ই-পেপার সোমবার ১৬ ডিসেম্বর ২০২৪
সোমবার ১৬ ডিসেম্বর ২০২৪
ই-পেপার

সোমবার ১৬ ডিসেম্বর ২০২৪

সাক্ষাৎকার
প্রতিটি সরকার মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস বিকৃত করেছে
প্রকাশ: সোমবার, ১৬ ডিসেম্বর, ২০২৪, ১:৩০ এএম  (ভিজিট : ৬২)
সালেক খোকন একজন লেখক ও মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক গবেষক। বিজয় দিবস উপলক্ষে মুক্তিযুদ্ধ ও মুক্তিযোদ্ধাদের বিভিন্ন বিষয় নিয়ে সম্প্রতি কথা বলেছেন সময়ের আলোর সঙ্গে। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন নিজস্ব প্রতিবেদক আব্দুল কাইয়ুম

সময়ের আলো : ১৬ ডিসেম্বর মহান বিজয় দিবস সম্পর্কে আপনার মতামত কী?
সালেক খোকন : ১৬ ডিসেম্বর বিজয় দিবস আমাদের রাষ্ট্রের জন্য বড় বিষয়। ১৯৭১ সালে আমাদের বীর মুক্তিযোদ্ধা ও শহিদরা আত্মত্যাগের বিনিময়ে যে স্বাধীনতা এনে দিয়েছে তা স্মরণ রাখতে হবে। এই দিনে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী আত্মসমর্পণ করেছে যা একটি বড় ঘটনা। আমাদের জাতীয় জীবনে ও রাষ্ট্রীয়ভাবে দিবসটি পালনের ক্ষেত্রে বড় একটি বিষয়। এটি মূলত একটি রাষ্ট্রীয় দিবস। কোনো রাজনৈতিক অনুষ্ঠান নয়।

বর্তমান প্রজন্ম ১৯৭১ সালের সঠিক ইতিহাস সম্পর্কে কতটুকু জানে বলে মনে করছেন?
বর্তমান প্রজন্ম ১৯৭১ সালের সঠিক সম্পর্কে কতটুকু জানে তা প্রজন্মের ওপর গবেষণা করলে বলা যেত। এটুকু বলতে পারি যে, আমি আশাহত না। কারণ এখন তো জানার অনেক মাধ্যম রয়েছে। আগে তো বই পড়ে জানতে হলেও এখন জানার জায়গাটা অনেক সহজ হয়ে গেছে। কোনোএকটি মুক্তিযোদ্ধার ঘটনা বললে বর্তমান প্রজন্ম সেগুলোকে ভালোভাবেই নিতে পারছে। শুধু বিজয় দিবস, স্বাধীনতা দিবস ও ভাষা দিবস সম্পর্কে জানার মধ্যে শুধু সীমাবদ্ধ থাকলে হবে না। মুক্তিযোদ্ধা কেন হলো, এর বিভিন্ন ঘটনা, অঞ্চলের ঘটনা, মুক্তিযোদ্ধারা কোন শ্রেণির ছিলেন, তারা কেন মুক্তিযুদ্ধে গেলেন এবং মুক্তিযোদ্ধারা কেমন বাংলাদেশ চেয়েছিল জানতে হবে। আমি বিশ্বাস করি তারা ইচ্ছা করলে জানতে পারে। মূল কথা হচ্ছে স্বাধীনতার ৫৩-৫৪ বছরে তরুণ প্রজন্মকে কতটুকু জানাতে পেয়েছি। এই জায়গায় আমাদের দুর্বলতা অথবা অতিরঞ্জন ছিল। ফলে সঠিকভাবে জানাতে পারেনি।

অনেকেই বলছেন বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসকে বিভিন্নভাবে বিকৃত করা হয়েছে, আপনার মতামত কী?
এটি সত্যি যে, মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস স্বাধীনতার পর থেকে এখন পর্যন্ত অনেক বিকৃত হয়েছে। প্রতিটা সরকার এর সঙ্গে যুক্ত রয়েছে। তবে ইতিহাসকে কখনো বিকৃত করা যায় না শুধু ঘটনাকে পাল্টানো যায়। আমি যে কথা বলব তার বিপরীতে তথ্য-উপাত্ত থাকলেই গ্রহণযোগ্য হবে। মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসের মধ্যে রাজনৈতিক বিষয়গুলো যুক্ত হওয়ায় প্রত্যেকের মতো ইতিহাস তৈরি করেছে। পৃথিবীর একমাত্র বাংলাদেশ স্বাধীনতার বিরোধীরা রাজনীতি করার বৈধতা পেয়েছে। অনেকে একাত্তরে স্বাধীনতার বিপক্ষে কাজ করছে অথচ এখন সব সুযোগ-সুবিধা ও রাজনীতি করছে। এগুলো চলতে থাকলে ইতিহাসের বিকৃতির ঘটনা ঘটতে থাকবে। আমরা প্রজন্মের কাছে সঠিক ইতিহাসকে তুলে ধরতে পারিনি। এ ক্ষেত্রে আমরা অনেকটা পিছিয়ে আছি।

অনেকেই মুক্তিযোদ্ধাদের সংখ্যা নিয়ে দ্বিমত পোষণ করছে, সেটিকে আপনি কীভাবে দেখছেন?
এটি অস্বীকার করার উপায় নেই মুক্তিযোদ্ধার তালিকা নিয়ে অনেক বিতর্ক রয়েছে। প্রতিটি সরকার তার শাসনামলে মুক্তিযোদ্ধার তালিকা বৃদ্ধি করেছে। শুধু সুযোগ-সুবিধা নেওয়ার জন্য নিজেদের মুক্তিযোদ্ধা হওয়া ইচ্ছা পোষণ করছে। তবে কিছু রাজনৈতিক ধ্যান-ধারণাও রয়েছে। অনেকেই এই সুবিধাকে কাজে লাগিয়ে মুক্তিযোদ্ধার মধ্যে ঢুকে যাচ্ছে। তাদের মধ্যে অনেক রাজাকার, আলবদর ও স্বাধীনতার বিরোধীরা রয়েছে। যা অনেক গণমাধ্যমেও উঠে এসেছে। এসব কারণে মুক্তিযুদ্ধের তালিকা নিয়ে চরমভাবে বিতর্কিত হয়েছে। এ ক্ষেত্রে নীতিনির্ধারকদের বড় ধরনের একটি ভূমিকা ছিল। এটি সব আমলেই হয়েছে, নির্দিষ্ট কোন সময় হয়েছে তা কিন্তু নয়। দেখা গেছে, এক আমলে তালিকা করা হয়েছে পরে বাতিল করতে পারেনি। গেজেট হওয়ার কারণে এগুলো বাতিলও করা যায়নি। এখন মুক্তিযোদ্ধারা নানা রকম রাজনৈতিক চিন্তা-চেতনার মধ্যে যুক্ত হয়ে গেছে। তাই আমার মতে নতুন করে তালিকা করার বিষয়টি বন্ধ রাখা খুবই জরুরি। যেগুলো বিতর্ক রয়েছে যাচাই-বাছাই করে একটি নিয়মের মধ্যে নিয়ে আসা উচিত। স্বাধীনতার পর সবচেয়ে বড় কাজ হওয়ার কথা ছিল যুদ্ধাপরাধীদের তালিকা করা। তখন খুব সহজে করা যেত কিন্তু তা করা হয়নি। পরে অনেক উদ্যোগ নিলেও তা বাস্তবায়ন করা যায়নি। এতে করে অনেক মুক্তিযোদ্ধার নামও স্বাধীনতা বিরোধীদের তালিকায় চলে গেছে। দশ বছর পর কোনো মুক্তিযোদ্ধা খুঁজে পাওয়া যাবে না। কারণ যারা আছে তাদের অধিকাংশের বয়স অনেক বেশি। তাই তারা যতদিন বেঁচে আছে আমরা তাদের শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করি এবং যথাযথ মর্যাদা দিই।

১৯৭১ সালে বাংলাদেশ স্বাধীনতা হওয়ার ক্ষেত্রে কোন শ্রেণির অবদান সবচেয়ে বেশি ছিল বলে মনে করেন?
১৯৭১ সালে স্বাধীনতা অর্জনের ক্ষেত্রে কোন শ্রেণির অবদান সবচেয়ে বেশি ছিল তা সঠিকভাবে মূল্যায়ন করা খুবই কঠিন। মুক্তিযোদ্ধাদের অধিকাংশ ছিল সাধারণ জনগণ কারণ এটি ছিল গণযুদ্ধ। তবে যারা ডিফেন্সে কাজ করত তাদেরও একটা বড় অবদান ছিল। তারা চাকরি থেকে বের হয়ে সাধারণ মানুষকে প্রশিক্ষণ দিয়েছেন। তবে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণকারীর বেশিরভাগই ছিল সাধারণ মানুষ, ছাত্র সমাজ, যুবক ও কৃষক। তাদের পাশাপাশি নারীদের ভূমিকা কম ছিল না। পাকিস্তানিরা শক্তিতে অনেক বেশি থাকলেও এ দেশের মানুষ তাদের পছন্দ করত না। ফলে বিভিন্ন সময় সাধারণ মানুষ মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে তাদের তথ্য ফাঁস করে দিত। এসব মানুষই মুক্তিযোদ্ধাদের খাবার, থাকার জায়গা এবং অস্ত্র বহন করে অন্য জায়গায় নিয়ে দিত। তাই স্বাধীনতা যুদ্ধে মুক্তিযোদ্ধাদের যেমন অবদান আছে তেমনি সাধারণ মানুষের অবদানও কম নয়।

মুক্তিযোদ্ধারা যেসব সুযোগ-সুবিধা ও সম্মান পাচ্ছেন তা যথেষ্ট বলে মনে করেন কি না?
মুক্তিযোদ্ধারা এখন যেসব ভাতা ও সুযোগ-সুবিধা পাচ্ছেন তা ঠিক আছে। তবে তাদের প্রতি ভালোবাসাটা কমে গেছে। তাদের যেভাবে সম্মানিত করা প্রয়োজন সেভাবে করা উচিত। কারণ টাকা দিয়ে সবকিছু করা যায় না। এই কাজটা তখনই হবে যখন ১৯৭১ সালকে নিজের মধ্যে ধারণ করতে পারবে। বর্তমান রাজনৈতিক মতাদর্শের কারণে এসব সমস্যা হচ্ছে। কারণ সম্মান করার আগে চিন্তা করে সে কোন রাজনৈতিক মতাদর্শের বা কোন পন্থি। মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যে ভিন্ন রাজনৈতিক মতাদর্শ থাকতেই পারে কিন্তু সম্মানের জায়গায় সবাই সমান।

আপনি অনেক মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে আলাপ করেছেন, তাদের সাক্ষাৎকার নিয়েছেন, আপনার উপলব্ধি কি? মুক্তিযোদ্ধারা কি সন্তুষ্ট নাকি তাদের মধ্যে কোনো ক্ষোভ আছে?
আমি ২৫০ জনের বেশি বীর মুক্তিযোদ্ধার সঙ্গে কথা বলেছি। যদি সার্বিকভাবে বলতে হয়, বীর মুক্তিযোদ্ধাদের উদ্দেশ্য কি ছিল দেশ থেকে শত্রু মুক্ত করা, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবরের মুক্তি এবং একটি দেশকে স্বাধীন করা। স্বাধীনতা লাভের পর তারা আত্মতৃপ্তি পেয়েছে। তারা সফল হয়েছে এ ক্ষেত্রে কোনো দ্বিমত নেই। কিন্তু মুক্তিযোদ্ধারা চেয়েছিল একটি বৈষম্যহীন সার্বজনীন রাষ্ট্র। আমরা স্বাধীনতা লাভ করলেও এখনও মুক্তি হতে পারিনি। আমি যখনই তাদের প্রশ্ন করি আপনি কেমন বাংলাদেশ দেখতে চান? তারা একটাই উত্তর দেন, এই দেশকে অসাম্প্রদায়িক হিসেবে দেখতে চাই। তারা দুর্নীতিমুক্ত বাংলাদেশ এবং একাত্তরের চেতনা উদ্বুদ্ধ বাংলাদেশ দেখতে চান। তারা কোন ধরনের বাংলাদেশ চান সরকারের কোনো দিন তা জানতে চাননি। যদিও আমরা বলি ৩০ লাখ শহিদ হয়েছে কিন্তু স্বাধীনতার এত বছর পরেও শহিদের তালিকা করা হয়নি। বিভিন্ন দিবসে মুক্তিযোদ্ধাদের সামনে আনলেও গণহত্যায় নিহত পরিবারকে আনা হয় না। এসব শহিদ পরিবার রাষ্ট্রীয় ভাতা ও সুযোগ-সুবিধা পায় না। তাদের এখন পর্যন্ত রাষ্ট্রীয় স্বীকৃত দেওয়া হয়নি। এখন মুক্তিযোদ্ধা মানে তার সার্টিফিকেট থাকবেই। ১৯৭১ সালে গণহত্যায় শহিদদের স্বীকৃতি না দিলে পূর্ণাঙ্গ ইতিহাস তৈরি হবে না।

বিভিন্ন বিষয় থাকতে মুক্তিযুদ্ধের গবেষণা নিয়ে কাজ করছেন কেন? এই গবেষণা করতে গিয়ে এমন কোনো ঘটনা আছে কি না, যা আপানাকে ব্যথিত করেছে এবং ভুলতে দেয়নি?
আমি ২০০৮ সাল থেকে কাজটা শুরু করেছি। দিনাজপুরের বিরল উপজেলার মুক্তিযোদ্ধা কৃষ্ণ কিশোর দাস। যুদ্ধের সময় মাইনের আঘাতে তার একটি পা উড়ে যায়। তিনি বাড়ি বাড়ি গিয়ে কাঠমিস্ত্রির কাজ করতেন। বিভিন্ন অনুষ্ঠানে দাওয়াত পেলেও তাদের কথা গণমাধ্যমে প্রকাশ হয় না বলে দুঃখ প্রকাশ করেন। তার এই কথাটা আমার হৃদয় স্পর্শ করে। সেদিনই সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম আমি নিজ উদ্যোগে মুক্তিযোদ্ধাদের কথা জানতে চাইব। আমি তালিকা ধরে কাজ করি না। কারণ তালিকায় বিতর্ক থাকতে পারে। তাই একজন থেকে অন্য জনের খোঁজ নিয়ে বের করতে লাগলাম। আমার আর্থিক সীমাবদ্ধতা থাকার পরেও কাজ চালিয়ে গেছি। কাজের ক্ষেত্রে রাষ্ট্রীয়ভাবে কোনো সাহায্য-সহযোগিতা আমি কখনো পাইনি বা আবেদন করিনি। এর জন্য আমি বেশ কিছু পুরস্কার পেয়েছি। সবচেয়ে বেশি আনন্দ লাগে যখন অবহেলিত একজন মুক্তিযোদ্ধার কথা গণমাধ্যমে তুলে ধরতে পারে পারি।

সময়ের আলো/আরএস/




https://www.shomoyeralo.com/ad/1698385080Google-News-Update.jpg

সর্বশেষ সংবাদ

সর্বাধিক পঠিত


ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক : সৈয়দ শাহনেওয়াজ করিম, আমিন মোহাম্মদ মিডিয়া কমিউনিকেশন লিমিটেড এর পক্ষে প্রকাশক গাজী আহমেদ উল্লাহ। নাসির ট্রেড সেন্টার, ৮৯, বীর উত্তম সি আর দত্ত সড়ক (সোনারগাঁও রোড), বাংলামোটর, ঢাকা।
ফোন : +৮৮-০২-৯৬৩২৩৬৮-৭৪, ফ্যাক্স : +৮৮-০২-৯৬৩২৩৭৫ | ই-মেইল : shomoyeralo@gmail.com
close