তৃতীয় বিশ্বের উন্নয়নশীল দেশ বাংলাদেশ। জীবনকে বাঁচাতে জীবনের পেছনে ছুটে বেড়ায় এ দেশের বেশিরভাগ মানুষ। কিন্তু তারা যথেষ্ট রাজনীতি সচেতন। দেশের রাজনীতি কোন দিকে যাচ্ছে, এর গতি-প্রকৃতি কী, কোথায় কোন ধরনের নির্বাচন হচ্ছে বা হবে সবই তারা জানে। পত্রপত্রিকা পড়ে, টেলিভিশন দেখে, বেতার শোনে কিংবা অনলাইনে তারা সব খবর পায়। প্রায়ই দেখা যায় রাস্তার ধারে টং দোকানে জটলা বেঁধে মানুষ টেলিভিশনে খবর দেখছে। তারপরও রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে খবর দেখছে। এ থেকে প্রমাণিত হয় তারা যথেষ্ট সচেতন। নির্বাচনের ব্যাপারে এ দেশের সাধারণ মানুষের আগ্রহের এতটুকু কমতি নেই। বিষয়টা নির্বাচন কমিশনসহ সবাই অবগত।
বাংলাদেশে নির্বাচন আসছে। অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস জানিয়েছেন ২০২৫ সালের শেষ অথবা ২০২৬ সালের শুরুতে ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন হবে। খবরটা জেনে বাংলাদেশের সাধারণ মানুষ বেশ আনন্দিত। প্রত্যাশা করছে একটি অবাধ সুষ্ঠু গ্রহণযোগ্য নিরপেক্ষ অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন হবে। এই নির্বাচনে তারা তাদের ভোটাধিকার প্রয়োগ করতে পারবে।
যারা নতুন ভোটার হয়েছে তাদের আনন্দের সীমা নেই। মাত্র কয়েক দিন পরই তারা প্রথমবারের মতো ভোটাধিকার প্রয়োগ করবে। দেশের নাগরিক হিসেবে দায়িত্ব পালন করবে।
ভোটাধিকার একজন নাগরিকের মৌলিক অধিকার। এই অধিকার থেকে সরকার বা রাষ্ট্র কেউ তাকে বঞ্চিত করার বা রাখার অধিকার রাখে না। গণতান্ত্রিক দেশে তো না-ই। বাংলাদেশ একটি গণতান্ত্রিক দেশ বলে এ দেশের বেশিরভাগ নাগরিকই তার অধিকার প্রয়োগ থেকে বিরত থাকে না। নির্বাচনে পছন্দের প্রার্থীকে ভোট দিয়ে অধিকারের প্রতিফলন ঘটায়। সময় আসছে অধিকারের সঠিক ও সময়োপযোগী ব্যবহারের। আসছে নির্বাচনে বাংলাদেশের নাগরিকরা ভোট দিয়ে তাদের পছন্দের প্রার্থী নির্বাচন করবে যারা সঠিক ও পরিকল্পিতভাবে দেশ পরিচালনা করবে। দেশের মাটি ও মানুষের কথা ভাববে। দেশের উন্নয়নে অবদান রাখবে। সাধারণ মানুষের মতামতের মূল্য দেবে। অধিকারের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হবে।
দীর্ঘ দিন ধরে বাংলাদেশের মানুষ অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছে একটা নির্বাচনের জন্য। সর্বশেষ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ভোটাররা তাদের ভোটাধিকার প্রয়োগ করেছে ২০১৮ সালে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে। ২০২৪ সালের দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ভোটাররা খুব একটা ভোটকেন্দ্রে যায়নি। করতে পারেনি তাদের ভোটাধিকার প্রয়োগ। বলা চলে ভোটার উপস্থিতি ছাড়াই হয়েছে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন। এর পর থেকে মানুষ অপেক্ষা করছে। ৫ আগস্ট, ২০২৪ আওয়ামী লীগ সরকারের পতন ঘটে। ক্ষমতা গ্রহণ করে অন্তর্বর্তী সরকার। এই সরকারের ঘোষণা অনুযায়ী ২০২৫ সালের শেষ অথবা ২০২৬ সালের শুরুর দিকে বাংলাদেশে ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা।
আশা করা যায় মানুষের দীর্ঘদিনের প্রতীক্ষার প্রতিফলন ঘটবে ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ভোটাধিকার প্রয়োগ করে। দেশের শাসনভার প্রকৃত শাসকের হাতে তুলে দেওয়ার একমাত্র মাধ্যম নির্বাচন। নির্বাচনের মাধ্যমেই নির্বাচিত হন প্রকৃত জনপ্রতিনিধি। নাগরিকদের ভালো-মন্দ দেখার দায়ভার জনপ্রতিনিধিদেরই কাঁধে। সেই দায়ভার গ্রহণের জন্য প্রতিনিধিরা অংশগ্রহণ করেন নির্বাচনে।
এ পর্যন্ত বাংলাদেশে ১২টি নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে। রাষ্ট্রপতিশাসিত সরকারের অধীনে চারটি নির্বাচন হয়েছে। ১৯৭৯, ১৯৮৬, ১৯৮৮ ও ১৯৯১ সালে। ১৯৭৯ সালের সাধারণ নির্বাচন হয়েছিল ১৮ ফেব্রুয়ারি। এতে ২৯টি দল অংশগ্রহণ করেছিল। ১৯৭৩ এবং ১৯৯১ সালের নির্বাচনের পর বাকি ৭টি নির্বাচন হয়েছে মন্ত্রিপরিষদশাসিত সরকারের অধীনে। ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনও মন্ত্রিপরিষদশাসিত সরকারব্যবস্থার আওতায় হওয়ার সম্ভাবনা। এবারের নির্বাচনটা বাংলাদেশের মানুষের জন্য বেশ গুরুত্বপূর্ণ। মানুষ তাই অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছে।
বাংলাদেশের মানুষ যেকোনো ধরনের খবরের ব্যাপারে যথেষ্ট আগ্রহী। নির্বাচনের খবরের ব্যাপারে তাদের আগ্রহের মাত্রা সবার ওপরে। রাজনীতির খবর হলে তো কোনো কথাই নেই। টিভির সামনে থেকে যেন সরতেই চায় না। পত্রিকার পাতা থেকে মুখ ফেরাতে চায় না। নির্বাচনের খবর তাদের আরও বেশি আগ্রহী করে তোলে। এর বড় প্রমাণ ২৩ ডিসেম্বর, ২০১৮ তারিখে অনুষ্ঠিত একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন। এ নির্বাচনে সারা দেশের ভোটাররাই অংশগ্রহণের চেষ্টা করেছে। কেউ প্রয়োগ করতে পেরেছে তাদের ভোটাধিকার। কেউবা পারেনি। তবে নির্বাচন হয়েছে। প্রধান নির্বাচন কমিশনার বলেছেন, সুষ্ঠু-সুন্দর পরিবেশেই অনুষ্ঠিত হয়েছে বাংলাদেশের একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন। যদিও তার এই কথার সঙ্গে সুশীল সমাজের অনেকেই একমত নন।
আমরা দেখে এসেছি বাংলাদেশের নির্বাচন মানে একটা উৎসব। ঈদ কিংবা পূজা-পার্বণে যেমন একটা উৎসব উৎসব রব থাকে তেমনি নির্বাচনেও একটা উৎসব রব থাকে।
আসলে এ দেশের মানুষের যেকোনো কিছু সহজে মেনে নেওয়ার ক্ষমতাটা অনেক বেশি। বিষয়টা একটা জাতির জন্য খুবই শুভ। নির্বাচনের ব্যাপারে দেশের সাধারণ মানুষ যতটা সচেতন ঠিক ততটাই সচেতন নির্বাচনের ফলাফল নিয়েও।
একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের একটা আকর্ষণীয় দিক ছিল কিছু একেবারেই নতুন মুখ। জীবনের প্রথম নির্বাচন করেই বাজিমাত করেছেন তারা। তাদের নির্বাচনি প্রচারের স্টাইলটাও ছিল ভিন্নধর্মী। একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে সাধারণ মানুষের অংশগ্রহণটি ছিল অনেকটাই নাগরিক দায়িত্ব পালন। এরকম কথাও কোনো কোনো পত্রিকায় ছাপা হয়েছে। কথাটা গুরুত্বপূর্ণ। একটা দেশের একজন সচেতন নাগরিকের অন্যতম প্রধান দায়িত্ব তার ভোটাধিকার প্রয়োগ করা। এ অধিকার প্রয়োগের জন্য ক্ষেত্র তৈরি করে দেবে নির্বাচন কমিশন। ভোটার কেবল তার অধিকারটুকু বিচার-বিবেচনাবোধ খাটিয়ে যথাযথ প্রয়োগ করবে।
একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ভোটাধিকার প্রয়োগ নিয়ে কোনো প্রশ্ন কেউ উত্থাপন করেনি। কেউ কেউ ভোটার উপস্থিতির বিষয়টা নিয়ে কিছুটা দ্বিধান্বিত ছিল। তাদের এই দ্বিধাদ্বন্দ্বের মূলে ছিল কিছু কিছু প্রার্থীর নির্বাচন বর্জন।
বিশেষ করে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল ও তার শরিক দলগুলোর নির্বাচনে না থাকার কারণে এই দ্বিধাদ্বন্দ্বের উৎপত্তি হয়েছিল। বিষয়টা পুরাপুরি অমূলক ছিল না। তা ছাড়া দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন করলে দ্বন্দ্ব জাগাটা স্বাভাবিক। কারণ দলীয় সরকারের অধীনে অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন হলেও কেউ কেউ তাতে নানারকম গন্ধ খোঁজার চেষ্টা করে।
কিন্তু প্রশ্নটা তখনই বড় আকার ধারণ করে যখন আন্তর্জাতিক বিশ্ব ঠিক একই রকম প্রশ্ন উত্থাপন করে। একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন নিয়ে আন্তর্জাতিক বিশ্ব তেমন কোনো নেতিবাচক কথা বলেনি। নির্বাচনি পরিবেশ কিংবা ভোটার উপস্থিতি নিয়েও কোনো প্রশ্ন তুলেনি। তাই জনমনের আশঙ্কাটাও ততটা প্রবল ছিল না। কিছুটা প্রশ্ন যাদের ছিল তারা তা নিয়ে নিজেদের মাঝে আলোচনা করছে।
আসলে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন, এর পরিবেশ, ভোটার উপস্থিতি, তাদের ভোটাধিকার প্রয়োগ, এসব বিষয় নিয়ে নির্বাচন কমিশনের দেওয়া ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণের পর তেমন কিছুই বলার থাকে না।
একটা নির্বাচনের পুরো দায়িত্ব যেহেত নির্বাচন কমিশনের সেহেতু তাদের ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণটাই সর্বজনগ্রাহ্য। মানুষের সবচেয়ে বেশি প্রশ্ন ছিল দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন নিয়ে। ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের ব্যাপারে তাই সাধারণ ভোটারের আগ্রহ তুঙ্গে।
বাংলাদেশের নির্বাচন কমিশন নিয়ে নানা সময় নানা রকম কথাবার্তা হয় কিন্তু কমিশনের দেওয়া সিদ্ধান্ত কেউ মেনে নেয়নি, এমন নজির খুবই কম। এ কথাও ঠিক যে নির্বাচন কমিশনের সব বিবৃতিই যে মেনে নেওয়ার মতো তা কিন্তু
নয়। কমিশনের দেওয়া কোনো সিদ্ধান্তের ব্যাপারে কারও মনে যদি কোনো প্রশ্ন কিংবা সন্দেহ দেখা দেয় তা সে প্রকাশ করতেই পারে। তা ছাড়া স্বয়ংক্রিয় বাছাই প্রক্রিয়াও
আছে। যার কারণে মানুষ একটা ইস্যু নিয়ে বিচার-বিবেচনা করে কথা বলে। নির্বাচন তেমনি একটি ইস্যু। এই ইস্যুতে কথা বলার আগে অবশ্যই দশবার ভাবতে হবে।
ভাবনার জায়গাটা যত বেশি শক্তিশালী হবে ঝুঁকির মাত্রা তত কম হবে।
টেলিভিশন টকশোগুলোতে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে ও পরে ব্যাপক আলোচনা-পর্যালোচনা হয়েছে। এসব আলোচনা থেকে একটা কথাই বেরিয়ে এসেছে নির্বাচন, নির্বাচনের মতো হতে হবে। নির্বাচনে অবশ্যই ভোটারদের যৌক্তিক উপস্থিতি থাকতে হবে।
নাগরিকরা যেন বাধাহীন ভোটাধিকার প্রয়োগ করতে পারে সে ব্যবস্থা করতে হবে নির্বাচন কমিশনকে।
ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের ব্যাপারে বাংলাদেশের মানুষের আগ্রহ প্রবল। দীর্ঘ সংগ্রাম-সাধনার পর মানুষ তাদের হারানো ভোটাধিকার ফিরে পাওয়ার স্বপ্ন দেখছে। আশা করা যায়, অন্তর্বর্তী সরকার বাংলাদেশের মানুষের সেই স্বপ্ন পূরণে
সফল হবে।
লেখক : প্রাবন্ধিক