা মেনে নেওয়ার চেয়ে আত্মহত্যাই শ্রেয় বলে তিনি মন্তব্য করেন।
তিনি বলেন, নব্বইয়ের গণআন্দোলনের এরশাদের পতনের পর তার দল উত্থাপিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিকে আওয়ামী লীগ একটি অসভ্য প্রস্তাব হিসেবে আখ্যায়িত করেছিল। এরশাদের পতনের ছয় ঘণ্টা আগে মওদুদ আহমদ তত্ত্বাবধায়ক সরকারকে অসাংবিধানিক আখ্যা দিয়েছিলেন। তিনি আরও বলেন, জামায়াত চায় মধ্যযুগীয় ব্লাসফেমি আইন। জাতীয় পার্টি চায় এরশাদের মুক্তি। আর আওয়ামী লীগ চায় যেকোনোভাবে ক্ষমতায় যেতে।
আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনা তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবি প্রথমবারের মতো প্রকাশ্য জনসভায় তোলেন ১৯৯৩ সালের ৬ ডিসেম্বর ‘স্বৈরাচারের পতন ও গণতন্ত্র দিবস’ উপলক্ষে বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউতে আওয়ামী লীগ আয়োজিত জনসভায়। এদিন তিনি বলেন, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য আওয়ামী লীগ জাতীয় সংসদে সংবিধান সংশোধনী বিল আনবে। বিএনপি যাতে এই বিল পাস করতে বাধ্য হয় এ জন্য তিনি আন্দোলন গড়ে তোলার আহ্বান জানান।
এরপর আওয়ামী লীগ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবিতে অভিন্ন কর্মসূচি গ্রহণে সংসদের সব বিরোধী দলের সঙ্গে আনুষ্ঠানিক আলোচনা শুরু করে। ১৯৯৪ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি বৃহস্পতিবার শেখ হাসিনার আহ্বানে সংসদের সব বিরোধী দল ও গ্রুপের নেতৃবৃন্দ এক যৌথ বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। এরই ধারাবাহিকতায় ওই বছর ২৬ এপ্রিল থেকে আওয়ামী লীগ, জাতীয় পার্টি ও জামায়াতে ইসলামী যৌথভাবে তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রতিষ্ঠার দাবিতে হরতাল, অবরোধ, মশাল মিছিল, পদযাত্রাসহ নানা কর্মসূচি পালন করে। চুরানব্বই সালের ২৭ জুন আওয়ামী লীগ, জাতীয় পার্টি এবং জামায়াতে ইসলামী তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অভিন্ন রূপরেখা ঘোষণা করে এবং সংসদ ভেঙে দিয়ে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবিতে ১৯৯৪ সালে ২৮ ডিসেম্বর পঞ্চম জাতীয় সংসদের ১৪৭ জন বিরোধীদলীয় সংসদ সদস্য একযোগে পদত্যাগ করেন। এদিন আওয়ামী লীগ, জাতীয় পার্টি, জামায়াতে ইসলামী ও এনডিপির সদস্যরা স্পিকারের কাছে পদত্যাগপত্র জমা দেন।
স্যার নিনিয়ানের ফর্মুলা প্রত্যাখ্যান : তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবিতে অভিন্ন কর্মসূচির মাধ্যমে আওয়ামী লীগ, জাতীয় পার্টি ও জামায়াতে ইসলামীর আন্দোলনের প্রেক্ষাপটে রাজনৈতিক সংকট নিরসনে সরকারি ও বিরোধীদের দলের সমঝোতার লক্ষ্যে কমনওয়েলথ মহাসচিব চিফ এমেকা এনিয়াওকুর বিশেষ দূত স্যার নিনিয়ান স্টিফেন ১৯৯৪ সালের ১৩ অক্টোবর ঢাকায় আসেন। ঢাকার আসার পর থেকে তিনি প্রায় মাসব্যাপী উভয় দলের নেতৃবৃন্দের সঙ্গে দফায় দফায় সংলাপের মধ্যস্থতা করেন। সংলাপের এক পর্যায়ে তিনি একটি ফর্মুলা উত্থাপন করেন। এতে স্যার নিনিয়ান সাংবিধানিক কাঠামোর আওতায় নির্বাচনের সময় তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে ১১ সদস্যের একটি সর্বদলীয় মন্ত্রিসভা গঠনের কথা বলেন। এই সরকারের প্রধানমন্ত্রীসহ সরকারি দলের ৫ জন এবং বিরোধী দলের ৫ জন মন্ত্রী থাকবেন। এরা সবাই বর্তমান পঞ্চম জাতীয় সংসদের নির্বাচিত এমপিদের মধ্যে থেকে মনোনীত হবে। এ ছাড়া বাকি একজন নির্দলীয়-নিরপেক্ষ ব্যক্তি মন্ত্রিসভায় অন্তর্ভুক্ত হবেন। যার ওপর স্বরাষ্ট্র, সংস্থাপন এবং তথ্য মন্ত্রণালয়ের মতো গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয়গুলোর ভার ন্যস্ত থাকবে। সরকারি ও বিরোধী দলের মধ্যে সংলাপে সহায়তাকারী স্যার নিনিয়ান স্টিফেন সংসদ উপনেতার নেতৃত্বে বিএনপির একটি প্রতিনিধি দল এবং আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে এ বিষয়ে পৃথকভাবে আলাপ করে তাদের মনোভাব জানতে চেষ্টা করেন। নিনিয়ানের এই প্রস্তাবে ক্ষমতাসীন বিএনপি সম্মতি জানালেও বিরোধীদলীয় নেত্রী শেখ হাসিনা প্রত্যাখ্যান করেন। তিনি জানিয়ে দেন তত্ত্বাবধায়ক ছাড়া অন্য কোনো ফর্মুলা তিনি মানবেন না। একই সঙ্গে আওয়ামী লীগ স্যার নিনিয়ানের বিরুদ্ধে পক্ষপাতদুষ্টতার অভিযোগ আনে এবং তার বিরুদ্ধে এ অভিযোগ উল্লেখ করে কমনওয়েলথ মহাসচিব চিফ এমেকা এনিয়াওকুর কাছে ফ্যাক্স বার্তা পাঠায়। কমনওয়েলথ চিফ এমেকা এনিয়াওকু আওয়ামী লীগের এ অভিযোগ নাকচ করে দেন। পাকিস্তান সফররত কমনওয়েথ চিফ ইসলামাবাদে এক সংবাদ সম্মেলনে বলেন, নিনিয়ান কোনো পক্ষপাতিত্ব করেননি। সবমিলিয়ে তত্ত্বাবধায়ক সরকার বিষয়ে সমঝোতার উদ্যোগ ব্যর্থ হয়ে যায়। এ প্রেক্ষিতে বিদায়ি সংবাদ সম্মেলনে স্যার নিনিয়ান সাংবাদিকদের কাছে হতাশা প্রকাশ করে বলেন, সহিংসতা ও হাঙ্গামার মাধ্যমে কিছুই অর্জিত হবে না। সহিংসতা ও হাঙ্গামা শুধু ক্ষোভ আর হতাশার পথেই দেশকে নিয়ে যাবে। ব্যর্থ মিশন শেষে তিনি ১৪ নভেম্বর দেশে ফিরে যান।
সহিংসতায় নিহত প্রায় অর্ধশত : তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রতিষ্ঠার দাবিতে ১৯৯৪, ১৯৯৫ ও ১৯৯৬ সালের আন্দোলনে আওয়ামী লীগ, জাতীয় পার্টি এবং জামায়াতে ইসলামী অভিন্ন কর্মসূচির মাধ্যমে মোট ৯৬ দিন হরতাল, অবরোধ এবং অসহযোগ কর্মসূচি পালন করে। এর মধ্যে ৭০ দিন হরতাল-অবরোধ এবং ২৬ দিন অসহযোগ। এসব কর্মসূচিতে সকাল-সন্ধ্যা হরতালের পাশাপাশি একটি লাগাতার ৯৬ ঘণ্টা, দুটি ৭২ ঘণ্টা এবং পাঁচটি ৪৮ ঘণ্টার হরতাল ডাকা হয়। আর ২৬ দিনের অসহযোগ কর্মসূচির মধ্যে লাগাতার পালিত হয় ২২ দিন। আন্দোলনের এক পর্যায়ে প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়াকে টার্গেট করে হরতালের কর্মসূচি দেয় আওয়ামী লীগ, জাতীয় পার্টি ও জামায়াতে ইসলামী। এ ক্ষেত্রে ১৯৯৬ সালের নির্বাচনে প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া যেখানেই নির্বাচনি সফরে যান সে জেলাতেই হরতাল ডাকা হয়। বিরোধী দলগুলোর জাতীয় ও আঞ্চলিকভাবে ডাকা এসব কর্মসূচিতে ব্যাপক ভাঙচুর, বোমাবাজি, ককটেল নিক্ষেপ, অগ্নিসংযোগ ও গোলাগুলির ঘটনা ঘটে এবং সহিংসতায় নিহত হয় প্রায় অর্ধশত মানুষ-আহত হয় সহস্রাধিক। ১৯৯৬ সালের ১৬ ফেব্রুয়ারি দৈনিক সংবাদে প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে বলা হয়, শুধু ১৫ ফেব্রুয়ারির নির্বাচনের দিন হরতাল ও গণকারফিউ কর্মসূচিতে দেশের বিভিন্ন স্থানে সংঘর্ষে ১৫ জন নিহত এবং আহত হয় আরও ছয় শতাধিক মানুষ।
বিরোধী দলগুলোর হরতাল, অবরোধ এবং অসহযোগ কর্মসূচিতে আওয়ামী লীগ, জাতীয় পার্টি ও জামায়াতে ইসলামীর শীর্ষ পর্যায়ের নেতারা রাজধানীর বিভিন্ন সড়কে পিকেটিংয়ে অংশ নেন। এরা হলেন-আওয়ামী লীগের জিল্লুর রহমান, আবদুর রাজ্জাক, আমির হোসেন আমু, তোফায়েল আহমেদ, সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত, মতিয়া চৌধুরী, অ্যাডভোকেট সাহারা খাতুন, জাতীয় পার্টির ব্যারিস্টার মওদুদ
আহমেদ, কাজী জাফর আহমেদ, আনোয়ার হোসেন মঞ্জু, কাজী ফিরোজ রশীদ, জামায়াতে ইসলামীর আলী আহসান মুজাহিদ প্রমুখ।
১৯৯৬ সালের ৩ জানুয়ারি আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনা বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউতে আয়োজিত এক জনসভায় বলেন, প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়া ভেবেছেন রোজার মাসে হরতাল হবে না। ইচ্ছেমতো ভোট চুরি করে একদলীয় নির্বাচন করিয়ে নেবেন। কিন্তু তিনি জানেন না রোজার মাসেও যুদ্ধ হয়েছিল। আর লাগাতার ৯৬ ঘণ্টা হরতাল চলাকালে ১৯৯৫ সালের ১৮ অক্টোবর ফার্মগেটের এক সমাবেশে শেখ হাসিনা বলেন, এ সরকার হরতাল ছাড়া আন্দোলনের কোনো ভাষা বোঝে না। হরতালে মানুষের দুঃখ-কষ্ট হয়। কিন্তু এ ছাড়া আমাদের করাই বা কী আছে?
তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিল পাস : তত্ত্বাবধায়ক সরকার বিষয়ে কমনওয়েলথ মহাসচিব চিফ এমেকা এনিয়াওকুর বিশেষ দূত স্যার নিনিয়ান স্টিফেনের সমঝোতা উদ্যোগ নিস্ফল হওয়া এবং আওয়ামী লীগ, জাতীয় পার্টি, জামায়াতে ইসলামীর সংসদ থেকে একযোগে পদত্যাগের মাধ্যমে লাগাতার হরতাল, অবরোধ ও অসহযোগ আন্দোলনের মধ্যে ১৯৯৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি ষষ্ঠ জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। এই নির্বাচনে বিএনপি নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন অনুষ্ঠানের দাবিতে আওয়ামী লীগ, জাতীয় পার্টি ও জামায়াতে ইসলামীসহ কয়েকটি রাজনৈতিক দল এই নির্বাচন বর্জন করে। অন্যদিকে এই নির্বানের আগে এবং পরে বিএনপি চেয়ারপারসন প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়া বলেন, দেশের সাংবিধানিক ধারাবাহিকতা ও গণতন্ত্রকে রক্ষার জন্য এই নির্বাচন অনুষ্ঠান প্রয়োজন। এই নির্বাচনে যেসব বিরোধী দল অংশ নেয়নি তাদের সঙ্গে আলোচনা করতে চাই। আলোচনায় সবাই মিলে এমন পরিবেশ সৃষ্টি করতে চাই যাতে ভবিষ্যতে সব দল নির্বাচনে অংশ নিতে পারে।
একই সঙ্গে তিনি বলেন, ষষ্ঠ জাতীয় সংসদের প্রথম অধিবেশনেই নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিল পাস করা হবে। এরই ধারাবাহিকতায় ১৯৯৬ সালের ২১ মার্চ ষষ্ঠ জাতীয় সংসদের প্রথম অধিবেশন শুরু হয় এবং এ দিনই তত্ত্বাবধায়ক সরকারে বিল উত্থাপন করা হয়। উদ্ভূত অস্থিতিশীল রাজনৈতিক পরিস্থিতি এবং অসাংবিধানিক শক্তির অশুভ তৎপরতার প্রেক্ষাপটে ২৫ মার্চ রাতভর আলোচনা শেষে ভোররাতে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিল পাস হয়। সংবিধানের ত্রয়োদশ সংশোধনী গৃহীত হয়। নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিল পাসের পর প্রধানমন্ত্রী ও সংসদ নেত্রী বেগম খালেদা জিয়া ২৬ মার্চ সকাল ৬টায় জাতীয় সংসদে সংক্ষিপ্ত ভাষণে বলেন, আমি আমার প্রতিশ্রুতি পূরণ করলাম।
পরদিন (২৭ মার্চ বুধবার) সন্ধ্যায় প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়া বঙ্গভবনে রাষ্ট্রপতি আবদুর রহমান বিশ্বাসের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন এবং রাষ্ট্রপতিকে ষষ্ঠ জাতীয় সংসদে সর্বসম্মতিক্রমে পাস করা নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠন সংক্রান্ত সংবিধান সংশোধনসহ বিল যত তাড়াতাড়ি সম্ভব অনুমোদনের জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের অনুরোধ জানান। ২৮ মার্চ বৃহস্পতিবার রাষ্ট্রপতি আইন অনুযায়ী নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিলে সম্মতি দেন। রাষ্ট্রপতির এই সম্মতির পর বিলটি সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত হয়। ফলে সংবিধান অনুযায়ী নির্বাচনকালীন নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠনের পথ সুগম হয়। ২৯ মার্চ শুক্রবার সন্ধ্যায় প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়া আবারও বঙ্গভবনে রাষ্ট্রপতিআবদুর রহমান বিশ্বাসের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। এ সময় তিনি দ্রুততম সময়ের মধ্যে নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠন এবং মে মাসের মধ্যে নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য রাষ্ট্রপতি আবদুর রহমান বিশ্বাসের প্রতি অনুরোধ জানান।
হাবিবুর রহমানের শপথগ্রহণ : ৩০ মার্চ শনিবার বিকালে তৎকালীন জ্বালানি ও খনিজ সম্পদমন্ত্রী অলি আহমদ সংসদ বিলুপ্ত করার জন্য প্রধানমন্ত্রীর লিখিত অনুরোধ রাষ্ট্রপতির কাছে পৌঁছে দেন। এরই ধারাবাহিকতায় এদিন রাষ্ট্রপতি আবদুর রহমান বিশ্বাস ষষ্ঠ জাতীয় সংসদ বিলুপ্ত ঘোষণা করেন এবং রাতে বঙ্গভবনে এক অনাড়ম্বর অনুষ্ঠানে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টা হিসেবে সুপ্রিমকোর্টের সবশেষ অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি মুহাম্মদ হাবিবুর রহমানকে শপথবাক্য পাঠ করান। এ অনুষ্ঠানে বিদায়ি প্রধানমন্ত্রী ও বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া, আওয়ামী লীগ সভানেত্রী ও পঞ্চম জাতীয় সংসদের বিরোধীদলীয় নেত্রী শেখ হাসিনা, রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ, সুপ্রিমকোর্টের বিচারপতি, কূটনৈতিকবৃন্দ এবং উচ্চপদস্থ সামরিক ও বেসামরিক কর্মকর্তারা অংশ নেন। এদিন এক বিবৃতির মাধ্যমে আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনা তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাফল্য কামনা করেন এবং অসহযোগ আন্দোলন প্রত্যাহার করার ঘোষণা দেন। একই সঙ্গে তিনি তার দলের পক্ষ থেকে বিচারপতি হাবিবুর রহমানের নেতৃত্বে তত্ত্বাবধায়ক সরকারকে সব ধরনের সহযোগিতা দেওয়ার আশ্বাস দেন। বিবৃতিতে তিনি বলেন, জনগণের অপরিসীম ত্যাগ ও তিন দলের আন্দোলনের ফলে বিএনপি তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রতিষ্ঠার দাবি মানতে বাধ্য হয়েছে। বাঙালি জাতি আর একবার প্রমাণ করেছে জনতার ঐক্যবদ্ধ সংগ্রামের কাছে কোনো স্বৈরাচারী শক্তি টিকে থাকতে পারে না। ন্যায্য ও সত্যের সংগ্রাম সবসময় জয়ী হয়।