আমাদের দেশের মানুষ এ মাসে বিজয়ের স্বাদ লাভ করেছে। তাই ডিসেম্বর এলেই ধর্মপ্রাণ মানুষের হৃদয়ে জাগে বিজয়ের শুকরিয়া জ্ঞাপন। বিজয় সম্পর্কে কুরআনের দুটি সুরা আমাদের সামনে হাজির রয়েছে। একটি সুরা ফাতাহ (বিজয়), আরেকটি সুরা নাসর (মুক্তি ও সাহায্য)। সুরা নাসরে আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘যখন আল্লাহর পক্ষ থেকে সাহায্য ও বিজয় আসবে এবং আপনি মানুষকে দলে দলে ইসলামে প্রবেশ করতে দেখবেন তখন আপনার পালনকর্তার পবিত্রতা বর্ণনা করুন ও তাঁর কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করুন। নিশ্চয় তিনি ক্ষমাকারী।’ এ সুরায় বিজয়ের সময়ে মুসলমানদের পালনীয় তিনটি কাজের প্রতি ইঙ্গিত করা হয়েছে ১. এই সময়ে আল্লাহর পবিত্রতা ও বড়ত্ব বর্ণনা করা ২. আল্লাহর শুকরিয়া ও কৃতজ্ঞতা আদায় করা ৩. যুদ্ধ চলাকালে যদি ভুলত্রুটি হয়ে থাকে সে জন্য আল্লাহ তায়ালার কাছে কায়মনোবাক্যে ক্ষমা চাওয়া। বিজয়ের মাসে এই তিনটি আমাদের প্রধানতম কাজ। আল্লাহ তায়ালার এই তিনটি নির্দেশনার মধ্যে অনেক তাৎপর্য নিহিত রয়েছে। বিজয়ের স্বাদ অর্জন করতে অনেক জানমালের ক্ষতি হয়েছে। অনেক ত্যাগের বিনিময়ে আল্লাহ তায়ালা আমাদের বিজিত ও স্বাধীন মাতৃভূমি দান করেছেন। যে দেশে আমরা বাংলা ভাষায় সবকিছু করতে পারব। আমাদের কথা বলার অধিকার, অর্থনৈতিক অধিকার, রাজনৈতিক, সামাজিক ও ধর্মীয় অধিকার ফিরে পাব। এ এক অপূর্ব পাওয়া। বিজয় অর্জন আর স্বাধীন হওয়ার চেয়ে বড় আনন্দ কী হতে পারে? এ কারণেই আল্লাহ নির্দেশ দিলেন তোমরা বিজয় লাভ করেছ, এখন তোমাদের কাজ হচ্ছে এ বিজয়ের জন্য আল্লাহর দরবারে সেজদায় লুটিয়ে পড়ে কিংবা তসবিহ পাঠ করে তাঁর কাছে
কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করা। শুধু কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করলেই হবে না। যেসব ভুলত্রুটি হয়েছে, অন্যের অধিকার নষ্ট হয়েছে এর জন্য আল্লাহ তায়ালার কাছে ক্ষমাও চাইতে হবে।
মুসলিম রাষ্ট্রের প্রতিটি নাগরিকের দায়িত্ব হলো তার
মাতৃভূমিকে ভালোবাসা। এটাই রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর আদর্শ। আল্লাহর রাসুল যখন মাতৃভূমি মক্কা ছেড়ে মদিনার দিকে পাড়ি জমাচ্ছিলেন তখন তাঁর দুচোখ দিয়ে অশ্রু বয়ে যাচ্ছিল। তিনি মনে মনে বলেছিলেন, ‘হে মক্কাবাসী! আমি তোমাদের ভালোবাসি। কাফেররা নির্যাতন করে যদি আমাকে বের করে না দিত কখনোই আমি তোমাদের ছেড়ে যেতাম না’ (ইবনে কাসির : ৩/৪০৪)।
হাদিসের বর্ণনায় রয়েছে, রাসুলুল্লাহ (সা.) মদিনাকে অনেক ভালোবাসতেন। কোনো সফর থেকে ফেরার সময় মদিনার সীমান্তে অবস্থিত উহুদ পাহাড় চোখে পড়লে রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর চেহারায় আনন্দের আভা ফুটে উঠত। তখন তিনি বলতেন, ‘এই উহুদ পাহাড় আমাদের ভালোবাসে, আমরাও উহুদ পাহাড়কে ভালোবাসি।’ (বুখারি : ২/৫৩৯)
যে মক্কা নগরী থেকে প্রিয় রাসুল হজরত মুহাম্মদ (সা.) বিতাড়িত হলেন, ১০ বছর পর হাজার হাজার সাহাবির বিশাল কাফেলা নিয়ে যখন তিনি বিজয়ী বেশে সেই মক্কায় প্রবেশ করলেন, তখন তিনি যা করেছিলেন তা নিম্নের বর্ণনা থেকে জানা যায়, আল্লামা ইবনুল কাইয়িম জাওযি (রহ.) তার কালজয়ী গ্রন্থ ‘যাদুল মাআদে’ উল্লেখ করেন, আল্লাহর নবী (সা.) একটি উষ্ট্রীর ওপর আরোহিত ছিলেন, তাঁর চেহারা ছিল নিম্নগামী (অর্থাৎ আল্লাহর দরবারে বিনয়ের সঙ্গে তিনি মক্কায় প্রবেশ করেন)। প্রথম তিনি উম্মে হানির ঘরে প্রবেশ করেন। সেখানে আট রাকাত নফল নামাজ আদায় করেন। এই নামাজকে বলা হয় বিজয়ের নামাজ। এরপর তিনি হারাম শরিফে এসে সমবেত জনতার উদ্দেশে ভাষণ দেন। তিনি বলেন, হে মক্কার কাফের সম্প্রদায়! তেরো বছর ধরে আমার ওপর, আমার পরিবারের ওপর, আমার সাহাবিদের ওপর নির্যাতনের যে স্টিমরোলার চালিয়েছ এর বদলায় আজ তোমাদের কি মনে হয় প্রতিশোধ গ্রহণ করব? তারা বলল হ্যাঁ, আমরা কঠিন অপরাধী। কিন্তু আমাদের বিশ্বাস আপনি আমাদের উদার ভাই, উদার সন্তান, আমাদের সঙ্গে উদারতা, মহানুভবতা প্রদর্শন করবেন। এটাই আমরা প্রত্যাশা করি। আল্লাহর রাসুল (সা.) বললেন হ্যাঁ, আমি আজ তোমাদের সবার জন্য হজরত ইউসুফ (আ.)-এর মতো সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা করলাম। যাও তোমাদের প্রতি কোনো প্রতিশোধ গ্রহণ করা হবে না। (সুনানে বাইহাকি : ৯/১১৮)
রাসুলুল্লাহ (সা.) তাঁর কথা অনুযায়ী কারও ওপর প্রতিশোধ গ্রহণ করেননি, কোনো অপরাধীর বিচার করেননি বরং সবাইকে সাধারণ ক্ষমা করে দিয়েছিলেন। ইচ্ছা করলে তিনি অপরাধীদের সঙ্গে যা খুশি তাই করতে পারতেন। কিন্তু তা না করে সবাইকে ক্ষমা করে মুক্ত ও স্বাধীন করে দিয়েছিলেন। কারণ তিনি জানতেন যাবতীয় ক্ষমতার মালিক কেবল আল্লাহ রাব্বুল আলামিন। পবিত্র কুরআনে আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘(হে নবী) আপনি বলুন, হে রাজাধিরাজ (মহান আল্লাহ) আপনি যাকে ইচ্ছা তাকে সাম্রাজ্য দান করেন, আবার যার কাছ থেকে ইচ্ছা তা কেড়েও নেন, যাকে ইচ্ছা আপনি সম্মানিত করেন, আবার যাকে ইচ্ছা অপমানিত করেন। সব রকমের কল্যাণ তো আপনার হাতেই, নিশ্চয়ই আপনি সবকিছুর ওপর একক ক্ষমতাবান।’ (সুরা আলে ইমরান, আয়াত : ২৬)
বিশ্বনবী (সা.) মক্কা বিজয়ের দিন আরও একটি কাজ করেছিলেন, তিনি কাবাঘরে রক্ষিত মূর্তিগুলো ভেঙে বের করে দিয়ে আল্লাহর ঘরকে পবিত্র ঘোষণা করেছিলেন। তাই বিজয়ের এই দিনে মুসলমানদের উচিত মন-মগজ থেকে ইসলাম ও আল্লাহ বিরোধিতা সরিয়ে ফেলে তাওহিদকে প্রতিষ্ঠা করা এবং পরিপূর্ণরূপে আল্লাহর দরবারে সমর্পিত হওয়া। তাই আসুন, ইসলামের আলোকে বিজয়ের মাস উদযাপন করি, সব ধর্মের মানুষ মিলেমিশে অবস্থান করি এবং আমাদের লাল-সবুজের এই দেশকে আরও বেশি স্বনির্ভর করে তুলে এ দেশের বিজয় ও স্বাধীনতাকে চিরদিন অক্ষুণ্ন রাখার চেষ্টা করি।
সময়ের আলো/জেডআই